সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ
সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ: প্রতিষ্ঠা, ভূমিকা, এবং গুরুত্ব
বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে “সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ” একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের রাষ্ট্রভাষা নীতির বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনকে সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালনা করার জন্য এই পরিষদ গঠিত হয়। ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট এবং সংগ্রাম পরিষদের ভূমিকা সম্পর্কে বিসিএস পরীক্ষার্থীদের বিস্তারিত ধারণা থাকা গুরুত্বপূর্ণ।
১. সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট
- রাষ্ট্রভাষার প্রশ্ন: ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলে ভাষা নিয়ে সংকট শুরু হয়। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার একমাত্র উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার সিদ্ধান্ত নেয়, যা পূর্ব পাকিস্তানে বাংলাভাষী জনগণের মধ্যে তীব্র অসন্তোষের সৃষ্টি করে।
- সাংস্কৃতিক বৈষম্য: উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার সিদ্ধান্ত পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের সাংস্কৃতিক পরিচয়কে হুমকির মুখে ফেলে। এর প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা একত্রিত হয়ে আন্দোলনে নেমে পড়ে।
- অংশীদারিত্বের প্রয়োজন: ভাষা আন্দোলনকে সংগঠিত করার এবং সামগ্রিকভাবে পরিচালনার জন্য একটি সর্বদলীয় কমিটি গঠনের প্রয়োজন অনুভূত হয়। ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারির শুরুর দিকে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ প্রতিষ্ঠা করা হয়।
২. সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের গঠন ও উদ্দেশ্য
- গঠন: ভাষা আন্দোলনের বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন, রাজনৈতিক দল এবং সামাজিক সংগঠনের সমন্বয়ে এই সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। এর মধ্যে আওয়ামী মুসলিম লীগ, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ, তমদ্দুন মজলিশসহ অন্যান্য দল এবং সংগঠন এর সদস্য ছিল।
- লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য: সংগ্রাম পরিষদের মূল উদ্দেশ্য ছিল বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি আদায় করা। এ লক্ষ্যে, পরিষদ বিক্ষোভ মিছিল, ধর্মঘট এবং বিভিন্ন ধরনের আন্দোলন সংগঠিত করে।
৩. সংগ্রাম পরিষদের ভূমিকা ও কার্যক্রম
- ২১শে ফেব্রুয়ারির প্রস্তুতি: সংগ্রাম পরিষদ ২১শে ফেব্রুয়ারি একটি সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেয়। সেই সময় পরিষদের নেতারা জনগণের মধ্যে বাংলা ভাষার প্রতি ভালোবাসা ও রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ের দাবির পক্ষে জনমত তৈরি করেন।
- ছাত্রদের একত্রিতকরণ: সংগ্রাম পরিষদের নেতারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রদের একত্রিত করেন। এ সময় ছাত্ররা শান্তিপূর্ণভাবে নিজেদের দাবি জানাতে প্রস্তুতি নেয়।
- পুলিশের গুলিবর্ষণ এবং শহীদ দিবস: ২১শে ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সালের আন্দোলনের দিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে এক বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করা হয়। পুলিশ গুলি চালালে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ অনেকেই শহীদ হন। এই ঘটনা ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং স্মরণীয় অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত।
৪. সংগ্রাম পরিষদের প্রভাব ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব
- বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা: সংগ্রাম পরিষদের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানে বাংলা ভাষার অধিকার রক্ষায় ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে ওঠে। পরবর্তীতে পাকিস্তান সরকার সংবিধানে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করতে বাধ্য হয়।
- জাতীয় ঐক্য ও স্বাধীনতার চেতনা: সংগ্রাম পরিষদ শুধু ভাষার জন্য সংগ্রাম করেনি, বরং এটি বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে জাতীয় ঐক্য এবং স্বাধীনতার চেতনাকে আরও শক্তিশালী করেছে।
- বিশ্বজুড়ে মাতৃভাষার অধিকার রক্ষা: সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে পরিচালিত ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে মাতৃভাষার জন্য জীবন উৎসর্গের ঘটনা বিশ্বজুড়ে গুরুত্ব পায়। ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে, যা সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের অবদানের প্রমাণ বহন করে।
৫. বিসিএস পরীক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্য
- প্রতিষ্ঠা তারিখ: ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারিতে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ প্রতিষ্ঠিত হয়।
- পরিষদের প্রধান সংগঠন: আওয়ামী মুসলিম লীগ, তমদ্দুন মজলিশ, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগসহ বিভিন্ন ছাত্র ও রাজনৈতিক দল পরিষদে অন্তর্ভুক্ত ছিল।
- ২১শে ফেব্রুয়ারি ঘটনার সময়: এই দিন ছাত্রদের সংগঠিত করে বিক্ষোভ আয়োজন করা হয় এবং পুলিশের গুলিতে কয়েকজন ছাত্র নিহত হন। এই ঘটনাকে শহীদ দিবস হিসেবে পালন করা হয়।
- পরিষদের উদ্দেশ্য ও ফলাফল: বাংলা ভাষার রাষ্ট্রভাষা প্রতিষ্ঠা, পাকিস্তান সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি, এবং বাঙালির স্বাধিকার চেতনাকে উজ্জীবিত করা পরিষদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল।
বিসিএস প্রস্তুতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন
১. সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ কেন এবং কবে গঠিত হয়?
২. সংগ্রাম পরিষদের প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য কী ছিল?
৩. সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ কারা ছিলেন এবং তারা কীভাবে আন্দোলন পরিচালনা করেন?
৪. ২১শে ফেব্রুয়ারির ঘটনা এবং সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের ভূমিকা কী ছিল?
৫. সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ বাংলা ভাষার আন্দোলনে কীভাবে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছে?
উপসংহার
সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে একটি অমূল্য অধ্যায় হিসেবে স্থান পেয়েছে। এই পরিষদ বাংলাভাষী জনগণের ঐক্যের প্রতীক ছিল এবং এটি বাংলা ভাষার অধিকার আদায়ের সংগ্রামে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ভাষা আন্দোলনের এই সংগ্রাম পরবর্তী স্বাধীনতা আন্দোলনের মেরুদণ্ডে পরিণত হয়। বিসিএস পরীক্ষার্থীদের জন্য এই পরিষদের ভূমিকা, এর গুরুত্ব এবং এর দ্বারা প্রভাবিত ঘটনাগুলো সম্পর্কে জ্ঞান থাকা অতীব গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি বাংলাদেশের জাতীয় চেতনার একটি বড় অংশ।
Related Posts
-
বাংলাদেশে বিনিয়োগ
No Comments | Apr 24, 2018
-
বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা
No Comments | Jul 17, 2018
-
কোন জেলা কি উৎপাদনে বিখ্যাত
No Comments | Mar 5, 2019
-
সুশীল সমাজ
No Comments | Apr 15, 2018