আত্মজা ও একটি করবী গাছ

হাসান আজিজুল হকের উল্লেখযোগ্য একটি গল্পগ্রন্থ আত্মজা ও একটি করবী গাছ, এর কাহিনী সংক্ষেপে নিম্নরূপ-

সামান্য কয়েক পাতার গল্প, কাহিনি ভেঙে দেখতে চেষ্টা করলে দেখা যাবে সে অর্থে কোনো গল্পও নেই। এক সন্ধ্যার কয়েক ঘণ্টার অভিজ্ঞতা, এক মফস্বল শহরে—অথবা গ্রামে তিন অকালকুষ্মাণ্ড যুবকের সস্তায় ফুর্তি খোঁজার বিবরণ। ইনাম বেকার, ফেকু ছিঁচকে চোর আর সুহাস নাপিত। এক নির্দয় শীতের সন্ধ্যায় তারা চলেছে অজ্ঞাতনামা এক বৃদ্ধের বাড়িতে, তার কিশোরী কন্যাটির সাথে নিভৃতে সময় কাটাতে। মেয়েটি কেমন, তার বয়স কত, কিছুই আমরা জানি না, তবে যুবকদের একজনের নির্লজ্জ বর্ণনায় জানতে পারি, ‘এট্টু এট্টু সর হইছে এমন ডাবের মতো লাগে মেয়েডারে।’ জনপ্রতি এক টাকা, বড় ভাইয়ের পকেট হাতড়ে এনেছে একজন, আরেকজনের পকেট শূন্য, কাতরভাবে সে টাকা ধার চায় বন্ধুর কাছে, কিন্তু মেলে না। সামান্য সে অর্থ তুলে দিতে হবে শীর্ণকায়, পাণ্ডুর, প্রায় মৃত্যুমুখী সেই বৃদ্ধের হাতে। দেশভাগের পর সব খুইয়ে সপরিবারে তারা আশ্রয় পেয়েছে আলোহীন-আশাহীন এই গ্রামে। মাথা গোঁজার একটা ঠাঁই আছে বটে, কিন্তু দিনাতিপাতের কোনো অবলম্বন নেই। দেশভাগের আগে যে পেশা তার ছিল, এই গ্রামে তার কোনো ব্যবহার নেই। এক ধরনের মেকি অহংকারও আছে, কৃষিকাজ তার জানা নেই, বলে, ‘বাড়ির বাগান থেকে অন্ন জোটানো আমার কম্ম—হ্যাঃ। আমরা শুকনো দেশের লোক, বুইলে না?’ কোথায় যাবে সে, কার কাছে হাত পাতবে? অবশেষে ভর করতে হয় কিশোরী কন্যার ওপর। লজ্জা, ভীতি, ঘৃণা তার চেহারায়, গলার স্বরে। কিন্তু ক্ষুধার চেয়ে বড় শত্রু আর নেই—সে কোনো আব্রু মানে না, শিক্ষা মানে না, বয়স বা পদবির ওজন তার কাছে গ্রাহ্য হয় না। শুধু গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য নিজের কিশোরী কন্যাকে পণ্য করবে, তাই বা কীভাবে মেনে নেয় সে? বৃদ্ধ নিজেকে মিথ্যা আশ্বাস দেয় এই বলে, যুবকেরা মেয়েটির সঙ্গে গল্প করবে, আর কিছু নয়। ‘যাও তোমরা, কথা বলে এসো। উই পাশের ঘরে।’ হাত পেতে যে টাকাটা নেয়, তা কোনো পণ্যের বিনিময়ে পাওয়া নয়, ধার, নিজেকে প্রবোধ দেওয়ার মতো বলে। ‘আর কত যে ধার নিতে হবে তোমাদের কাছে! কবেই বা শুধতে পারব এইসব টাকা?’ বন্ধকি বিবেক, নিরুপায় পিতা। একমাত্র উদ্ধার মৃত্যুতে। বৃদ্ধ জানায়, সে একটি করবী গাছ লাগিয়েছে, ফুলের জন্য নয়, বিচির জন্য। ‘চমৎকার ফুল হয় করবী ফুলের বিচিতে।’ কথা বলে আর চোখের জলে সে ভাসে। ইনাম, টাকা নেই বলে ফুর্তি থেকে বঞ্চিত যুবকটি, তেতো গলায় বলে, ‘এ্যাহন তুমি কাঁদতিছ? এ্যাহন তুমি কাঁদতিছ?’

প্রথম আলো থেকে।

Add a Comment