সামরিক শাসন জারি
পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি: কারণ, প্রভাব ও প্রেক্ষাপট
পাকিস্তানের ইতিহাসে সামরিক শাসন একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং বিতর্কিত বিষয়। দেশটি স্বাধীনতা লাভের পর থেকে তিনবার বড় ধরনের সামরিক শাসনের মুখোমুখি হয়েছে। সামরিক শাসনগুলো পাকিস্তানের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, এবং সামাজিক ক্ষেত্রে গভীর প্রভাব ফেলে এবং পূর্ব পাকিস্তানে বৈষম্য ও অধিকার হরণের অন্যতম কারণ হিসেবে কাজ করে। পাকিস্তানে সামরিক শাসনের কারণ, এর প্রভাব এবং বাঙালি জনগণের স্বাধীনতার পথে সামরিক শাসনের ভূমিকা সম্পর্কে বিস্তারিত জ্ঞান রাখা বিসিএস পরীক্ষার্থীদের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
১. সামরিক শাসনের পটভূমি
- রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা: পাকিস্তান স্বাধীনতার পর থেকেই রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার শিকার হয়। দেশটির প্রথম শাসনতন্ত্র ১৯৫৬ সালে গৃহীত হলেও, রাজনৈতিক বিভাজন এবং কেন্দ্রীয় সরকারের দুর্বলতা শাসন ব্যবস্থাকে অস্থিতিশীল করে তোলে।
- গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ব্যর্থতা: গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় বারবার ব্যর্থতার কারণে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করে শাসন ব্যবস্থা পরিচালনা শুরু করে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে অসমর্থন করে এবং নিজ হাতে শাসনক্ষমতা নেয়।
- পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্য: পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক বিভাজন ছিল স্পষ্ট। কেন্দ্রীয় সরকার সবসময় পশ্চিম পাকিস্তানের ওপর অধিক মনোযোগ দেয়ায় পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে ক্রমাগত ক্ষোভ বৃদ্ধি পায়।
২. প্রথম সামরিক শাসন (১৯৫৮-১৯৭১)
- আইয়ুব খানের সামরিক অভ্যুত্থান (১৯৫৮): ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে প্রথম সামরিক শাসন জারি হয়। প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা সামরিক আইন জারি করেন এবং কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই সেনাপ্রধান আইয়ুব খান ক্ষমতা দখল করেন। আইয়ুব খান নিজেকে প্রধান প্রশাসক ঘোষণা করেন এবং ১৯৬২ সালে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করেন।
- মৌলিক গণতন্ত্র: আইয়ুব খান গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া দুর্বল করে মৌলিক গণতন্ত্র নামে এককেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। এতে জনগণের ভোটাধিকার সীমিত হয়ে পড়ে এবং কেন্দ্রীয় সরকার পশ্চিম পাকিস্তানের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়।
- অর্থনৈতিক বৈষম্য ও পূর্ব পাকিস্তানের অবহেলা: আইয়ুব খানের শাসনামলে পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবহেলা করা হয় এবং পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের দাবি উপেক্ষা করা হয়। এর ফলে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের মধ্যে পাকিস্তানী শাসনের বিরুদ্ধে অসন্তোষ বৃদ্ধি পায়।
৩. দ্বিতীয় সামরিক শাসন (১৯৭৭-১৯৮৮)
- জেনারেল জিয়া-উল-হক এর অভ্যুত্থান (১৯৭৭): ১৯৭৭ সালে জেনারেল জিয়া-উল-হক দ্বিতীয় সামরিক শাসন জারি করেন। প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টোকে অপসারণ করে ক্ষমতা দখল করেন।
- ইসলামিক শাসন ব্যবস্থা: জিয়া তার শাসনামলে ইসলামিক আইন এবং শাসন ব্যবস্থা প্রণয়ন করেন এবং দেশের প্রশাসনিক কাঠামোতে ইসলামিক সংস্কার আনেন।
- গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিলুপ্তি: জিয়া তার ক্ষমতা শক্তিশালী করার জন্য গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্বল করেন এবং প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা বাড়িয়ে দেন। গণতন্ত্রের অভাবে রাজনৈতিক অধিকারগুলো বিলুপ্ত হয় এবং সেনাবাহিনী শাসনের প্রতি জনগণের আস্থা কমতে থাকে।
৪. তৃতীয় সামরিক শাসন (১৯৯৯-২০০8)
- জেনারেল পারভেজ মোশাররফের অভ্যুত্থান (১৯৯৯): ১৯৯৯ সালে তৃতীয় সামরিক শাসন শুরু হয়। মোশাররফ প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফকে অপসারণ করে ক্ষমতা গ্রহণ করেন এবং পাকিস্তানে আবার সামরিক শাসন জারি করেন।
- সন্ত্রাসবিরোধী লড়াই: ২০০১ সালের ৯/১১ হামলার পর মোশাররফ সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে জোটবদ্ধ হন। এর ফলে দেশটি বিদেশি চাপের মধ্যে পড়ে এবং অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংকটের সৃষ্টি হয়।
- ক্ষমতার কেন্দ্রীয়করণ: মোশাররফ তার শাসন ক্ষমতা কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রণ করেন এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় প্রভাব বিস্তার করেন। এর ফলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও গণতন্ত্রের প্রতি জনগণের বিশ্বাস হারিয়ে যায়।
৫. সামরিক শাসনের প্রভাব ও পরিণতি
- গণতন্ত্রের ক্ষতি: সামরিক শাসনের কারণে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বারবার বাধাগ্রস্ত হয় এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে।
- বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থান: সামরিক শাসন পূর্ব পাকিস্তানে শাসনব্যবস্থার প্রতি অসন্তোষ বাড়ায়। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে স্বায়ত্তশাসনের দাবি জোরালো হয়ে ওঠে।
- স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রভাব: সামরিক শাসন পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার আন্দোলনের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি পূর্ব পাকিস্তানের আস্থা হ্রাস পায়, যা ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের রূপ নেয়।
বিসিএস প্রস্তুতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন
১. ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে সামরিক শাসন কেন জারি হয়েছিল?
২. আইয়ুব খানের মৌলিক গণতন্ত্র ব্যবস্থা সম্পর্কে ব্যাখ্যা করুন।
৩. জিয়া-উল-হকের সামরিক শাসনের প্রভাব কী ছিল?
৪. পাকিস্তানে সামরিক শাসন বাংলাদেশের স্বাধীনতার আন্দোলনে কীভাবে প্রভাব ফেলেছিল?
৫. পাকিস্তানের সামরিক শাসনের প্রভাব ও পরিণতি বিশ্লেষণ করুন।
উপসংহার
পাকিস্তানের সামরিক শাসন বারবার গণতন্ত্রকে ব্যাহত করেছে এবং জনগণের স্বাভাবিক অধিকার ক্ষুণ্ণ করেছে। পূর্ব পাকিস্তানে বৈষম্য ও অবহেলা সামরিক শাসনের প্রতিক্রিয়ায় বাঙালির স্বাধীনতার আন্দোলনকে শক্তিশালী করে তোলে। এই শাসনব্যবস্থা প্রমাণ করে যে শাসনতান্ত্রিক ভারসাম্য ও গণতন্ত্র ছাড়া স্থিতিশীলতা এবং শান্তি অর্জন সম্ভব নয়। পাকিস্তানের সামরিক শাসনের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও প্রভাব জানলে বিসিএস পরীক্ষার্থীদের এই বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা লাভে সহায়তা হবে।
Related Posts
-
ড. মুহম্মদ ইউনুস
No Comments | Dec 6, 2017
-
সার্কভুক্ত দেশের স্বীকৃতি
No Comments | Jul 10, 2020
-
দেউলিয়া ঝুঁকি ও সম্পূর্ণ বাংলাদেশীয় ‘বেইল আউট’ সমাচার
No Comments | Jun 30, 2018
-
দিনাজপুর জেলা
No Comments | Oct 5, 2016