৭২ এর সংবিধান

আমরা অনেকবার অনেকভাবে ‘৭২ এর সংবিধান’ শব্দগুচ্ছ শুনেছি। কী আছে ৭২ এর সংবিধানে যা এখন নেই? কী ছিল সেই সংবিধানে যা বাদ দেওয়া হয়েছিল? আসুন নিচের আলোচনা থেকে জেনে নেই ৭২ এর সংবিধান গুরুত্ব কী, কেন প্রয়োজ্‌ বা কোন অংশ প্রয়োজন, কোন অংশের প্রয়োজনীয়তা নেই- সবকিছু।

রাষ্ট্র পরিচালনার মূল চার নীতি

৯ থেকে ১২ এই চার অনুচ্ছেদে রাষ্ট্র পরিচালনার চার মূলনীতি যথা জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্ম নিরপেক্ষতা, এই চারটি মূলনীতি এখন যে নামে যে অবস্থায় আছে, ৭২ এর সংবিধানেও অনুরূপভাবে ছিল। এতে প্রথম পরিবর্তন আসে ৭৫ এর চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে। যেখানে গণতন্ত্রকে তিরোহিত করে, এক দলীয় শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়।
তারপর পঞ্চম সংশোধনীতে পরিবর্তন করা হয়, অপর তিন মৌলিক নীতিতে। সমাজতন্ত্রের পরিবর্তে ‘সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায় বিচার অর্থে সমাজতন্ত্র’ প্রতিস্থাপন করা হয়। ধর্ম নিরপেক্ষতার পরিবর্তে ‘ মহান আল্লাহতালার প্রতি পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ সংযোজন করা হয়। ও ‘বাঙালী জাতীয়তাবাদ’ কে ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’ দিয়ে প্রতিস্থাপন করা হয়। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ৭২ এর চার মূলনীতের ফিরে যাওয়া হয়।

৭২ সংবিধান অনুযায়ী ৭০ নং অনুচ্ছেদ

কোন নির্বাচনে কোন রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরুপে মনোনীত হইয়া কোন ব্যক্তি সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হইলে তিনি যদি-

(ক) উক্ত দল হইতে পদত্যাগ করেন, অথবা
(খ) সংসদে উক্ত দলের বিপক্ষে ভোটদান করেন,
তাহা হইলে সংসদে তাঁহার আসন শূন্য হইবে, তবে তিনি সেই কারণে পরবর্তী কোন নির্বাচনে সংসদ-সদস্য হইবার অযোগ্য হইবেন না।

এই অনুচ্ছেদটি ৭২ এর সংবিধানে যেভাবে ছিল এখনও সেভাবেই আছে। ধারণা করা হয় নতুন দেশ গঠনে যাতে অনাকাঙ্ক্ষিত কোন পরিস্থিতির সৃষ্টি না হয় সে জন্য বঙ্গবন্ধু এ অনুচ্ছেদটি যুক্ত করেছিলেন। তখনকার পরিস্থিতি অনুযায়ী অনুচ্ছেদটির দরকার থাকলেও বর্তমানে দরকার আছে বলে মনে হয় না।

৭২ সংবিধান অনুযায়ী ৯৬(২) নং অনুচ্ছেদ

প্রমাণিত অসদাচরণ বা অসামর্থ্যের কারণে সংসদের মোট সদস্য-সংখ্যার অন্যূন দুই-তৃতীয়াংশ গরিষ্ঠতার দ্বারা সমর্থিত সংসদের প্রস্তাবক্রমে প্রদত্ত রাষ্ট্রপতির আদেশ ব্যতীত কোন বিচারককে অপসারিত করা যাইবে না।

উপর্যুক্ত ধারাটিতে প্রথম পরিবর্তন আসে বঙ্গবন্ধুর সময়ের, ১৯৭৫ সালের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে। যেখানে বিচারক অপসারণের ক্ষমতা সাংসদদের হাত থেকে রাষ্ট্রপতির হাতে আসে। তারপর ১৯৭৯ সালের পঞ্চম সংশোধনীতে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতির হাত থেকে সে ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাতে দেন। প্রধান বিচারপতি ও দুজন সিনিয়র বিচারপতি নিয়ে সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল গঠনের ব্যবস্থা করা হয়। বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কাছে ন্যস্ত হয়।

২০০৮ সাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায় থাকায়, বর্তমান সংবিধানে ৭২ এর অনেক অনুচ্ছেদ ফিরিয়ে এনেছে। যা খুবই ভালো দিক। সেই সাথে তারা ৯৬(২) অনুচ্ছেদ ও ফিরিয়ে আনতে চান। যাতে সংসদ বিচারবিভাগকে নিয়ন্ত্রন করতে পারে। এটিও তো ভালো দিক- সমস্যাটা তাহলে কোথায়? সমস্যাটা হল ৭০ অনুচ্ছেদ। এখানে সাংসদ নেতা যদি বিচারক অভিশংশনের প্রস্তাব এনে সাংসদ সদস্যদেরকে তার পক্ষে ভোট দিতে বলেন। ৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী তারা তা করতে বাধ্য। ফলে সবার মতামতে নয় শুধু একজনার মতামতের কারনে একজন প্রধান বিচারপতিকে অপসারণ করা যাচ্ছে। কত সহজ ব্যাপার!!!

কিন্তু বিচারপতি এস.কে সিনহা তা আর হতে দিলেন না। তিনি ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে দিয়ে বিচারক অপসারণের ক্ষমতা আবার সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাতে দিলেন। এবং নিজে দেশ ছেড়ে চলে গেলেন।

৭২ সংবিধান অনুযায়ী ১১৬ নং অনুচ্ছেদ

বিচার কর্ম বিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিদের এবং বিচারবিভাগীয় দায়িত্বপালনরত ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রন( কর্মস্থল নির্ধারন, পদোন্নতিদান ও ছুটি মঞ্জুরি সহ) ও শৃঙ্খলা বিধান সুপ্রিম কোর্টের উপর ন্যাস্ত থাকিবে।

পঞ্চদশ সংশোধনীর পর বর্তমান ১১৬ অনুচ্ছেদ
বিচার-কর্মবিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিদের এবং বিচারবিভাগীয় দায়িত্বপালনে রত ম্যাজিষ্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ (কর্মস্থল- নির্ধারণ, পদোন্নতিদান ও ছুটি মঞ্জুরীসহ) ও শৃংখলাবিধান রাষ্ট্রপতির উপর ন্যস্ত থাকিবে এবং সুপ্রীম কোর্টের সহিত পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক তাহা প্রযুক্ত হইবে।

অর্থাৎ পঞ্চদশ সংশোধনীতে সুপ্রিম কোর্টকে শুধু পরামর্শকের ভূমিকা দেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে মূলত অধস্তন আদালতসমূহের নিয়ন্ত্রণ সরকারের হাতে চলে গেছে। কিন্তু ৭২ এর সংবিধানে তা শুধু সুপ্রিম কোর্টের উপর ন্যাস্ত ছিল।

Add a Comment