দ্বিন-ই-ইলাহি

পারিবারিকভাবে আকবর ছিলেন সুন্নি ও হানাফি মাজহাবের অনুসারী। তিনি ধর্মীয় উদার পরিবেশে বড় হয়েছেন। তার পরিবারে ধর্মীয় সংকীর্ণতাকে খাটো করে দেখা হত। ১৫ শতকের দিকে ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন শাসকবর্গ বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে সম্প্রীতি বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করেছেন। গুরু নানক, কবির, চৈতন্যদেব প্রভৃতি মণিষীগণও ধর্মীয় সম্প্রীতির প্রচারে কাজ করেছেন। পারস্যের কবি হাফিজের কবিতাগুলোও উদারতাবাদ ও মানবতাবাদের কথা বলত। এছাড়া তৈমুর থেকে শুরু করে হুমায়ুন পর্যন্ত প্রত্যেক শাসকই ধর্মীয় উদারতার পরিচয় দিয়েছেন। তাই বলা যায় ধর্মীয় উদারতা আকবরের রক্তেই মিশেছিল। ছোট বেলায় আকবরের দুজন গৃহ শিক্ষক ছিলেন, তারা শিয়া পন্থী হলেও তাদের মাঝে কোন গোত্রীয় সংকীর্ণতা ছিল না। ধারণা করা হয় তাদের শিক্ষাও আকবরকে উদার হতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

আকবর বিভিন্ন ধর্মীয় ব্যক্তিদের মধ্যে, সেগুলোর এক গোত্রের সাথে আরেক গোত্রের, আস্তিকের সাথে নাস্তিকের, বাস্তববাদ – বস্তুবাদসহ বিভিন্ন মতবাদের মানুষের মাঝে বিতর্কের আয়োজন করতেন। আকবর ও তার সভাসদ সে সব বিতর্ক শ্রবণ করতেন। ইসলাম গোত্রীয় বিতর্কে তিনি নিরপেক্ষ থাকার চেষ্টা করলেও, সুফিবাদের দিকে তার একটু ঝোঁক লক্ষ করা যায়। তার কথায় “সুফিবাদের জ্ঞানই হল বেদান্তের জ্ঞান।”

তার দরবারেও তিনি কয়েকজন উদার জ্ঞানী ব্যক্তিকে নিয়োগ করেন। যাঁদের মধ্যে আবুল ফজল, ফইজি, বীরবল সহ নয়জনকে বলা হত নবরত্ন। ব্যক্তি জীবনে তিনি পির-ফকিরদেরকে সম্মান ও শ্রদ্ধা করতেন, তাদের আলোচনা শুনতেন। সুফি দরবেশদের সমীহ করে চলতেন। তাছাড়াও বিশ্বের যেকোন গুণী ব্যক্তি তার কাছে যতার্থ সম্মান পেতেন। ফতেহ পুর সিকরি তে তিনি একটি ইবাদত খানা খোলেন। সেখানে ধর্মীয় আলোচনা হত। প্রাথমিকভাবে ইবাদত খানা শুধু মুসলিমদের জন্য উন্মুক্ত ছিল। আকবর সেখানে ইসলামের ভিন্ন ভিন্ন ফেরকার বিভিন্ন গোত্রের লোকদের দাওয়াত দিতেন। তাদের মাঝে কথাবার্তা, তর্কবিতর্ক বাগ-বিতাণ্ডের সৃষ্টি হয়। যা আকবরের মনে তিক্ত অভিজ্ঞতার সৃষ্টি করে। পরে ইবাদত খানা সকল ধর্মের মানুষের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। এমনকি সেখানে বস্তুবাদী, নাস্তিকরাও আসতেন।

ভালোর উদ্দেশ্যে ইবাদত খানা সকলের উদ্দেশ্যে উন্মুক্ত করে দিলেও তাতে আরো বেশি বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। তিনি বুঝতে পারেন যে এক ধর্মের মানুষ আরেক ধর্মের মানুষকে, এক গোত্রের মানুষ আরেক গোত্রের মানুষকে সহ্য করতে পারে না। ফলে তিনি ইবাদত খানার আলোচনা বন্ধ করে দেন। এবং বুঝতে পারেন যে ধর্মগুলোর মধ্যে আচরণিক বা আনুষ্ঠানিক পার্থক্য থাকলেও সব ধর্মেরই কিছু ভালো দিক আছে, এবং সেগুলো প্রায় সব ধর্মেই একইভাবে আছে। তাই তিনি এক নতুন ধর্মের ধারণা নিয়ে আসলেন, যে ধর্ম অন্য ধর্মের মানুষের সাথে পার্থক্য করবে না, যা শান্তির কথা বলবে, একতার কথা বলবে, বলবে সম্প্রীতি ও সহিষ্ণুতার কথা। তিনি এর নাম দিলেন দ্বিন-ই-ইলাহি। যার মূল কথা হল সুল্‌হ্‌-ই-কুল বা বিশ্ব শান্তি। এই ধর্মকে স্মরণীয় করে রাখতে উত্তর প্রদেশের প্রয়াগের নাম পরিবর্তন করে Allahabad রাখা হয়। Allahabad ইলাহবাদ বা এলাহবাদ উচ্চারণ করা হয়।

তবে বর্তমানের অনেক বিদ্বান ব্যক্তি মনে করেন যে আকবর নতুন কোন ধর্মের প্রবর্তন করেন নি এমনকি তিনি দ্বিন-ই-ইলাহি নামটি পর্যন্ত ব্যবহার করেননি। এই ভুলের সৃষ্টি হয় যখন বৃটিশ ইতিহাসবেত্তাগণ ভুলভাবে আবুল ফজলের বইয়ের অনুবাদ করেন। তারা আরও মনে করেন যে বিশ্ব শান্তির একক ধর্মের ধারণা আকবর গ্রহণ করেন ড. অস্কার আর. গোমেজের কাছ থেকে। অস্কার তিব্বতের তান্ত্রিক বৌদ্ধদের কাছ থেকে এই ধারনা নিয়ে নাম দিয়েছিলেন আন্তঃধর্মীয় উদার দৃষ্টিভঙ্গি।

তা যাই হোক, উল্লিখিত দ্বিন-ই-ইলাহি ধর্মের কোন ঐশি গ্রন্থ বা অবতার ছিল না, তাই হয়ত এ ধর্ম প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারেনি। কিন্তু এর ছিল শক্তিশালী নৈতিক ভিত্তি যেখানে- ইন্দ্রিয়পরায়নাতা, অজাচার, কুৎসা রটানো, অহংকার করা গর্হিত পাপ বলে গণ্য হত। অপরদিকে নম্রতা, ভদ্রতা, ভক্তি, বিচক্ষণতা, সংযোম, দয়া ইত্যাদি মৌলিক মানবীয় গুণাবলির উৎকর্ষ সাধন ছিল এর প্রধান লক্ষ্য। এ ধর্মে পশু হত্যাকে নিরুৎসাহিত করে কৌমার্যব্রতকে উৎসাহিত করা হত। মনকে পবিত্র করে, সৃষ্টি কর্তার প্রতি প্রেমপুর্ণ ভক্তির মাধ্যমে আত্মার পরিশুদ্ধি লাভের চেষ্টা করা হত।

ধর্মীয় দিক থেকে এ ধর্মের যতার্থতা যাই হোক, মহামতি আকবরের উদ্দেশ্য এক্ষেত্রে সফল – তা বলা যায়। এ ধর্ম সবাই না মানলেও সবার সাথে সবার সদ্ভাব বজায় ছিল। এমনকি তার মৃত্যুর সময়েও তার বিভিন্ন ধর্মের প্রজাদের মধ্যে ধর্মীয় কোন বিদ্বেষ বা রেষারেষি ছিল না।

Add a Comment