প্রবাসী সরকার গঠন

প্রবাসী সরকার গঠন: মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বের ভিত্তি

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মম অত্যাচার এবং বাংলাদেশের জনগণের ওপর জুলুমের প্রতিবাদে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হয়। বাঙালি জাতির স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধ শুরু করার পর প্রবাসী সরকার বা অস্থায়ী সরকার গঠন করা হয়, যা বাংলাদেশ সরকারের প্রাথমিক কাঠামো হিসেবে কাজ করে এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্ব দেয়। এই সরকার গঠন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে আরও সুসংগঠিত এবং কার্যকর করে তোলে।

প্রবাসী সরকারের প্রেক্ষাপট

২৫ মার্চ, ১৯৭১ সালের কালরাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঢাকায় বাঙালির ওপর নারকীয় গণহত্যা চালায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দেন এবং বাঙালি জাতিকে মুক্তিযুদ্ধে আহ্বান জানান। পাকিস্তানি বাহিনীর গ্রেপ্তারের পর তিনি বন্দী হন, এবং এর পরেই দেশের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা ভারতের মুজিবনগরে একত্রিত হয়ে একটি প্রবাসী সরকার গঠন করেন, যা বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে থাকে।

মুজিবনগর সরকার গঠন ও এর সদস্যরা

১৭ এপ্রিল ১৯৭১ সালে ভারতের মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় (বর্তমানে মুজিবনগর) প্রবাসী সরকার শপথ গ্রহণ করে। এই প্রবাসী সরকারকে মুজিবনগর সরকারও বলা হয়। এই সরকারের মূল কাঠামো ছিল নিম্নরূপ:

১. রাষ্ট্রপতি: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, যাঁকে অনুপস্থিতিতে রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষিত হয়। 2. প্রধানমন্ত্রী: তাজউদ্দীন আহমদ, যিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় পুরো প্রবাসী সরকারের নেতৃত্ব দেন এবং পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। 3. অর্থ, শিল্প, ও যোগাযোগ মন্ত্রী: ক্যাপ্টেন মনসুর আলী। 4. বিদেশমন্ত্রী: খন্দকার মোশতাক আহমদ, যিনি বিভিন্ন দেশের সমর্থন অর্জনের প্রচেষ্টা চালান। 5. স্বাস্থ্যমন্ত্রী: এ এইচ এম কামরুজ্জামান।

প্রবাসী সরকারের দায়িত্ব ও ভূমিকা

প্রবাসী সরকার মূলত চারটি প্রধান দায়িত্ব পালন করেছিল, যা মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশকে একটি সংগঠিত রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সহায়ক হয়।

১. যুদ্ধ পরিচালনা:

  • প্রবাসী সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করে এবং যুদ্ধ পরিচালনার জন্য সেক্টর ভাগ করে। দেশকে ১১টি সেক্টরে বিভক্ত করা হয় এবং প্রতিটি সেক্টরের দায়িত্বে একজন সেক্টর কমান্ডার নিযুক্ত করা হয়।

২. আন্তর্জাতিক সমর্থন অর্জন:

  • প্রবাসী সরকার বিদেশে বিভিন্ন কূটনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করে এবং বিভিন্ন দেশের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করে।
  • বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রতি সমর্থন ও সমবেদনা জানাতে এই সরকার সক্রিয় ভূমিকা পালন করে।

৩. নাগরিক সেবা ও সংগঠন:

  • প্রবাসী সরকার দেশের অভ্যন্তরে থাকা জনগণের জন্য ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা করে এবং বিভিন্নভাবে তাদের সাহায্য করে।
  • শরণার্থীদের জন্য ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী শিবিরগুলির তদারকি করে এবং তাঁদের খাবার, চিকিৎসা, বাসস্থানসহ বিভিন্ন সেবা প্রদান করে।
  1. মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ও সমর্থন:
    • মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ প্রদানের জন্য প্রবাসী সরকার ভারতের সহায়তায় বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করে।
    • মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করে এবং যুদ্ধের প্রস্তুতি ও রণকৌশল নির্ধারণে প্রবাসী সরকার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

প্রবাসী সরকারের অবদান

প্রবাসী সরকারের সবচেয়ে বড় অবদান ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে একটি সংগঠিত কাঠামো প্রদান করা এবং বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে তুলে ধরা। তাদের উদ্যোগে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম আরও সুসংহত ও সংগঠিত হয়ে ওঠে। এছাড়াও প্রবাসী সরকার বাংলাদেশের জনগণের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দেয় এবং মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল দৃঢ় করে।

উপসংহার

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী সরকারের গঠন ছিল স্বাধীনতার পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। এই সরকার মুক্তিযুদ্ধকে আরও কার্যকর ও সংগঠিতভাবে পরিচালনা করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রতি সমর্থন অর্জনে সহায়তা করে। প্রবাসী সরকারের আত্মত্যাগ, নেতৃত্ব, এবং কার্যক্রম বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

Add a Comment