মুক্তিযুদ্ধ ও বহির্বিশ্ব
মুক্তিযুদ্ধ ও বহির্বিশ্ব: স্বাধীনতার সংগ্রামে আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল না শুধুমাত্র একটি অভ্যন্তরীণ স্বাধীনতা আন্দোলন; এটি বৈশ্বিক পর্যায়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। ১৯৭১ সালের এই যুদ্ধ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক শক্তি, সংবাদমাধ্যম এবং মানবাধিকার সংগঠনগুলোকে সরাসরি ও পরোক্ষভাবে প্রভাবিত করেছিল। বিভিন্ন দেশ ও বহির্বিশ্বের প্রতিক্রিয়া মুক্তিযুদ্ধের গতি এবং পরিণতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল।
মুক্তিযুদ্ধে বহির্বিশ্বের ভূমিকা
১. ভারত:
মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমদিকে ভারত কূটনৈতিকভাবে পাকিস্তানের সাথে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেছিল। কিন্তু পাকিস্তানের আক্রমণে সীমান্ত অঞ্চলে প্রচুর শরণার্থীর ঢল নামে এবং দেশের নিরাপত্তা ও মানবিক সমস্যার সম্মুখীন হয়। ডিসেম্বর মাসে ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধে অবতীর্ণ হয় এবং মিত্রবাহিনী গঠন করে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করে। ভারতের সরাসরি অংশগ্রহণে মুক্তিযুদ্ধের গতি ত্বরান্বিত হয় এবং শত্রু পক্ষকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করা সম্ভব হয়।
২. সোভিয়েত ইউনিয়ন:
সোভিয়েত ইউনিয়ন মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশপন্থী অবস্থান গ্রহণ করে এবং জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ভারতের পক্ষকে সমর্থন করে। তারা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের সামরিক অভিযান সমর্থন করে এবং একাধিকবার যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে আসা প্রস্তাবগুলোর বিপক্ষে ভেটো প্রদান করে। এর ফলে ভারতের পক্ষে কাজ করার জন্য কূটনৈতিক সহায়তা বৃদ্ধি পায় এবং পাকিস্তানের উপর চাপ বাড়ে।
- যুক্তরাষ্ট্র:
যুক্তরাষ্ট্র এই যুদ্ধের সময় পাকিস্তানের প্রতি সমর্থন জানায়। বিশেষত, প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ও হেনরি কিসিঞ্জারের নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা প্রদান করে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ কিছু ব্যক্তি, বিশেষ করে মার্কিন কূটনীতিক আর্চার ব্লাড, পাকিস্তানের মানবাধিকার লঙ্ঘন ও গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন। ১৯৭১ সালের “ব্লাড টেলিগ্রাম” নামে পরিচিত একটি টেলিগ্রামে ব্লাড এই সমস্যার কথা তুলে ধরেন। - চীন:
চীন ছিল পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ মিত্র, এবং সে কারণেই তারা পাকিস্তানের প্রতি সমর্থন জানায়। জাতিসংঘে চীনও পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নেয় এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী প্রস্তাব সমর্থন করে। তবে সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থন এবং ভারতের প্রভাবের কারণে চীন সরাসরি সামরিকভাবে হস্তক্ষেপ করতে পারেনি। - যুক্তরাজ্য:
যুক্তরাজ্যের সরকার যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়েছিল, তবে তাদের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে বিভক্তি ছিল। অনেক ব্রিটিশ নাগরিক এবং সংসদ সদস্য বাংলাদেশপন্থী অবস্থান নেন এবং গণহত্যার বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। এছাড়া ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমও মুক্তিযুদ্ধের খবর প্রচার করে এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে জনমত গঠন করতে সাহায্য করে। - আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম ও মানবাধিকার সংগঠন:
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম যেমন নিউইয়র্ক টাইমস, টাইম ম্যাগাজিন, গার্ডিয়ান ইত্যাদি মুক্তিযুদ্ধের গণহত্যা, ধর্ষণ এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের খবর প্রচার করে। এ ছাড়াও মানবাধিকার সংগঠনগুলো মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবিক সহায়তা ও সমর্থন প্রদান করে এবং বিশ্বব্যাপী জনমত গঠন করতে সহায়তা করে।
মুক্তিযুদ্ধ ও জাতিসংঘের ভূমিকা
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় জাতিসংঘে বিভিন্ন প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। পাকিস্তানপন্থী দেশগুলো যুদ্ধ বন্ধ করতে চেষ্টা করলেও সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেটোর কারণে তারা সফল হতে পারেনি। জাতিসংঘে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে যথেষ্ট সময় লাগে, তবে ভারতের প্রত্যক্ষ সহায়তায় এবং পাকিস্তানের পরাজয়ের পর বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিষয়টি ক্রমান্বয়ে দৃঢ় হয়।
বহির্বিশ্বের ভূমিকার গুরুত্ব
মুক্তিযুদ্ধে বহির্বিশ্বের প্রতিক্রিয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ভারতের সরাসরি সামরিক সহায়তা, সোভিয়েত ইউনিয়নের কূটনৈতিক সমর্থন, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের বিরোধিতা এবং ব্রিটেনের জনমত মুক্তিযুদ্ধকে বহুমুখী দিক দিয়েছে। বহির্বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিষয়ে আন্তর্জাতিক সচেতনতা তৈরি করে এবং নতুন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে সমর্থন করে।
বিসিএস প্রস্তুতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহ
বিসিএস, ব্যাংক ও অন্যান্য প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় মুক্তিযুদ্ধ ও বহির্বিশ্ব সম্পর্কিত প্রশ্নের উত্তর দিতে নিচের বিষয়গুলোর উপর ধারণা থাকা প্রয়োজন:
- ভারতের ভূমিকাসহ মিত্রবাহিনী গঠন ও সফলতা।
- সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান এবং জাতিসংঘে তাদের ভূমিকা।
- “ব্লাড টেলিগ্রাম” ও যুক্তরাষ্ট্রের আভ্যন্তরীণ অবস্থান।
- চীনের পাকিস্তানপন্থী ভূমিকা।
- জাতিসংঘের প্রস্তাব এবং তার প্রভাব।
- আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম ও মানবাধিকার সংস্থার ভূমিকা।
মুক্তিযুদ্ধের সময় বহির্বিশ্বের ভূমিকা সম্পর্কে বিস্তারিত জানার মাধ্যমে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সহজেই সংশ্লিষ্ট প্রশ্নের উত্তর দেয়া সম্ভব হবে। তাছাড়া এই জ্ঞান বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস সম্পর্কেও গভীর অনুধাবন প্রদান করবে।
Related Posts
-
বিপ্লবের ব্যর্থতার কারণ
No Comments | Oct 14, 2024
-
বাংলাদেশে প্রথম ব্যাংকিং
No Comments | Jan 2, 2019
-
আইন বিভাগ
No Comments | May 1, 2018
-
Environment of Bangladesh
No Comments | May 21, 2018