আকবর

জালাল উদ্দিন মোহাম্মদ আকবর ভারতবর্ষের সর্বশ্রেষ্ঠ শাসক। পৃথিবীর ইতিহাসে মহান শাসকদের অন্যতম মহামতি আকবর (Akbar the Great) নামেও পরিচিত। তিনি মুঘল সাম্রাজ্যের তৃতীয় সম্রাট। তিনি ১৫৬৫ থেকে ১৬০৫ সাল পর্যন্ত শাসন করেন। পিতা সম্রাট হুমায়ুনের মৃত্যুর পর ১৫৫৬ সালে মাত্র ১৩ বছর বয়সে আকবর ভারতের শাসনভার গ্রহণ করেণ। রাজপ্রতিভূ বৈরাম খানের তত্ত্বাবধানে তিনি সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার সাম্রাজ্য বিস্তার করতে সক্ষম হন। আকবর ছিলেন দৃঢ় ব্যক্তিত্বের একজন সফল সেনানায়ক। তিনি প্রায় সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশে মুঘল সাম্রাজ্য বিস্তার করতে সক্ষম হন। সামরিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে তিনি প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হন। এছাড়াও তিনি বিজিত রাজ্যের সাথে কূটনৈতিক দিক দিয়ে বা বিবাহের মাধ্যমে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করতেন।

১৪ বছর বয়সে আকবর প্রথম বিয়ে করেন চাচাত বোন, নয় বছর বয়সী রুকাইয়াকে। সাম্রাজ্যের রাজপুতদের সাথে সুসম্পর্ক রাখার স্বার্থে আকবর বিভিন্ন রাজবংশের রাজকন্যাদের বিয়ে করেন। তবে তার স্ত্রীদের মধ্যে সবচাইতে আলোচিত হলেন যোঁধা বাঈ। আর পাটরানি ছিলেন রুকাইয়া। শের শাহ সুরির মৃত্যুর পর তার পুত্র ইসলাম শাহের রাজ্যাভিষেক নিয়ে বিশৃঙ্খলার সুযোগে ১৫৫৫ সালে হুমায়ুন দিল্লি পুনরুদ্ধার করেন। এর পরের বছর সিড়ি দিয়ে নামার সময় হুমায়ুন পড়ে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেন। এর পর বৈরাম খানের তত্ত্বাবধানে ১৪ বছর বয়সে আকবর মুঘল সাম্রাজ্যের সিংহাসনে আরোহণ করেন।

আকবরের সময় রাজস্ব বিভাগের প্রধানকে বলা হত উজির। সামরিক বাহিনীর প্রধনাকে বলা হত মির বকশি। রাজ গৃহের তত্ত্বাবধানে থাকতেন মির সমন আর বিচার ও ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের জন্য থাকতেন কাজি। আকবর কর ব্যবস্থার সংস্কার করেন। দু একটি ব্যবস্থা অকার্যকর প্রমাণিত হলে, দশসলা ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। দশসলা ব্যবস্থা প্রবর্তনে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন রাজা টোড্‌র মল। টোড্‌র মল ছিলেন শের শাহ সুরির অধীনে একজন রাজস্ব কর্মকর্তা। এই দশসলা ব্যবস্থায় গত দশ বছরের গড় উৎপাদনের এক তৃতীয়াংশকে বাৎসরিক রাজস্ব কর হিসাবে নগদ টাকা আদায় করা হত। তার সময় ব্যবসা বাণিজ্যের প্রভূত উন্নয়ন ঘটেছিল।

আকবরের ছিল শক্তিশালি সামরিক বাহিনী। মনসবদারি ব্যবস্থার মাধ্যেম তিনি সেনাবিহিনী পরিচালনা করতেন। যেখানে প্রতিটি অফিসারকে একজন মনসবদার বলা হত। পালা করে ব্যবহার করার জন্য সৈন্য সংখ্যার দ্বিগুন অ্যারাবিয়ান ঘোড়া রাখতেন। তখনকার সময়ে মনসবদাররাই বিশ্বে সব থেকে বেশি বেতন পেত।

ধর্মীয় জীবনে আকবর ছিলেন সেলিম চিশতি নামক এক পিরের মুরিদ। জনাব সেলিম চিশতি বাস করতেন আগ্রার নিকটে সিকরি নামক জায়গায়। এ কারণে আকবর সিকরিকে তার জন্য পুণ্যভূমি বা সৌভাগ্যের বলে বিবেচনা করতেন। আকবর সিকরিতে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। চিতর ও রানথাম্বর বিজয়ের পর আকবর সেখানে ফতেহপুর( বিজয় নগরী) নামে নতুন রাজধানী স্থাপনের কাজ শুরু করে দেন। এর পর গুজরাটের বিজয় এলে ফতেহপুর নামে একাধিক স্থানের সৃষ্টি হয়। ফলে আকবর নতুন রাজধানীর পুনঃনামকরণ করে ফতেহপুর-সিকরি। ফতেপুর সিকরির খাবার পানি ছিল নিম্নমানের তাও ছিল অপ্রতুল। তাই অচিরেই আকবর লাহরে তার রাজধানী স্থানান্তর করেন। এর কয়েক বছর পর তিনি আবার আগ্রায় ফিরে আসেন। মৃত্যু অবধি তিনি সেখানেই থাকেন।

প্রথম জীবনে আকবর সুন্নি-হানাফি মাজহাবের অনুসারী ছিলেন। পরবর্তী জীবনে তিনি সুফি দর্শনের দিকে ঝুঁকে পড়েন। তিনি সকল ধর্মের ভালো ভালো দিক গুলো নিয়ে নিজে একটি ধর্মের প্রবর্তন করে নাম দেন দ্বিন-ই-ইলাহি। এই ধর্মের আচার আনুষ্ঠানিকতা বলতে ছিল মানবীয় সকল মৌলিক গুণাবলীর চর্চা যা নীতি-নৈতিকতার নিক্তিতে বিচার্য হত। এ ধর্মের কারণে তিনি ধর্মে-ধর্মে, মানুষে-মানুষে বিদ্বেষ নির্মূল করতে পেরেছিলেন।


কয়েকজন ঐতিহাসিক বাঙ্গলা দিনপঞ্জি উদ্ভবের কৃতিত্ব আরোপ করেন ৭ম শতকের রাজা শশাঙ্কের উপর। পরবর্তীতে মুঘল সম্রাট আকবর এটিকে রাজস্ব বা কর আদায়ের উদ্দেশ্যে পরিবর্তিত করেন। (৩৯তম বিসিএস প্রিলিমিনারি) তবে এই গণনা পদ্ধতি কার্যকর করা হয় আকবরের সিংহাসন আরোহণের সময় (৫ই নভেম্বর, ১৫৫৬) থেকে। প্রথমে এই সনের নাম ছিল ফসলি সন, পরে “বঙ্গাব্দ” বা বাংলা বর্ষ নামে পরিচিত হয়।

আবুল ফজল ফার্সি ভাষায় সম্রট আকবরের জীবনী ‘আকবরনামা‘ রচনা করেন।

১৬০৫ সালের ৩ অক্টোবর তিনি আমাশয় রোগে আক্রান্ত হন। তার এ রোগ আর ভালো হয়নি। এ রোগ নিয়েই তিনি ২৭ অক্টোবরে দেহ ত্যাগ করেন। আগ্রার সিকান্দ্রায় থাকে সমাধিস্থ করা হয়। এরপর মুঘল সাম্রাজ্যের ক্ষমতার মসনদে আরোহণ করেন তার পুত্র জাহাঙ্গীর।

Add a Comment