পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র
|পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র: পরিক্রমা ও প্রভাব
পাকিস্তানের শাসনতন্ত্রের ইতিহাস জটিল এবং সময়ের সাথে ক্রমাগত পরিবর্তিত হয়েছে। ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীন হওয়ার পর পাকিস্তান বিভিন্ন শাসনতান্ত্রিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয় এবং এর শাসনতন্ত্র বারবার পরিবর্তন ও সংশোধনের শিকার হয়। এই শাসনতান্ত্রিক বিবর্তনের ফলে পূর্ব পাকিস্তান বা বর্তমান বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও বৈষম্য বৃদ্ধি পায়, যা শেষমেশ ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে অবদান রাখে। বিসিএস প্রস্তুতির জন্য পাকিস্তানের শাসনতন্ত্রের ইতিহাস ও এর প্রভাব সম্পর্কে জানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
১. প্রথম শাসনতন্ত্রের প্রচেষ্টা ও গণপরিষদের গঠন (১৯৪৭-১৯৫6)
- ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতা: ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর পাকিস্তান একটি নতুন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। তবে দেশটির শাসনতন্ত্র ছিল না এবং নতুন শাসনতন্ত্র প্রণয়নের জন্য গণপরিষদ গঠন করা হয়।
- গণপরিষদের কাজ: ১৯৪৯ সালে গণপরিষদ ‘লাহোর প্রস্তাব’ ভিত্তিতে একটি শাসনতান্ত্রিক কাঠামো প্রণয়ন করতে কাজ শুরু করে। পাকিস্তানের ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক ধারণা এই সময়ে ওঠে।
- মক্কাহারাজ প্রস্তাব ও ধর্মনিরপেক্ষতার অভাব: গণপরিষদের প্রথম দিকের আলোচনায় ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনের ওপর জোর দেওয়া হয়, যা পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি নেতাদের আপত্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। পূর্ব পাকিস্তান বারবার ধর্মনিরপেক্ষ এবং গণতান্ত্রিক কাঠামোর দাবি জানায়।
২. ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্র: প্রথম শাসনতান্ত্রিক কাঠামো
- শাসনতন্ত্রের প্রবর্তন: ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম শাসনতন্ত্র গৃহীত হয়। এই শাসনতন্ত্র পাকিস্তানকে ‘ইসলামিক রিপাবলিক’ হিসেবে ঘোষণা করে।
- বৈশিষ্ট্য: এটি দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট আইনসভা গঠন করে এবং পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে প্রেসিডেন্ট পদ চালু করে।
- পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিনিধি সংখ্যা: এই শাসনতন্ত্র পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সমান সংখ্যক প্রতিনিধি নিশ্চিত করে, যা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে বৈষম্যের ধারণা তৈরি করে।
- সামরিক হস্তক্ষেপ: শাসনতন্ত্রের বাস্তবায়নে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের কারণে সামরিক বাহিনী শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ফলে শাসনতান্ত্রিক স্থায়ীত্ব বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়ে।
৩. ১৯৫৮ সালের সামরিক অভ্যুত্থান ও শাসনতন্ত্র বিলোপ
- আইয়ুব খানের সামরিক শাসন: ১৯৫৮ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আইয়ুব খান ক্ষমতা গ্রহণ করেন এবং ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্র বিলোপ করেন।
- মৌলিক গণতন্ত্র ব্যবস্থা: আইয়ুব খান মৌলিক গণতন্ত্র ব্যবস্থা চালু করেন, যার ফলে সাধারণ জনগণের ভোটাধিকার সীমিত হয়ে পড়ে।
৪. ১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্র
- আইয়ুব খানের শাসনতন্ত্র: ১৯৬২ সালে আইয়ুব খান নতুন শাসনতন্ত্র প্রবর্তন করেন। এটি পাকিস্তানকে প্রেসিডেন্টশাসিত রাষ্ট্র হিসেবে গঠন করে এবং মৌলিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে।
- পূর্ব পাকিস্তানের সাথে বৈষম্য: ১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্রেও পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের রাজনৈতিক অধিকার অবহেলিত হয়। কেন্দ্রীয় সরকার পশ্চিম পাকিস্তানের হাতে কেন্দ্রীভূত ছিল, যা পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি করে।
৫. ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন ও শাসনতান্ত্রিক সংকট
- ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন: এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। তবে পশ্চিম পাকিস্তান আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি করে, যা শাসনতান্ত্রিক সংকটের সৃষ্টি করে।
- মুক্তিযুদ্ধ ও শাসনতন্ত্রের পতন: শাসনতান্ত্রিক সংকটের কারণে পূর্ব পাকিস্তানে স্বাধীনতার দাবি আরও তীব্র হয়ে ওঠে। শেষমেশ ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে।
৬. শাসনতন্ত্রের পরিবর্তনের প্রভাব
- বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থান: পাকিস্তানের শাসনতন্ত্রের বারবার পরিবর্তন এবং পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের অধিকার উপেক্ষা বাঙালি জাতীয়তাবাদকে আরও শক্তিশালী করে।
- স্বাধীনতা আন্দোলনের উৎস: পাকিস্তানের শাসনতান্ত্রিক বৈষম্য এবং বাঙালিদের প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের অবহেলা স্বাধীনতার আন্দোলনের প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
বিসিএস প্রস্তুতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন
১. ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য ও সীমাবদ্ধতা কী ছিল?
২. আইয়ুব খানের মৌলিক গণতন্ত্র ব্যবস্থা কী এবং এর প্রভাব কী ছিল?
৩. ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল ও এর প্রভাব বিশ্লেষণ করুন।
৪. পাকিস্তানের শাসনতান্ত্রিক সংকট কীভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়?
৫. ১৯৫৮ সালের সামরিক অভ্যুত্থান কেন সংঘটিত হয় এবং এর পরিণতি কী ছিল?
উপসংহার
পাকিস্তানের শাসনতন্ত্রের বারবার পরিবর্তন ও সংশোধন প্রমাণ করে যে দেশটি গণতান্ত্রিক স্থায়ীত্ব বজায় রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। শাসনতান্ত্রিক বৈষম্য পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে বৈষম্যের অনুভূতি এবং স্বাধীনতার চেতনার উন্মেষ ঘটায়। বিসিএস পরীক্ষায় পাকিস্তানের শাসনতন্ত্রের এই বিবর্তন ও প্রভাব সম্পর্কে জানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।