পর্যটনশিল্প

পর্যটন কেন্দ্রঃ পর্যটন খাতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, পর্যটকদের পছন্দের বেড়ানোর তালিকায় এক নম্বরে আছে কক্সবাজার। সমুদ্র ও পাহাড় একসঙ্গে দেখার সুযোগ থাকায় কক্সবাজার দেশীয় পর্যটকদের কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয়। পরের অবস্থানে আছে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলা রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি। পছন্দের তালিকার তৃতীয় অবস্থানে আছে সিলেট। হজরত শাহজালাল ও শাহপরানের মাজার জিয়ারত ছাড়াও সিলেটের চা-বাগানসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত জায়গাগুলোতে যাচ্ছেন পর্যটকেরা। বেড়ানোর তালিকায় আরও আছে সুন্দরবন, কুয়াকাটা, সেন্ট মার্টিন, পাহাড়পুর প্রভৃতি। ঘুরতে যাওয়ার জন্য ঢাকার খুব কাছে গাজীপুরের বিভিন্ন রিসোর্টও এখন বেশ জনপ্রিয়।

আর্থিক মূল্যঃ পর্যটন ব্যবসায়ীদের সংগঠন ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (টোয়াব) হিসাব অনুযায়ী, বছরে এখন ৫০ থেকে ৬০ লাখ মানুষ দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে যান। বছর পাঁচেক আগেও এ সংখ্যা ২৫ থেকে ৩০ লাখ ছিল। আর ২০০০ সালের দিকে এ সংখ্যা ছিল মাত্র ৩ থেকে ৫ লাখ। ওয়ার্ল্ড ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম কাউন্সিলের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশের পর্যটন খাতে সরাসরি কর্মরত ১৫ লাখ মানুষ। আর পরোক্ষভাবে আরও ২৩ লাখ লোক এ খাতের সঙ্গে যুক্ত। সব মিলিয়ে প্রায় ৪০ লাখ লোকের কর্মসংস্থান তৈরি করেছে এ খাত। আর্থিক মূল্যে দেশীয় পর্যটন খাতের আকার দাঁড়িয়েছে কমপক্ষে ৪ হাজার কোটি টাকার। অভ্যন্তরীণ পর্যটক বৃদ্ধির মূল কারণ দেশে মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ। মানুষের আর্থিক সামর্থ্য এখন আগের চেয়ে বেড়েছে। ফলে ট্যুর অপারেটরদের ব্যবসা আগের চেয়ে ভালো হচ্ছে।

লাভ ক্ষতিঃ ২০১৬ সালে বাংলাদেশ থেকে ১৫-১৬ লাখ লোক দেশের বাইরে গেছেন। এর বিপরীতে দেশে আসছেন ১ থেকে ২ লাখ লোক। বাইরে যাওয়া বাংলাদেশিরা বিদেশে গিয়ে কমপক্ষে সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা খরচ করে আসছেন। এর বিপরীতে বাংলাদেশে আসছে ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয়ে পর্যটন খাতের অবদান মাত্র দশমিক ৪৭ শতাংশ। সরকার যদি এই লাভ-ক্ষতির হিসাব বিবেচনায় না নেয়, তাহলে পর্যটনে প্রকৃত উন্নতি কখনোই হবে না।

কমছে বিদেশি পর্যটক
অভ্যন্তরীণ পর্যটকের সংখ্যা বাড়লেও উল্টো অবস্থা বিদেশি পর্যটক আগমনে। দেশে এখন বছরে বিদেশ থেকে কত পর্যটক আসেন, এর সুনির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান সরকারের কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে নেই। তবে জাতিসংঘের বিশ্ব পর্যটন সংস্থার (ইউএনডব্লিউটিও) হিসাবে দেখা যাচ্ছে, দেশে গত সাত-আট বছর ধরে বিদেশি পর্যটক কমেছে। আবার বাংলাদেশ থেকে বিদেশে ঘুরতে যাওয়ার প্রবণতাও বেড়েছে।

পর্যটন শিল্পের সমস্যাঃ
অবকাঠামোগত সমস্যাঃ দেশের অনেক পর্যটনকেন্দ্রেই পর্যাপ্ত অবকাঠামো সুযোগ-সুবিধা নেই। আবার যেখানে অবকাঠামো তৈরি হচ্ছে, সেখানে পরিকল্পিত উপায়ে কাজ হচ্ছে না। অপরিকল্পিত অবকাঠামোর সবচেয়ে বড় উদাহরণ কক্সবাজার। অতিরিক্ত পর্যটকের ভারে সেন্ট মার্টিন দ্বীপের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যও এখন হুমকির মুখে পড়েছে।

সমাধানঃ

সবার সংশ্লিষ্টতাঃ সরকারিভাবে দেশে পর্যটনশিল্পের প্রসারে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন ও বাংলাদেশ পর্যটন বোর্ড কাজ করছে। এছাড়া ও এর সাথে যুক্ত আছে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়। , বিভিন্ন মন্ত্রণালয় যদি তাদের উন্নয়ন ভাবনায় পর্যটনকে সম্পৃক্ত করে, তাহলেই এ খাতের প্রত্যাশিত উন্নয়ন সম্ভব। এ জন্য পর্যটন বোর্ড চেষ্টা করে যাচ্ছে। উদাহরণ স্বরূপ পদ্মা সেতু প্রকল্পে নদীর দুই পারে নদীভিত্তিক আলাদা পর্যটনকেন্দ্র তৈরির পরিকল্পনা করা সম্ভব।

দক্ষ ও সংশ্লিষ্ট লোক নিয়োগঃ ভারতে বিদেশি পর্যটক বাড়ানো নিয়ে এক গবেষণায় দেখা যায়, উন্নতি করতে হলে আমলাতন্ত্রের হাত থেকে এ খাতকে বের করে আনতে হবে। কারণ, পর্যটন নিয়ে আলাদা আগ্রহ ও জানাশোনা থাকতে হয়, এটা প্রথাগত আমলাদের দিয়ে চালানো সম্ভব নয়। ভারতের পর্যটন মন্ত্রণালয় এখন মূলত চলছে গবেষক এবং এ খাতের বিশেষজ্ঞদের নিয়ে। বাংলাদেশেও এখন সেটা করতে হবে। পর্যটন মন্ত্রণালয়, পর্যটন করপোরেশন, বোর্ড—সব প্রতিষ্ঠান চলছে আমলাদের দিয়ে। এখানে পর্যটন খাতের বিশেষজ্ঞদের কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই।

দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনাঃ পর্যটন বাজার ধরতে ভারত, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ পরিকল্পনা শুরু করে দিয়েছে, বাংলাদেশ কিছুই করছে না। এসব বিষয় নিয়ে এখনই চিন্তাভাবনা শুরু করতে হবে। পর্যটনের উন্নতির জন্য গবেষণার সুযোগ তৈরি করতে হবে। পদ্মা সেতুর মতো বড় যেসব প্রকল্প এখন চলছে, সেগুলোকে ঘিরে পর্যটনকেন্দ্র তৈরির পরিকল্পনা হাতে নিতে হবে।

পর্যটন কেন্দ্রগুলো রক্ষার উদ্যোগঃ পর্যটনে এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে একটি দর্শনীয় স্থানকে কীভাবে টিকিয়ে রাখা যায়। আজকে সুন্দরবন যেমন আছে, আজ থেকে ১০০ বছর পরে পরবর্তী বংশধরেরা যাতে তেমনটি দেখতে পায়, সে অবস্থা তৈরি করা আমাদেরই দায়িত্ব। এটা টেকসইভাবে করতে হলে স্থানীয় লোকজনকে এর সঙ্গে যুক্ত করতে হবে, যেটাকে বলা হচ্ছে সিবিটি (কমিউনিটি বেসড ট্যুরিজম)। যেমন পাহাড়পুরে যেসব পর্যটক এখন বেড়াতে যায় সেখানে থাকার কোনো ব্যবস্থা নেই। সিবিটির মাধ্যমে স্থানীয় লোকজনকে দিয়ে পর্যটকদের থাকার ব্যবস্থা সেখানে করা যেতে পারে।

ব্রান্ডিংঃ আমাদের ভালো দিক(যেমন পোশাক) ও ভালো ভালো স্থানগুলোর পরিচিতি প্রসারে কাজ করতে হবে। ও ই-ভিসা প্রচলন করে বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণ করতে হবে।

ইন্টারনেট ও প্রযুক্তির ভূমিকা
দেশীয় পর্যটনের প্রসারে ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক একটা বড় ভূমিকা রাখছে। সুযোগ পেলেই দেশের আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়াচ্ছেন তরুণেরা। সেই ভ্রমণের ছবি ও গল্প সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশের পর সেই স্থানে যেতে আগ্রহী হয়ে উঠছেন অন্যরা। তরুণ প্রজন্মের হাত ধরেই রাতারগুল, বিছনাকান্দি, হামহাম, সাজেকের মতো বিভিন্ন জায়গা মানুষের কাছে পরিচিতি পেয়েছে। দেশের মানুষের পাশাপাশি অনেক বিদেশিও ইন্টারনেটে এসব স্থানের বর্ণনা দেখে বাংলাদেশে আসতে আগ্রহী হয়ে উঠছেন। অল্প পরিচিত কিংবা নতুন নতুন স্থান হয়ে উঠছে পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্র। প্রযুক্তির ব্যবহার এবং তরুণ প্রজন্মের হাত ধরে দেশের পর্যটন খাত গতিশীল হচ্ছে।

Add a Comment