শেষের কবিতা

উপন্যাসঃ শেষের কবিতা
লেখকঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

বাংলা সাহিত্যে শব্দশৈলী আর কাব্যকথনে যে সব্যসাচী সাহিত্যিক সাহিত্যের প্রতিটি পাতায় তার অনিঃশেষ ছাপ রেখে গিয়েছেন তিনি আমাদের কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর “শেষের কবিতা “উপন্যাসটি এক অনবদ্য সৃষ্টি। উপন্যাসের প্রতিটি দৃশ্যে প্রেমের উত্তাপ আবার কিছুদুর পথ হেটে যেতেই বয়ে যায় শৈত্য প্রবাহ। এমনই এক মিথস্ক্রিয়ার অপূর্ব সৃষ্টি তাঁর “শেষের কবিতা “।

নাঈম বুকস ইন্টারন্যাশনাল কর্তৃক প্রকাশিত বইটির প্রকাশকাল ১৯২৯। লেখা ও প্রকাশের দিক থেকে এটি কবিগুরুর ১০ম উপন্যাস। ১৯২৮ সালে এটি প্রবাসী পত্রিকায় ছাপা হয়। জীবনবোধের সাথে নবশিক্ষিত যুবকের প্রেমের এক অমানিশা সম্পর্কে জাল বুনে তিনি দেখিয়েছেন জীবনের বৈচিত্রতা।

উপন্যাসটিতে কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে রয়েছে প্রেমমনা রোমান্টিক যুবক অমিত রায়। প্রভাবশালী ধনী পরবারের সন্তান অমিত। ব্যারিস্টারি পড়তে তার বাবা তাকে বিলেতে পাঠায়। কিন্তু তার মধুর প্রেমময় চালচলনে সেখানে তার বন্ধুর চেয়ে বান্ধবীর সংখ্যা কিছুটা যেন বেশিই। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য চরিত্র কেতকী তার বোনের বান্ধবী। এসময় অমিতের প্রেমের সমুদ্রের তরী ভাসিয়ে রোমাঞ্চের আকাশে এক নতুন জীবন সঞ্চার করেছিল কেতকী। অমিতের দেওয়া আংটি ও পড়েছিল সে। রোমান্টিক যুবক অমিত ব্যারিস্টারি শেষ করে দেশে ফিরে পেশায় মনযোগ না দিয়ে বান্ধবীদের সাথে প্রেমলীলায় যেন একটু বেশি মজে যান। তার ক্ষনিক চঞ্চল মনে কারো দীর্ঘ বাসা যেন বাধাতেই পারেনা। মেয়েদের সাথে সম্পর্ক গড়তে আর ভাঙতে সে যেন সিদ্ধহস্ত।

একবার শিলং এ বেড়াতে গিয়ে একটা গাড়ির সাথে তার ধাক্কা লাগে। সে গাড়ি থেকে ঐ মুহুর্তে বেড়িয়ে আসে উপন্যাসের মূল নায়িকা লাবণ্য। তার বাবা অবিনাশ দত্ত কলেজের অধ্যক্ষ। মাতৃহীনা মেয়ে হিসেবে বাবার পরম স্নেহে লালিত মেয়েটি। উপন্যাসের অন্যদিকে আরেকটি উল্লেখযোগ্য চরিত্র অবিনাশ দত্তের ছাত্র শোভনলাল। শোভনলাল ও লাবণ্য সমবয়সী। সে লাবন্যকে ভালবাসত। কিন্তু এ ব্যাপারে লাবণ্যের কোন উৎসাহই নেই। কিন্তু হঠাৎ করে গাড়ি ধাক্কার ব্যাপারটা যেন লাবণ্যের মনেই ধাক্কা দিল। মনের কোণে ঠাঁই পেয়ে যায় অমিত। এগিয়ে যেতে থাকে তাদের প্রেম।

কিন্তু বিধি বাম! লাবণ্যে ধীরে ধীরে বুঝতে পারে অমিত অন্যজগতের মানুষ, এক রোমান্টিক যুবক। তার সঙ্গে জীবনের বাস্তব হিসেব চলে না। অপরদিকে লাবণ্যের এ দোদুল্যমান মনের মর্মমুলে দাগ কাটে হঠাৎ করে সেখানে কেতকীর আগমন। তার হাতে শোভা পাচ্ছে লাবণ্যের দেওয়া আংটি। শেষ পর্যন্ত অমিত স্বীকার করে, লাবণ্যের সাথে তার প্রেম ঝড়নার জলের মত, প্রতিদিন ব্যবহারের জন্য নয়। আর কেতকীর সাথে তার প্রেম কলসীতে তোলা জলের মত,যা প্রতিদিনের পানের উদ্দ্যেশে।

এভাবেই বিভিন্ন দোলাচলে ভাসতে ভাসতে উপন্যাসটা এক অন্য মাত্রায় পৌঁছে গিয়েছে। উপন্যাসটা সমাপ্তির পথে হেটেছে ও এক মর্মস্পর্শী কবিতা দিয়ে— “কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে কি পাও”। এ উপন্যাসের প্রারম্ভিকা থেকে যবনিকাপাত পর্যন্ত ভাষাশৈলী, চিন্তা,প্রেমের পরিণতি,চরিত্রের নিপুণ চিত্রায়ন সবকিছুতেই এক হৃদয়গ্রাহী ছোঁয়া আছে। অত্যন্ত রোমান্টিক সংলাপে পরিপূর্ণ এই উপন্যাসের প্রতিটি ধাপ। “ফ্যাশনটা হল মুখোশ স্টাইলটা মুখশ্রী “, “বিধাতার রাজ্যে ভাল জিনিস অল্প বলেই তা ভাল” ঠিক এমন কিছু সংলাপ উপন্যাসটাকে অনন্যতা দান করেছে।
পরিশেষে বলা যায়, কবিগুর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “শেষের কবিতা ” উপন্যাসটি উপন্যাসের সাহিত্যাকাশে এক মাইলফলক,যেখানে মনস্তত্বের বিভিন্ন দোলাচল আঁকা হয়েছে অত্যন্ত নিখুঁতভাবে।
সংগৃহীত

Add a Comment