বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও ঘটনাবলী

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও ঘটনাবলী

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। পাকিস্তানের শাসনের অবিচার ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষের স্বাধিকার অর্জনের জন্য এই মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাবলী ক্রমানুসারে নিচে বর্ণিত হলো:

১. পটভূমি ও প্রস্তুতি

  • ভাষা আন্দোলন (১৯৫২): পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর বাংলাভাষার ওপর নিষেধাজ্ঞা এবং উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বাঙালিরা তীব্র প্রতিবাদ করে। এই আন্দোলন বাঙালিদের মধ্যে স্বাধিকার চেতনার বীজ বপন করে।
  • ছয় দফা আন্দোলন (১৯৬৬): শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে এই আন্দোলন শুরু হয়, যা পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবি জানায়। এটি বাঙালিদের মধ্যে স্বাধীনতার চেতনাকে আরো শক্তিশালী করে।
  • অগ্নিঝরা একাত্তর: ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে, কিন্তু পাকিস্তান সরকার ক্ষমতা হস্তান্তর করতে অস্বীকৃতি জানায়।

২. মুক্তিযুদ্ধের সূচনা

  • ৭ মার্চের ভাষণ (১৯৭১): শেখ মুজিবুর রহমান রমনার রেসকোর্স ময়দানে স্বাধীনতার ডাক দেন। তিনি বলেন, “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।”
  • ২৫ মার্চের গণহত্যা: পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঢাকায় রাতের বেলায় বাঙালিদের ওপর আক্রমণ চালায়, যা “অপারেশন সার্চলাইট” নামে পরিচিত। ঢাকার বিভিন্ন স্থানে হত্যাযজ্ঞ চালানো হয় এবং এই দিনটিতে আনুষ্ঠানিকভাবে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা হয়।
  • ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা: শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে, মেজর জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন।

৩. মুক্তিযুদ্ধের ক্রমধারা

  • গেরিলা যুদ্ধ: মুক্তিযোদ্ধারা দেশের বিভিন্ন স্থানে গেরিলা আক্রমণ শুরু করে। “মুক্তিবাহিনী” নামে পরিচিত এই বাহিনী বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
  • মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন সেক্টর: মুক্তিযুদ্ধকে কার্যকর করতে বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয়। প্রতিটি সেক্টরের নেতৃত্বে ছিলেন দক্ষ সেনাপতিরা, যারা গেরিলা কৌশলে শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করতেন।
  • ভারতের সমর্থন: ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তায় এগিয়ে আসেন। ভারত মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেয় এবং অস্ত্র সরবরাহ করে।

৪. চূড়ান্ত যুদ্ধ ও বিজয়

  • ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ: ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী পশ্চিম সীমান্তে ভারত আক্রমণ চালায়, যার ফলে ভারত সরকার বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করে।
  • ঢাকা পতন: ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে ভারতীয় ও মুক্তিবাহিনীর যৌথ বাহিনী ঢাকায় প্রবেশ করে এবং পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। এই দিনটি বাংলাদেশে বিজয় দিবস হিসেবে পালিত হয়।

৫. মুক্তিযুদ্ধের পরিণতি

  • বাংলাদেশের স্বাধীনতা: মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশ একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
  • শহীদদের আত্মত্যাগ: মুক্তিযুদ্ধে প্রায় ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হন এবং লক্ষাধিক নারী নির্যাতনের শিকার হন। এই স্বাধীনতার জন্য বাংলাদেশের জনগণ অকল্পনীয় ত্যাগ স্বীকার করেন।
  • মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান: মুক্তিযোদ্ধাদের অবদানে জাতির মুক্তি সম্ভব হয়েছে, এবং তারা বাংলাদেশের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

উপসংহার

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ জাতির জন্য একটি গর্বের অধ্যায়। দীর্ঘ ন’মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর বাঙালিরা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র লাভ করে, যা তাদের সাংস্কৃতিক ও জাতিগত পরিচয়ের স্বীকৃতির পথ সুগম করে। মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা বাঙালি জাতির সাহস, আত্মত্যাগ, এবং ঐক্যের প্রতীক, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে এই স্বাধীনতাকামী চেতনাকে লালন করে যাবে।

4o

Add a Comment