BCS-Solution

রক্তাক্ত প্রান্তর নাটক

বর্তমান ভারতের হরিয়ানা প্রদেশের অন্তর্গত প্রাচীন যুদ্ধক্ষেত্র পানিপথ। ১৭৬১ সালে এ-পানিপথ প্রান্তরে সংঘটিত যুদ্ধই ইতিহাসে পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধ নামে অভিহিত। মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার শুরু থেকে গণনা করে এ-স্থানে সংঘটিত তৃতীয়তম যুদ্ধ বিধায় এ-যুদ্ধ ভারতের ইতিহাসে তৃতীয় পানিপথের যুদ্ধ নামে অভিহিত।

মুনীর চৌধুরী রক্তাক্ত প্রান্তর নাটকের বিষয়বস্ত্ত কায়কোবাদের মহাকাব্য মহাশ্মশান থেকে গ্রহণ করেছেন। কায়কোবাদ (প্রকৃত নাম মোহাম্মদ কাজেম আল কোরেশী) ১৭৬১ সালে সংঘটিত পানিপথের যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ১৯০৪ সালে এ অসামান্য মহাকাব্য রচনা করেন। মহাশ্মশান কাব্যটি তিন খন্ডের। প্রথম খন্ডে রয়েছে ১৯টি সর্গ, দ্বিতীয় খন্ডে ২৪টি সর্গ এবং তৃতীয় খন্ডে সাতটি সর্গ। বৃহদায়তন এ-কাব্যে ১৭৬১ সালে ভারতের পানিপথে সংঘটিত যুদ্ধে হিন্দু-মুসলিম উভয়পক্ষের শক্তিক্ষয়কেই মানবিক বিচারের দন্ডে তুলে ধরা হয়েছে। কায়কোবাদ এ-যুদ্ধকে উভয়পক্ষের শক্তিক্ষয়কে প্রধান মনে করেছেন বলেই সম্ভবত নামকরণ করেছেন মহাশ্মশান (বাংলাপিডিয়া, মহাশ্মশান অন্তর্ভুক্তি)।

ভারতীয় রাজনীতির ইতিহাসে পানিপথের যুদ্ধ অত্যন্ত তাৎপর্যমন্ডিত। বিশেষত তৃতীয় পানিপথের যুদ্ধ। ধর্মগত দ্বন্দ্ব, প্রতিহিংসা, সংঘাত দৃশ্যগত মূল হলেও নেপথ্যে উপনিবেশ শাসনের ভিত্তিসৃষ্টিই প্রধান রূপে দেখা যায়। ধর্মগত ও ক্ষমতায় এ নৃশংস বিধ্বংসী ঘটনা ভারতের ইতিহাসে বিরল। ইউরোপিয়ানরা পলাশী যুদ্ধের নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে এদেশীয় নবাবদের ইমেজ ক্ষুণ্ণ করতে সমর্থ হয় এবং নিজেদের একটি গ্রহণযোগ্য অবস্থানে নিয়ে শাসন-শোষণ, ব্যবসা-বাণিজ্য-আধিপত্যের পথ সুগম করে। পলাশী যুদ্ধের পরপরই ইউরোপিয়ানরা এদেশের ক্ষমতা গ্রহণ করেননি। অনেক তীক্ষ্ণ ও কুচক্রী দীর্ঘমেয়াদি জাল বিস্তার করেছে, যা এদেশের শাসকবর্গ কোনোভাবেই টের পাননি বা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি। ১৭৫৭ সালের মাত্র কয়েক বছর পর ১৭৬১ সালে অনুষ্ঠিত হয় পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধ। এমন ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ ভারতবর্ষে ইতোপূর্বে দেখা যায়নি। আপাত এ-যুদ্ধে মুসলমানগণ জয় এবং হিন্দু মারাঠা বাহিনী পরাজিত হলেও দীর্ঘমেয়াদি ফলাফল হিসেবে ভারতে মুসলিম-হিন্দু ক্ষমতা দুই-ই চিরদিনের জন্য শেষ হয়ে যায়, যা এর কয়েক বছর পর ১৭৬৪ সালে অনুষ্ঠিত বক্সারের যুদ্ধের মধ্য দিয়েই ভারতবাসী উপলব্ধি করতে পারে। বক্সারের যুদ্ধে ইউরোপিয়ানদের বিজয় ও কর্মচিত্র প্রমাণ করে পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধটি ছিল ভারতীয় মুসলিম-হিন্দুদের সমস্ত শক্তির ক্ষয়। এরপর আর ইউরোপিয়ানদের আধিপত্যের বিরুদ্ধে ভারতবাসী মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি।

রক্তাক্ত প্রান্তর নাটকের কাহিনিবিন্যাস এরকম – পানিপথের প্রান্তর। এপাশে বাগপথে মুসলিম শিবির, অন্যপাশে মারাঠাদের কুঞ্জুরপুর দুর্গ। দুপক্ষের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হবে যে-কোনো সময়। দুপক্ষেরই চলেছে যুদ্ধের প্রস্ত্ততি-পরিকল্পনা। মুসলমানদের পক্ষে নেতৃত্ব দিচ্ছেন কাবুলের অধিপতি আহমেদ শাহ আবদালি, রোহিলার নবাব নজীবুদ্দৌলা, অযোধ্যার নবাব সুজাউদ্দৌলা এবং মেহেদী বেগ-কন্যা জোহরা বেগম। অন্যদিকে মারাঠাদের পক্ষে নেতৃত্ব দিচ্ছেন বালাজি রাও পেশোয়া, ত্রিশূল বাহিনীর রঘুনাথ রাও, সদাশিব রাও এবং ইব্রাহিম কার্দি। মুসলিম পক্ষের জোহরা বেগমের স্বামী হিন্দুদের পক্ষের সেনাপতি ইব্রাহিম কার্দি। জোহরা বেগম বারবার ছদ্মবেশ ধারণ করে মারাঠা শিবিরে প্রবেশ করে স্বামী ইব্রাহিম কার্দিকে ফিরিয়ে আনার জন্য। কিন্তু ইব্রাহিম কার্দি নিজ সিদ্ধান্তে অনড়। আদর্শগত কারণেই জোহরা বেগমকে গভীরভাবে ভালোবাসলেও ফিরে আসতে নারাজ। কারণ ইব্রাহিম কার্দির যখন কোনো কর্মসংস্থান ছিল না তখন হিন্দু মারাঠাই তাকে চাকরি দিয়েছে এবং পদোন্নতিতে সেনাপতি বানিয়েছে। অতএব, মারাঠাদের বিপদের দিনে তাদের ফেলে সে চলে আসবে না। অন্যদিকে জোহরা বেগমও তার জায়গায় অনড়। হিন্দু-মুসলিম দুপক্ষই পরস্পরকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার আক্রোশে ক্রমশ ফেটে পড়ে। হঠাৎ করে অতর্কিত যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। অত্যন্ত ভয়ংকর ও বিধ্বংসী পরিণাম ঘটে। দুপক্ষে হতাহত ও মৃত্যু ভারতবর্ষের ইতিহাসের প্রতিহিংসা ও ক্ষমতা দখলের সমস্ত নৃশংসতাকে ছাড়িয়ে যায়। যুদ্ধে মুসলমানগণ জয়লাভ করে। মারাঠা বাহিনীর সেনাপতি ইব্রাহিম কার্দি ধৃত হয়। জোহরা বেগম ওই যুদ্ধের সর্বাধিপতি আহমেদ শাহ আবদালির কাছে স্বামী ইব্রাহিম কার্দির মুক্তি দাবি করে। সর্বসম্মতিক্রমে মুক্তির ফরমান নিয়ে জোহরা বেগম কারাগারে ইব্রাহিম কার্দিকে মুক্ত করতে গিয়ে দেখে ইব্রাহিম কার্দি মারা গেছে। ইব্রাহিম কার্দি ক্ষুদ্র মুক্তিকে অস্বীকার করে বৃহৎ মুক্তিকে গ্রহণ করেছে।

রক্তাক্ত প্রান্তর নাটকটির কাহিনিবিন্যাসে একদিকে যেমন যুদ্ধের ভয়াবহ পরিণতির মধ্যে দিয়ে যুদ্ধবিরোধী চেতনার বিকাশমুখী প্রবাহ প্রকাশ পেয়েছে, তেমনি প্রধান নারী চরিত্র জোহরা বেগমের জীবনে নেমে এসেছে নিয়তিনির্ভর পরিহাসে বিয়োগান্ত পরিণতি। আদর্শগত দ্বন্দ্বের কারণে ইব্রাহিম কার্দি মারাঠাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেনি। বিষয়বস্ত্ত, ঘটনা ইতিহাসনির্ভর। কল্পনার প্রাধান্যে প্রত্যুজ্জ্বল। মানবীয় আবেগ প্রস্ফুটিত। সম্ভবত সেজন্যেই নাট্যকার মুনীর চৌধুরী নিজেকে ইতিহাসের দাস না বলে নাটকের বশ বলে উল্লেখ করেছেন।

নাট্যকার মুনীর চৌধুরী বলেন, ‘যুদ্ধাবসানে পানিপথের প্রান্তরে অবশিষ্ট যে কয়টি মানব-মানবীর হৃদয়ের স্পন্দন অনুভব করি তাদের সকলে অবান্তর রণক্ষেত্রের চেয়ে ভয়াবহরূপে বিধ্বস্ত ও ক্ষতবিক্ষত। প্রান্তরের চেয়ে এই রক্তাক্ত অন্তরই বর্তমান নাটক রচনায় আমাকে বেশি অনুপ্রাণিত করেছে।’ (নাট্যকারের কথা)

মুনীর চৌধুরী ১৯৫৯ সালে নাটকটি রচনা করেন। মুনীর চৌধুরীর এ-ধরনের বিষয়কে বেছে নেওয়ার পেছনে সম্ভবত সমকাল প্রভাবিত করেছে। পাকিস্তান শাসনের সময় বিষয়বস্ত্ত ইসলাম ধর্মীয় না হলে সাধারণত গ্রহণযোগ্যতা কম পেত। জ্ঞানতত্ত্ব ও উপস্থাপনা সমস্তটাই ঔপনিবেশিক। এ-সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম কৌশলটি বিশ্লেষণের দাবি রাখে। সাম্প্রতিককালের নাট্যচর্চায়ও সেরূপ দেখা যায়। সাধারণত ব্রিটিশ কাউন্সিল থেকে পৃষ্ঠিত নাট্যগুলোর মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টিমূলক ও ইউরোপিয়ান জ্ঞানতত্ত্বনির্ভর নানা কৌশল বিদ্যমান থাকে। লোকমুখে যতটুকু জানা যায়, ব্রিটিশ কাউন্সিল আবার পৃষ্ঠিত এ-প্রযোজনাগুলোকে তারুণ্য বা আধুনিক বলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

১৯৬২ সালে মুনীর চৌধুরী নাট্যটি রচনার জন্য বাংলা একাডেমী পুরস্কার লাভ করেন। মুনীর চৌধুরীর নির্দেশনায় ১৯৬২ সালের এপ্রিলে ঢাকার ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউটে রক্তাক্ত প্রান্তর প্রথম মঞ্চস্থ হয়।

সংগ্রহঃ তুলু আর্ট- আবু সাঈদ তুলু(সংক্ষেপিত)

Exit mobile version