স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র

মুজিবনগর সরকারের তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয় মুক্তিযুদ্ধের সময় অবরুদ্ধ দেশবাসী ও মুক্তিযোদ্ধাদের দারুণভাবে উৎসাহিত করত। মুজিবনগর সরকারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অভ্যন্তরীণ প্রশাসনিক ইউনিট ছিল তথ্য ও প্রচার বিভাগ। স্বাধীন বাংলা বেতার সরকারের অধীন সর্বপ্রথম সংস্থাসমূহের অন্যতম। ২৬ মার্চ চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রের কয়েকজন কর্মী একটি ট্রান্সফর্মার সংগ্রহ করে কালুরঘাটে স্থাপন করে সম্প্রচার শুরু করেন। নাম দেওয়া হয় “স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র”। “বিপ্লবী” শব্দটি কমিউনিস্ট ঘেঁষা হওয়ায় ২৮ মার্চ মেজর জিয়ার অনুরোধে তা বাদ দিয়ে “স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র” করা হয়।

৩০মার্চে কালুরঘাটে পাকিস্তান বাহিনী বোমা বর্ষণ করে, এ বিমান হামলায় কেউ হতাহত না হলেও বেতার কেন্দ্র এবং সম্প্রচার যন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই কেন্দ্রটি ত্রিপুরার বাগফায় সরিয়ে নেওয়া হয়। ফলে সম্প্রচার কয়েকদিন বন্ধ থেকে ৩ এপ্রিল থেকে সম্প্রচার শুরু হয়।

এরপর ২৫ মে বেতার কেন্দ্রটি কলকাতায় সরিয়ে নেওয়া হয়। কলকাতার বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের ৫৭/৮নং দোতলা বাড়িটিতে রাষ্ট্রপতি ও অন্যান্য মন্ত্রীদের আবাসের কক্ষের সাথের একটি কক্ষে উক্ত ট্রান্সমিটার দিয়ে সম্প্রচার শুরু হয়েছিল। উল্লেখ যে এ বাসাটিই ছিল অস্থায়ী সরকারের প্রথম সদর দপ্তর। রাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রীরা অন্য বাড়িতে উঠে যাওয়ার পর সেই ৫৭/৮ নম্বর বাড়িটিই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের স্থায়ী কার্যালয় রূপে গড়ে ওঠে। তারপর সেখান থেকেই সম্প্রচার চলতে থাকে ২২ডিসেম্বর পর্যন্ত। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ৬ ডিসেম্বর ভারত বাংলাদেশকে সার্বভৌম স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেবার পর এর নাম বদলে । ‘বাংলাদেশ বেতার। করা হয়।

স্বাধীনতার ঘোষণা
২৬ মার্চ দুপুর বেলা চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ নেতা এম এ হান্নান চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ বাদামতলী বেতার কেন্দ্র হতে প্রথমবারের মত স্বাধীনতার ঘোষণা হিসেবে বঙ্গবন্ধুর প্রেরিত বার্তা পাঠ করেন। পরে বেতার কর্মীরা নিরাপত্তার কারণে আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকায় অবস্থিত চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রকে কাজে না-লাগিয়ে শহর থেকে কিছু দূরে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে চলে যান এবং ২৬ মার্চ সন্ধ্যা ৭টা ৪০ মিনিটে সেখান থেকে প্রথম প্রচার করেন ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে বলছি।’ সে সময়ে এম এ হান্নান বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাটি আবার পাঠ করেন। প্রায় ১ ঘণ্টা অনুষ্ঠান করার পর তারা পরদিন সকাল ৭টায় পরবর্তী অনুষ্ঠান প্রচারের ঘোষণা দিয়ে সেদিনের পর্ব শেষ করেন।

এরপর তারা ২৭ মার্চ সকালে বেতার কেন্দ্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য পাহারা বসানোর উদ্দেশ্যে পটিয়ায় অবস্থানরত মেজর জিয়ার কাছে এ ব্যাপারে সাহায্য চাইতে যান। সেখান থেকে তারা জিয়াউর রহমানকে সাথে করে কালুরঘাট ফেরত আসেন। সেদিন অর্থাৎ ২৭ মার্চ রাত ৮টায় এক নতুন লিখিত ও সম্প্রসারিত বক্তব্যের মাধ্যমে মেজর জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন।

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন রণাঙ্গনে মুক্তিবাহিনীর যুদ্ধের খবর এবং পাকবাহিনীর হত্যা ও অত্যাচারের কাহিনী প্রচার করার পাশাপাশি পাকবাহিনীকে ধিক্কার ও বিদ্রূপ করে এম আর আখতার মুকুল রচিত ও পঠিত ‘চরমপত্র‘ প্রচার করত। এখানে তিনি পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর অসংলগ্ন অবস্থানকে পুরনো ঢাকার আঞ্চলিক ভাষার সংলাপে তুলে ধরতেন। চরমপত্রের পরিকল্পনা করেন আবদুল মান্নান। আরেকটি জনপ্রিয় অনুষ্ঠান জল্লাদের দরবার পরিচালনা করতেন কল্যাণ মিত্র। অনুষ্ঠানটিতে ইয়াহিয়া খানকে “কেল্লা ফতে খান” হিসেবে ব্যঙ্গাত্মক ভাবে ফুটিয়ে তোলা হত। “বজ্র কণ্ঠ” অনুষ্ঠানে শেখ মুতিবুর রহমানের ভাষণের অংশবিশেষ সম্প্রচার করা হত। বেতার কেন্দ্রে তরুণ শিল্পীরা দেশাত্মবোধক ও অনুপ্রেরণাদায়ক গান করতেন। যা অবরুদ্ধ দেশবাসী ও মুক্তিযোদ্ধাদেরকে দারুণভাবে উৎসাহিত করত। সেসকলে গানের মধ্যে কয়েকটি গান যেমন-

  • “জয় বাংলা, বাংলার জয়” গানটি এ বেতার কেন্দ্রের সূচনা সঙ্গীত হিসাবে প্রচারিত হতো।
  • আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি
  • কারার ঐ লৌহকপাট
  • মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে
  • শোন একটি মুজিবরের থেকে
  • তীর হারা এই ঢেউয়ের সাগর
  • পূর্ব দিগন্তে, সূর্য উঠেছে
  • এক সাগর রক্তের বিনিময়ে

Add a Comment