বাংলায় দ্বৈতশাসন

১৭৬৪ সালে বক্সার যুদ্ধের পর ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে লর্ড ক্লাইভ মোগল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের কাছ থেকে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানি অর্থাৎ রাজস্ব আদায়ের অধিকার লাভ করে। কোম্পানির পক্ষে লর্ড ক্লাইভ বাংলার নবাব নজম-উদ্-দৌলার সঙ্গে একটি চুক্তির দ্বারা স্থির করেন যে, নবাব ৫৩ লক্ষ টাকার বিনিময়ে নিজামত অর্থাৎ শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব গ্রহন করবেন এবং রাজস্ব আদায়ের অধিকার স্বয়ং কোম্পানির হাতে থাকবে অর্থাৎ নবাব পেল ক্ষমতাহীন দায়িত্ব এবং কোম্পানী পেল দায়িত্বহীন ক্ষমতা। এই ব্যবস্থা ইতিহাসে দ্বৈতশাসন নামে পরিচিত। ১৭৭২ সালে ওয়ারেন হেস্টিং গভর্নর হয়ে আসলে তিনি দ্বৈত শাসন ব্যবস্থার বিলুপ্তি ঘটান।


সরাসরি রাজস্ব আদায় করা কোম্পানির জন্য বিপদজনক হয়ে দেখা দেয়। কেননা সরাসরি কোম্পানি রাজস্ব গ্রহণ করলে বাংলায় বাণিজ্যরত অন্যান্য ইউরোপীয় বণিকদের সাথে তাদের সংঘর্ষ ছিল অনিবার্য। বিশেষ করে, বাণিজ্যিক শুল্ক আদায় ছিল দিউয়ানির কর্মকাণ্ডের অন্তর্গত। অন্য সব ইউরোপীয় কোম্পানিগুলো এদেশীয় সরকারকে শুল্ক দিতে রাজী থাকলেও ইংরেজদের শুল্ক দেয়ার কথা নয়। ফলে লর্ড ক্লাইভ কৌশলে দিউয়ানির সমস্ত শাসনভার নামমাত্র দিয়েছিলেন নবাবের উপর। আর কোম্পানির কাছে রাখা হয় কেন্দ্রিয়ভাবে তত্ত্বাবধানের ক্ষমতা।

এক্ষেত্রে নবাব প্রায় ক্ষমতাহীন থেকেও প্রায় সব দায়-দায়িত্ব পালন করতে থাকে। আর কোম্পানি কাগজে কলমে কোনো ক্ষমতা না রেখেও পুরো শাসন ক্ষমতা নিজের হাতে নিয়ে যায় এই দ্বৈতশাসন নীতির মধ্য দিয়ে। নবাব অনেক দায়িত্ব বহন করে শুধুমাত্র বৃত্তিভোগী হিসেবে নানা দুর্ভোগের শিকার হন।

প্রথমত, নবাব নাবালক হওয়ার অজুহাতে ক্লাইভ তাঁর অভিভাবক হিসেবে রাজস্ব বিশারদ সৈয়দ মুহম্মদ রেজা খানকে নিযুক্ত করেছিলেন। তাকে নায়েব নাজিম উপাধি দান করা হয়। পাশাপাশি বিহারের রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব দেয়া হয় রাজা সেতাব রায়কে। এরা কোম্পানির প্রতিনিধি বিশেষ দিউয়ান। তাদের উপাধি দেয়া হয় নায়েব দিউয়ান। কোম্পানির স্বার্থ রক্ষার্থে এরা রাজস্ব আদায় করত। কোম্পানির পক্ষ থেকে তাদের উপর নজর রাখা হয়। এজন্য মুর্শিদাবাদ দরবারে একজন ইংরেজ প্রতিনিধিও অবস্থান করত তখন।

দ্বৈত শাসন ব্যবস্থায় নানামুখী জটিলতার সৃষ্টি হয়। এক পর্যায়ে রেজা খান ভয়াবহ এক পরিস্থিতির সম্মুখীন হন। তখন তার প্রশাসন ভেঙ্গে পড়ে। পাশাপাশি স্থানীয় মানুষ নিদারুণ দুঃখ-দুর্দশার শিকার হয়। ১১৭৬ বঙ্গাব্দে (১৭৭০ খ্রি:) বাংলায় এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। ইতিহাসে এই দুর্ভিক্ষ ‘ছিয়াত্তরের মন্বন্তর’ নামে পরিচিতি পেয়েছে।

Add a Comment