শুয়রের বাচ্চাদের অর্থনীতি
|বুক রিভিউঃ শুয়রের বাচ্চাদের অর্থনীতি
লেখকঃ আকবর আলী খান
আকবর আলী খানের পরার্থপরতার অর্থনীতি বইয়ের একটা প্রবন্ধ “শুয়রের বাচ্চাদের অর্থনীতি”। এই প্রবন্ধে ড.খান মাইকেল স্কটকে কোট করে বলেছেন সরকারি কর্মচারীরা মূলত ৩ প্রকার।
- ভাল- যারা ঘুষ খায় না, কাজ করে।
- খারাপ- যারা ঘুষ খায় এবং কাজ করে।
- শুয়রের বাচ্চা- এরা ঘুষ খায় কিন্তু কাজ করে না।
এই প্রবন্ধে তিনি দুর্নীতির প্রকৃতি এবং অর্থনীতিতে দুর্নীতির প্রভাব কী তা নিয়ে আলোচনা করেছেন। একদম চাণক্য থেকে শুরু করে হালের অর্থনীতিবিদ সবার মত বিশ্লেষণ করেছেন।
তাদের মতামত দেখে মোল্লা নাসিরুদ্দীনের সেই গল্পটার কথা মনে পরলো। অর্থাৎ যদি কোন সমস্যা সমাধান না করতে পারো সেটা স্বীকার করো না বরং সমস্যাটাকেই নিয়ম বানিয়ে ফেল। ইতিহাসসেরা এই সব বাঘা বাঘা অর্থনীতিবিদগন একটা বিষয়ে একমত সেটা হল ঘুষ বন্ধ করা সম্ভব না। কেন বন্ধ সম্ভব না তা নিয়ে তারা বেশ রসালো ভাবে বলেছেন যা পড়লে যে কেউ চমৎকৃত হতে বাধ্য। যেমন চাণক্য ২০০০ বছর আগে বলেছেন,
জিহবার ডগায় বিষ বা মধু থাকলে তা না চেটে থাকা যেমন অবাস্তব তেমনি অসম্ভব হলো সরকারের তহবিল নিয়ে লেনদেন করে একটুকুও সরকারের সম্পদ চেখে না দেখা।
কিংবা,
জলে বিচরণরত মাছ কখন জল পান করে তা জানা যেমন অসম্ভব তেমনি নির্ণয় সম্ভব নয় কখন দ্বায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী তহবিল তছরুপ করে।
এখানেই শেষ না। পরের অর্থনীতিবিদ্গন আরো একধাপ এগিয়ে বলেছেন বরং ঘুষখোররাই ভাল! যেমন স্যামিয়ূল হ্যানিংটন,
“অতি কেন্দ্রীভূত সৎ আমলাতন্ত্রের চেয়ে অতি কেন্দ্রীভূত ঘুষখোর আমলাতন্ত্র ভাল”।
হালের অধুনিক অর্থনীতিবিদ্গন তো আরো অসাধারণ ঘুষকে অসৎ বলতেই রাজি নন। তাদের মতে,
“ঘুষ হল অলিখিত চুক্তি যা আদালতের মাধ্যমে কার্যকর করা সম্ভব না”
এবং,
“ঘুষ কোন দুর্নীতি নয়, ঘুষ হল স্পিড মানি”।
ড. খান এই ঘুষের কারণ কী এটা নিয়ে আলোচনা করেছেন। এ ব্যাপারে অর্থনীতিবিদ্গন দুই ভাগে বিভক্ত। প্রথম দল মনে করে দূর্নীতির মূল কারণ হল ব্যক্তির অপরাধ প্রবণতা, যা বন্ধে দরকার কঠিন আইন। এই দলের বিশেষজ্ঞের সংখ্যা বেশি না। দ্বিতীয় দল তথা সংখ্যাগরিষ্ঠ তারা মনে করেন দূর্নীতির মূল কারণ হল সরকারি কর্মচারীদের অপ্রতুল বেতন। তাদের মতে বেতন বাড়ানো হলে দুর্নীতি কমবে।
এখানে, দ্বিতীয় দলের মত সরকারি কর্মচারীদের অপ্রতুল বেতন ঘুষের মূল কারন এই তত্ত্বটি শুনতে যৌক্তিক মনে হয় তবে বাস্তবে কার্যকরিতা নেই। মার্কিন যুক্ত্ররাস্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং একজন বিধায়ক খুবই সামান্য টাকা ঘুষ নেবার জন্য ধরা পরেছিলেন। আমাদের দেশে কয়েক বছর আগে সরকারি কর্মচারীদের বেতন দ্বিগুণ করা হয়। কিছুদিন আগে অর্থমন্ত্রী বলেছেন বেতন বাড়ানোর পরেও দুর্নীতির পরিমাণ মোটেও কমেনি। একই অবস্থা অন্য দেশে গুলোর। তাই মার্কিন অর্থনীতিবিদ গরডন তুলক বলেছেন দ্বিতীয় দলের এই তত্ত্ব হল আপাত-স্ববিরোধী সত্য, তুলকের এই থিওরি Tullock Paradox নামে পরিচিত। অর্থাৎ, বেশি বেতন দিলেই যে দুর্নীতি বন্ধ হবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই।
প্রথম দলের মত “দুর্নীতি বন্ধে আইন” এটা সোনার পাথর বাটির মত। আইন দিয়ে আসলে অপরাধ বন্ধ করা সম্ভব না। আইন ক্ষমতাবানদের আটকাতে পারে না। উইল ডুরান্ট বলেন,
আইন হল মাকরশার জালের মত যা ছোট ছোট পতঙ্গদের আটকাতে পারে কিন্তু বড় পোকাদের ঠেকাতে পারে না
একই ধরনের কথা বলেছিলেন প্লেটো,
“ভাল মানুষদের দ্বায়িত্ববান করতে আইনের দরকার নেই। খারাপ মানুষ সব সময়ই আইনের ফাঁক বের করে ফেলে”।
আমাদের বাংলাদেশে এই মতের স্বপক্ষের চিত্রদেখি। আশা, গ্রামীণ ব্যাংক সহ নানা এনজিও গ্রামের দরিদ্র মানুষদের ২/৩ হাজার টাকা আদায়ের জন্য বাড়ির চাল খুলে নিয়ে যায়। কিন্তু শেয়ার বাজারের হাজার হাজার কোটি টাকা চুরি করা ব্যক্তিদের শাস্তি দেওয়া দূরে থাক, সরকারের মহা ক্ষমতাবান অর্থমন্ত্রী তাদের নাম বলতে পর্যন্ত বলতে ভয় পান।
তাহলে আমাদের উপায় কী ? এখানে ড. খানও জনৈক নেতার মত বলেছেন, ‘উন্নয়নের স্বার্থে এগুলো মেনে নিতে হবে’। সরকারি অফিসে ফাইলকে সচল রাখতে কিছুই করার নেই, ঘুষ দিতেই হবে। জনগণ তাহলে কি তাহলে সরকারের কিছুই প্রত্যাশা করতে পারবে না? হ্যাঁ, অবশ্যই পারবে। প্রত্যাশা নয় সরকারের কাছে দাবি করতে হবে। সেটা কী? ভিক্ষা চাইনা বাবা কুত্তা সামলাও। সরকার বাহাদুর! ঘুষ বন্ধ করতে হবে না। আপনি শুধুমাত্র এই শুয়োরের বাচ্চা শ্রেনীর কর্মকর্তা-কর্মচারীগুলোকে থামান। এই বাক্যের মাধ্যমে ড. খান এই প্রবন্ধের ইতি টেনেছেন।
কিন্তু কথা এখানেই শেষ না।
ছয়শ শতকের শুরুর দিকে আরবের হেজাজে ইসলামের পূর্ণ বিকাশ হয় । খুব অল্প সময়ের মধ্যে তারা প্রভাব বিস্তার করে দুনিয়ার সুপার পাওয়ার হয়ে যায়। ইসলামিক থিওলজি আধ্যাত্মিকার পাশাপাশি নিজস্ব প্রশাসন, বিচার বিভাগ, যুদ্ধনীতি এবং শিক্ষা ব্যবস্থার একটা ধারনা দেয়। তাদের সেই প্রশাসনের স্বরূপ কেমন ছিল, কিংবা সেই প্রশাসনে দুর্নীতি কেমন ছিল সে সম্পর্কে ড. খান কোন মন্তব্য করেন নি। বিস্ময়কর ভাবে আমরা দেখতে পাই মোটা দাগে ইসলামিক সভ্যতার প্রশাসনে এই সব বাঘা বাঘা অর্থনীতিবিদদের তত্ত্বগুলো একদম অকার্যকর। আমরা যদি ইসলামের পরমতম শাসক মুহাম্মাদ (সা.) বা খোলাফায়ে রাশিদার সময় বাদ দিয়েও বিশ্লেষণ করি ব্যাপারটি একই রকম থাকে। ১০০০ সালের দিকে আফগানিস্তানে সুলতান মাহমুদের শাসন আমলে মুসলিমদের জাকাত দেওয়ার মানুষ পাওয়া খুঁজে পেতে যথেষ্ট বেগ পেতে হতো। কয়েক সপ্তাহ বা মাস লেগে যেতো। শেষে না পেয়ে তারা গাছের ডালে একটা ব্যাগে টাকা ঝুলিয়ে রাখতো তাতে লেখা থাকতো, প্রিয় ভাই! আমি আপনাকে খুঁজে পাইনি। তাই এখানে টাকা রাখলাম, যদি আপনি সমস্যায় থাকেন কোন ইতস্তত না করে নিন। এমনও হয়েছে তিন মাস পর্যন্ত টাকা গাছে ঝুলানো থাকতো, কেউ নেই নি।
এখানে প্যারাডক্স হল, একদিকে পৃথিবীর সভ্যতা এবং শিক্ষা ব্যবস্থা এমন কিছু গ্রাজুয়েট বানাচ্ছে যারা সরকারি চাকুরিতে ঢোকার পর উচ্চ বেতন পায়, খুবই কম কাজ করতে হয়, অনেক সম্মান পায়। কিন্তু এরপরেও তারা তাদের সেই অল্প কাজ করতেও টাকা ঘুষ চায়। আবার টাকা নিয়েও কাজ করে না!
অন্যদিকে ইসলামিক শিক্ষা ব্যবস্থা এবং সমাজ ব্যবস্থা এমন কিছু মানুষ তৈরি করেছিলো যেখানে মানুষ দেখছে টাকা রয়েছে, তারা চাইলেই নিতে পারে, কেউ কিছু বলবে না, অথবা রাতে এসে নিলে কেউ দেখবেও না বা জানবেও না। এরপরেও কেউ নিতো না।
এখানে আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হল কিভাবে তারা এমন সমাজ, আমলাতন্ত্র বা শিক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করেছিলো তার একটা অর্থনৈতিক এবং সমাজ বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা। এবং কিভাবে আমরা সেই তত্ত্ব থেকে শিক্ষা গ্রহন করে আমাদের শিক্ষা বা আমলাতন্ত্রের উৎকর্ষতা বৃদ্ধি করতে পারি তার একটি প্রস্তাবনা।
From Facebook: Mir Salman Samil