উর্দু ভাষা
|উর্দু ভাষা: ইতিহাস, বৈশিষ্ট্য এবং বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনে এর প্রভাব
উর্দু ভাষা পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা এবং ভারতের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষা। এটি ভারতীয় উপমহাদেশের সমৃদ্ধ সংস্কৃতির অংশ এবং ঐতিহাসিকভাবে বিভিন্ন সমাজ ও সম্প্রদায়কে সংযুক্ত করেছে। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর রাষ্ট্রভাষা হিসাবে উর্দু ভাষার প্রবর্তন, বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানে, ভাষা আন্দোলন এবং রাজনৈতিক উত্তেজনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এই প্রেক্ষাপটে বিসিএস পরীক্ষার্থীদের জন্য উর্দু ভাষার ইতিহাস, এর বৈশিষ্ট্য এবং ভাষা আন্দোলনে এর প্রভাব সম্পর্কে জানা প্রয়োজন।
১. উর্দু ভাষার ইতিহাস ও উৎপত্তি
- মুঘল আমল এবং উর্দুর বিকাশ: উর্দু ভাষার উৎপত্তি মুঘল আমলে ঘটে। এটি মূলত ফারসি, আরবি, তুর্কি এবং স্থানীয় হিন্দুস্তানি ভাষার সংমিশ্রণে গড়ে উঠেছে। দিল্লি ও উত্তর ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে উর্দু বিকাশ লাভ করে।
- উর্দু ও ফারসি সংযোগ: মুঘল দরবারে ফারসি ভাষার প্রভাব ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী, এবং ধীরে ধীরে ফারসি শব্দভাণ্ডার থেকে প্রভাবিত হয়ে উর্দু ভাষার গঠনশৈলী গড়ে ওঠে।
- উর্দুর প্রসার: মুঘল শাসনামলে উর্দু ভাষা উত্তর ভারতের সামাজিক এবং সাহিত্যিক ভাষা হিসেবে জনপ্রিয়তা লাভ করে। পরবর্তীতে ব্রিটিশ শাসনামলে এটি উত্তর ভারতের সরকারি ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
২. উর্দু ভাষার বৈশিষ্ট্য
- লিপি ও লিপ্যন্তর: উর্দু ভাষার লিপি আরবি বর্ণমালা থেকে উদ্ভূত। এটি ডান থেকে বাম দিকে লেখা হয়। উর্দুর মধ্যে ফারসি এবং আরবি শব্দের পাশাপাশি স্থানীয় শব্দের ব্যবহারের ফলে একটি মিশ্র সংস্কৃতি প্রতিফলিত হয়।
- ব্যাকরণ এবং শব্দভাণ্ডার: উর্দু ভাষার ব্যাকরণ বেশ জটিল এবং ফারসি ও আরবি ব্যাকরণের প্রভাব রয়েছে। এটি মূলত ফারসি-আরবির সম্মিলিত শব্দভাণ্ডার দ্বারা গঠিত।
- উর্দুর কাব্যিক বৈশিষ্ট্য: উর্দু সাহিত্যের বিশেষ করে কাব্যিক ধারা অত্যন্ত সমৃদ্ধ। উর্দু কবিতা, বিশেষত গজল, কাওয়ালী এবং শায়েরি আঙ্গিকের জন্য পরিচিত। এর সাহিত্যিক বৈশিষ্ট্য ভাষাটিকে একটি সৌন্দর্যমণ্ডিত রূপ দিয়েছে।
৩. পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুর প্রবর্তন
- পাকিস্তান সৃষ্টির পর ভাষা সংকট: ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর নতুন দেশের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুকে ঘোষণা করা হয়। পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতারা উর্দুকে একটি সাংস্কৃতিক ঐক্যের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন।
- বাঙালির বিরোধিতা: পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মাতৃভাষা বাংলা হওয়ায় তারা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মেনে নিতে আপত্তি জানান। তাদের যুক্তি ছিল, দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ বাংলা ভাষায় কথা বলে, তাই বাংলা রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত।
৪. ভাষা আন্দোলনে উর্দু ভাষার প্রভাব
- ভাষা আন্দোলনের শুরু: ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষণা করেন যে, “উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।” এই ঘোষণার পরই পূর্ব পাকিস্তানে আন্দোলন শুরু হয়, যা “ভাষা আন্দোলন” নামে পরিচিত।
- ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন: ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি ঢাকায় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ছাত্রদের একটি বড় আন্দোলন হয়। এই আন্দোলনে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ অনেক ছাত্র শহীদ হন। এই ঘটনা ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত।
- বাংলা ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা: ভাষা আন্দোলনের চূড়ান্ত ফলস্বরূপ ১৯৫৬ সালের পাকিস্তানের সংবিধানে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়া হয়। ভাষা আন্দোলন শুধু ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠাই করেনি, বরং এটি স্বাধীনতা আন্দোলনের ভিত্তিও তৈরি করেছিল।
৫. উর্দু ভাষার বর্তমান অবস্থান ও প্রভাব
- পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুর ভূমিকা: বর্তমানে উর্দু পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে রয়ে গেছে। এটি পাকিস্তানের জাতীয় ঐক্যের প্রতীক এবং রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
- উর্দু সাহিত্যের অবদান: উর্দু ভাষা বিশেষ করে সাহিত্য এবং সংস্কৃতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। উর্দু ভাষায় সাহিত্যকর্ম, কবিতা, গান এবং নাটকগুলির মধ্যে গভীরতা এবং বৈচিত্র্য রয়েছে, যা বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয়।
বিসিএস প্রস্তুতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন
১. উর্দু ভাষার উৎপত্তি ও ইতিহাস সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করুন।
২. মুঘল আমলে উর্দু ভাষার বিকাশ কেমন ছিল?
৩. কেন উর্দু ভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে নির্বাচিত করা হয়েছিল?
৪. উর্দু ভাষা পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রবর্তন কীভাবে ভাষা আন্দোলনের কারণ হয়ে ওঠে?
৫. ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে উর্দু ভাষার ভূমিকা কী ছিল?
উপসংহার
উর্দু ভাষা ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম সমৃদ্ধ ভাষা হিসেবে বিবেচিত হয়। তবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দু প্রবর্তন পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালির মাঝে ক্ষোভ ও আন্দোলনের জন্ম দেয়। এই ভাষা আন্দোলন শুধু বাংলা ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠাই করেনি, বরং বাংলাদেশ স্বাধীনতার আন্দোলনের ভিত্তি স্থাপন করেছিল। বিসিএস পরীক্ষার্থীদের উর্দু ভাষার এই ইতিহাস, বৈশিষ্ট্য এবং এর সাথে ভাষা আন্দোলনের সম্পর্ক সম্পর্কে গভীর ধারণা থাকলে, এটি তাদের পরীক্ষার জন্য বিশেষভাবে সহায়ক হবে।