পাকিস্তানের দ্বিতীয় শাসনতন্ত্র
|পাকিস্তানের দ্বিতীয় শাসনতন্ত্র: প্রেক্ষাপট, বৈশিষ্ট্য এবং প্রভাব
পাকিস্তানের দ্বিতীয় শাসনতন্ত্র, যা ১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্র হিসেবে পরিচিত, দেশটির রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্ব হিসেবে বিবেচিত হয়। ১৯৫৮ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের পর, প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান এই শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করেন। এটি পাকিস্তানের শাসনতান্ত্রিক কাঠামোতে পরিবর্তন এনে প্রেসিডেন্টশাসিত ব্যবস্থা প্রবর্তন করে এবং পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্য ও রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি করে। বিসিএস পরীক্ষায় পাকিস্তানের দ্বিতীয় শাসনতন্ত্র সম্পর্কে বিস্তারিত জানা প্রয়োজন, বিশেষ করে এর প্রেক্ষাপট, বৈশিষ্ট্য এবং প্রভাব সম্পর্কে।
১. প্রেক্ষাপট: দ্বিতীয় শাসনতন্ত্রের প্রণয়ন
- সামরিক শাসন ও আইয়ুব খানের ক্ষমতা গ্রহণ: ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে প্রথম সামরিক শাসন জারি হয় এবং সেনাপ্রধান আইয়ুব খান ক্ষমতা দখল করেন। ক্ষমতায় আসার পর আইয়ুব খান ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্র বাতিল করে দেন এবং দেশে সামরিক আইন চালু করেন।
- গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সংকট: পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার শিকার ছিল। আইয়ুব খান ক্ষমতায় এসে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে অবমাননা করেন এবং নিজ হাতে ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য নতুন শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করেন।
- পাকিস্তানকে একীভূত রাখার প্রচেষ্টা: আইয়ুব খান পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার অজুহাতে কেন্দ্রীভূত শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে ১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করেন।
২. দ্বিতীয় শাসনতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য
- প্রেসিডেন্টশাসিত ব্যবস্থা: ১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্র প্রেসিডেন্টশাসিত কাঠামো চালু করে, যেখানে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা ছিল খুবই শক্তিশালী। প্রেসিডেন্ট নির্বাহী প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন এবং সরকার পরিচালনার অধিকাংশ ক্ষমতা তার হাতে কেন্দ্রীভূত ছিল।
- মৌলিক গণতন্ত্র ব্যবস্থা: আইয়ুব খান গণতন্ত্রকে সীমিত করে একটি “মৌলিক গণতন্ত্র” ব্যবস্থা চালু করেন। এর মাধ্যমে সরাসরি সাধারণ ভোটের পরিবর্তে স্থানীয় কাউন্সিল ও নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতেন। এতে জনগণের সরাসরি ভোটাধিকার হারিয়ে যায়।
- দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট সংসদ: শাসনতন্ত্রে দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠন করা হয়। জাতীয় পরিষদ এবং প্রাদেশিক পরিষদ নামে দুইটি পরিষদ ছিল, যার সদস্যরা মৌলিক গণতন্ত্রের প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নির্বাচিত হতেন।
- পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্য: শাসনতন্ত্রে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি বৈষম্যপূর্ণ আচরণ লক্ষ্য করা যায়। জাতীয় পরিষদে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব সমানভাবে রাখা হয়, যদিও পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা পশ্চিম পাকিস্তানের চেয়ে বেশি ছিল।
৩. দ্বিতীয় শাসনতন্ত্রের প্রভাব
- গণতান্ত্রিক চেতনাকে সংকুচিত করা: আইয়ুব খানের শাসনতন্ত্র গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে সংকুচিত করে ফেলে এবং সামরিক শাসনের মাধ্যমে সরকারের ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করে। জনগণের অধিকার সীমিত করে মৌলিক গণতন্ত্র ব্যবস্থা কার্যত সামরিক শাসনের প্রতিফলন ঘটায়।
- পূর্ব পাকিস্তানে বৈষম্যের উদ্রেক: জাতীয় পরিষদে প্রতিনিধিত্বে বৈষম্য, অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবহেলা, এবং কেন্দ্রীয় সরকারের উপর নির্ভরশীলতার ফলে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে গভীর অসন্তোষ সৃষ্টি হয়।
- বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থান: শাসনতন্ত্রের বৈষম্যমূলক নীতি এবং কেন্দ্রীয় শাসনের প্রতি পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের অসন্তোষ ধীরে ধীরে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে শক্তিশালী করে। এর ফলে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ নিজেদের অধিকার রক্ষার জন্য সংগঠিত হয়ে ওঠে এবং স্বাধীনতার জন্য প্রচেষ্টা শুরু করে।
- শাসন ব্যবস্থার সংকট: এই শাসনতন্ত্র ক্ষমতার কেন্দ্রীভূতকরণ এবং সামরিক শাসনের প্রবল প্রভাবের মাধ্যমে শাসন ব্যবস্থাকে আরও জটিল করে তোলে। এর ফলে পাকিস্তানে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জন করা সম্ভব হয়নি।
৪. দ্বিতীয় শাসনতন্ত্রের পতন ও পরবর্তী ঘটনা
- গণবিক্ষোভ ও আইয়ুব খানের পতন: ১৯৬৮-৬৯ সালে আইয়ুব খানের শাসনামলের বিরুদ্ধে ব্যাপক গণবিক্ষোভ শুরু হয়। পূর্ব পাকিস্তানে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাঙালিরা স্বায়ত্তশাসনের দাবি জানায় এবং পশ্চিম পাকিস্তানে ছাত্র ও শ্রমিকরা বিক্ষোভে অংশ নেয়।
- ইয়াহিয়া খানের সামরিক শাসন: ১৯৬৯ সালে আইয়ুব খান পদত্যাগ করতে বাধ্য হন এবং ইয়াহিয়া খান সামরিক শাসন জারি করে ক্ষমতা গ্রহণ করেন। ইয়াহিয়া খান ১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্র বাতিল করে নতুন শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতিশ্রুতি দেন।
বিসিএস প্রস্তুতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন
১. ১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য কী ছিল?
২. মৌলিক গণতন্ত্র ব্যবস্থার কার্যকারিতা ও সীমাবদ্ধতা ব্যাখ্যা করুন।
৩. পাকিস্তানের দ্বিতীয় শাসনতন্ত্রের ফলে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থান কীভাবে ঘটেছিল?
৪. দ্বিতীয় শাসনতন্ত্রের ফলে পূর্ব পাকিস্তানে বৈষম্য কীভাবে বৃদ্ধি পায়?
৫. আইয়ুব খানের পদত্যাগ এবং ১৯৬৯ সালের গণবিক্ষোভের কারণ ও ফলাফল কী ছিল?
উপসংহার
১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্র পাকিস্তানের রাজনৈতিক ইতিহাসে সামরিক শাসনের প্রভাব এবং গণতান্ত্রিক চেতনার সংকোচনের উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হয়। এই শাসনতন্ত্র কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থার মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানে বৈষম্য সৃষ্টি করে এবং সামরিক শাসনের প্রতি জনমানুষের অসন্তোষ বৃদ্ধি পায়। এই শাসনতন্ত্রই পরবর্তীতে বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলনের পথ প্রশস্ত করে। বিসিএস প্রস্তুতির জন্য পাকিস্তানের দ্বিতীয় শাসনতন্ত্রের এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো সম্পর্কে জ্ঞান থাকা প্রয়োজন।