মুক্তি ফৌজ গঠন
মুক্তি ফৌজ বা মুক্তিবাহিনী গঠন: বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রধান শক্তি
১৯৭১ সালের মার্চ মাসে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নির্যাতন ও অপারেশন সার্চলাইটের গণহত্যার পর বাঙালি জনগণের আত্মরক্ষার জন্য গঠন করা হয় “মুক্তি ফৌজ,” যা পরবর্তীতে “মুক্তিবাহিনী” নামে পরিচিত হয়। মুক্তিবাহিনীই ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য সংঘটিত মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সশস্ত্র শক্তি।
মুক্তি ফৌজ গঠনের প্রেক্ষাপট
- গণহত্যা ও পাকিস্তানি বাহিনীর অত্যাচার: ২৫ মার্চ ১৯৭১ সালে ঢাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাঙালিদের ওপর বর্বরোচিত গণহত্যা চালায়। এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের পরই স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র সংগ্রামের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়।
- বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা: ২৬ মার্চ ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণার পর দেশব্যাপী আন্দোলন বেগবান হয় এবং সাধারণ মানুষ স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
মুক্তি ফৌজ গঠনের সূচনা
- চট্টগ্রাম ও আশেপাশের অঞ্চল: স্বাধীনতার ঘোষণার পর পরই চট্টগ্রামে মেজর জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে এবং অন্যান্য নেতাদের সহায়তায় সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়। এই সময় স্থানীয় যুবক, ছাত্র, কৃষক, এবং অন্যান্য সাধারণ মানুষ এই বাহিনীতে যোগ দেন।
- আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য রাজনৈতিক দল: আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের জন্য দেশের বিভিন্ন প্রান্তে মুক্তি ফৌজ গঠন করা হয়। রাজনৈতিক নেতারা মানুষকে সংগঠিত করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের আহ্বান জানাতে থাকেন।
মুক্তিবাহিনীর কাঠামো
- নিয়মিত ও অনিয়মিত বাহিনী: মুক্তি ফৌজ গঠনের শুরুতে সাধারণ জনগণ, ছাত্র, কৃষক, এবং অন্যান্য শ্রেণির মানুষকে দলে নেওয়া হয়েছিল। পরবর্তীতে এটিকে আরও সংগঠিত করা হয়। নিয়মিত বাহিনী এবং অনিয়মিত বাহিনী হিসেবে এই বাহিনীকে ভাগ করা হয়।
- নিয়মিত বাহিনী: প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এবং সামরিক শৃঙ্খলাবদ্ধ যোদ্ধারা নিয়মিত বাহিনীতে থাকতেন, যারা সংগঠিতভাবে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই চালাতেন।
- গেরিলা বাহিনী: অনিয়মিত বাহিনী গেরিলা যোদ্ধা হিসেবে কাজ করতেন। তারা পাকবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, যানবাহন, এবং অন্যান্য অবকাঠামোতে আক্রমণ করে তাদের ক্ষতি সাধন করতেন। ঢাকায় অনেক ছাত্র নেতা এবং কর্মী গেরিলা বাহিনী হিসেবে কাজ করতেন।
মুক্তিবাহিনীর প্রশিক্ষণ ও সমর্থন
- প্রশিক্ষণ শিবির: ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে মুক্তিবাহিনীর প্রশিক্ষণ শিবির স্থাপন করা হয়। ভারত সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের সামরিক প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র সরবরাহে সহায়তা করে।
- মুজিবনগর সরকার: ১৭ এপ্রিল ১৯৭১ সালে মুজিবনগরে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। মুজিবনগর সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত এবং পরিচালনা করতে শুরু করে। মুক্তিবাহিনী এ সরকারের নেতৃত্বে কাজ করতে থাকে।
মুক্তি ফৌজের ভূমিকা
- সামরিক আক্রমণ: মুক্তি ফৌজ পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন আক্রমণ চালায় এবং তাদের কৌশলগত অবস্থানে আঘাত হানে। দেশব্যাপী পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার পথে এগিয়ে নেয়।
- গণমুক্তি: মুক্তি ফৌজ বা মুক্তিবাহিনী কেবল সামরিক বাহিনী নয়, এটি একটি জাতীয় প্রতিরোধ বাহিনীও ছিল। বাঙালিরা তাঁদের ভূমি, অধিকার, এবং স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের জন্য এই বাহিনীতে যোগ দেন।
উপসংহার
মুক্তি ফৌজ বা মুক্তিবাহিনী ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য এক ঐতিহাসিক প্রতিরোধের প্রতীক। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে এ বাহিনীর সশস্ত্র প্রতিরোধ ও আত্মত্যাগের মাধ্যমেই বিজয়ের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যন্ত এই বাহিনী দেশের বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ চালিয়ে যায়, যা অবশেষে ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের মাধ্যমে সাফল্যের চূড়ান্ত পরিণতি পায়।
4o
Related Posts
-
ইসলামী ব্যাংক
No Comments | Jan 16, 2019
-
সংবিধানের ষষ্ঠ সংশোধনী
No Comments | Dec 9, 2017
-
মুক্তিযুদ্ধকালীন বিশ্ব জনমত সৃষ্টি
No Comments | Oct 14, 2024
-
ইংরেজদের আগমন
No Comments | Sep 9, 2020