১৯৪৭ থেকে ১৯৭১
|বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস দীর্ঘ এবং সমৃদ্ধ। ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান ভাগের মাধ্যমে বাংলাদেশ তথা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংগ্রামের শুরু। এই সংগ্রাম ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে চূড়ান্ত রূপ নেয়। চলুন এই সময়সীমার গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলো এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের ঐতিহাসিক পরিক্রমা সম্পর্কে বিস্তারিত জানি, যা বিসিএস পরীক্ষার্থীদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
১. ভারত-পাকিস্তান বিভাজন ও পূর্ব পাকিস্তানের সৃষ্টি (১৯৪৭)
- ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তানের বিভাজন: ব্রিটিশ শাসন থেকে ভারত উপমহাদেশের স্বাধীনতা লাভের পর, ধর্মের ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বিভাজন ঘটে। পূর্ব বাংলা বা পূর্ব পাকিস্তান এই নতুন পাকিস্তান রাষ্ট্রের অংশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
- ভাষা, সংস্কৃতি ও অর্থনৈতিক বৈষম্য: পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে শাসন ও বণ্টন বৈষম্যের কারণে পূর্ব পাকিস্তান শাসনের ক্ষেত্রে অবহেলার শিকার হয়। ভাষা আন্দোলনের সূচনা এখান থেকেই।
২. ভাষা আন্দোলন ও বাঙালিদের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম (১৯৪৮-১৯৫২)
- ভাষা আন্দোলন: পাকিস্তান সরকার উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার চেষ্টা করে। বাঙালি জনগোষ্ঠী এর প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে ওঠে।
- ২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২: রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ঢাকায় আন্দোলনরত ছাত্রদের উপর গুলি চালানো হয় এবং সালাম, বরকত, রফিকসহ আরও অনেকে শহীদ হন। এই আন্দোলন বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে এবং একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত।
৩. ঐতিহাসিক ৬ দফা আন্দোলন (১৯৬৬)
- ৬ দফা দাবি: ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের জন্য ৬ দফা দাবি পেশ করেন। এই দাবির মূল লক্ষ্য ছিলো অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করা।
- ৬ দফা আন্দোলনের প্রভাব: ৬ দফা ছিল বাঙালির মুক্তির সনদ হিসেবে পরিচিত এবং স্বাধীনতার আন্দোলনের ভিত্তি গড়ে তোলে। এতে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের মধ্যে স্বাধীনতার চেতনা আরও তীব্র হয়।
৪. আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা (১৯৬৮)
- মামলার উদ্ভব: পাকিস্তান সরকার দাবি করে যে শেখ মুজিবুর রহমান সহ বেশ কয়েকজন বাঙালি নেতা ভারতের সাথে মিলে ষড়যন্ত্র করছে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে।
- পরিণতি: মামলার বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন শুরু হলে পরিস্থিতি পাল্টে যায় এবং শেষমেশ মামলাটি বাতিল করতে হয়। এই ঘটনার ফলে শেখ মুজিবুর রহমান “বঙ্গবন্ধু” উপাধি পান।
৫. সাধারণ নির্বাচন এবং অস্থিরতা (১৯৭০)
- ১৯৭০ সালের নির্বাচন: এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানে প্রায় সম্পূর্ণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়, ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসনে জয় লাভ করে।
- পশ্চিম পাকিস্তানের বাধা: পশ্চিম পাকিস্তান সরকার ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি করতে থাকে। ফলে বাঙালিরা ক্ষোভে ফেটে পড়ে এবং স্বাধীনতার দাবি আরও প্রবল হয়ে ওঠে।
৬. ৭ মার্চের ভাষণ এবং অসহযোগ আন্দোলন (১৯৭১)
- ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ: ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার অঘোষিত ঘোষণা দেন। তিনি তার ভাষণে বলেন, “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।”
- অসহযোগ আন্দোলন: ৭ মার্চের ভাষণের পর পূর্ব পাকিস্তানে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয় এবং এই সময় বাঙালি জনগণ স্বাধীনতার লক্ষ্যে প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকে।
৭. স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনা (২৫ মার্চ, ১৯৭১)
- অপারেশন সার্চলাইট: ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাঙালিদের উপর অত্যাচার চালাতে শুরু করে। ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে গণহত্যা চালানো হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দেন এবং পুরো জাতি মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
- স্বাধীনতার ঘোষণা: ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এ দিন থেকেই আনুষ্ঠানিকভাবে মুক্তিযুদ্ধের শুরু।
৮. মুক্তিযুদ্ধের পর্যায় ও চূড়ান্ত বিজয় (১৯৭১)
- গেরিলা যুদ্ধ: প্রাথমিক পর্যায়ে বাঙালি মুক্তিযোদ্ধারা গেরিলা যুদ্ধ চালিয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা তাদের সাহসিকতা ও ত্যাগের মাধ্যমে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর উপর আঘাত হানতে থাকে।
- মিত্র বাহিনীর সাহায্য: ভারতীয় সেনাবাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে এসে দাঁড়ায়। ডিসেম্বর মাসে যৌথবাহিনী গঠন করে পূর্ণ শক্তিতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে আক্রমণ চালানো হয়।
- বিজয়: ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করে। এই দিন বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে।
বিসিএস প্রস্তুতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন
১. ভাষা আন্দোলনের কারণ ও এর প্রভাব ব্যাখ্যা করুন।
২. ৬ দফা আন্দোলনের তাৎপর্য কী ছিল?
৩. ৭ মার্চের ভাষণের গুরুত্ব কী ছিল?
৪. মুক্তিযুদ্ধের প্রধান পর্বসমূহ ব্যাখ্যা করুন।
৫. স্বাধীনতা যুদ্ধের বিজয়ে মিত্র বাহিনীর অবদান বিশ্লেষণ করুন।
উপসংহার
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ছিলো একটি দীর্ঘ সংগ্রাম এবং এর প্রতিটি ধাপে ছিলো বাঙালির ঐক্য, সাহস, ও আত্মত্যাগের গল্প। বিসিএস প্রিলিমিনারি এবং লিখিত পরীক্ষায় এই বিষয়গুলোর উপর প্রশ্ন আসার সম্ভাবনা থাকে, তাই ভালোভাবে প্রস্তুতি নেওয়া জরুরি।