BCS-Solution

কবর নাটক

কবর নাট্যকারের দৃষ্টি-উন্মোচনকারী সৃষ্টি। এর প্রেক্ষাপট পূর্ব-পাকিস্তানের ভাষা-আন্দোলন। বিষয় এবং পরিবেশন-কৌশলের দিক থেকে নাটকটি গতানুগতিকতার বাইরে এক নবতর সংযোজন। জাতীয় চেতনার প্রতি প্রবল বিশ্বস্ততা আর মর্যাদা রক্ষায় প্রতিবাদ প্রকাশে এর ভূমিকা অপরিসীম। পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে কেবল উর্দুকে ঘোষণা করার পরিপ্রেক্ষিতে পূর্ব-পাকিস্তানে প্রতিবাদের যে ঝড় সৃষ্টি হয়েছিল, তার সাহিত্যিক ভাষারূপ বর্তমান নাটক। ভাষা-আন্দোলনের স্বপক্ষে কাজ করার অপরাধে মুনীর চৌধুরীকে কারাবরণ করতে হয়। ১৯৫২-১৯৫৪ সময়ে জেলখানায় থাকা-কালে বামপন্থী বিপ্লবী রাজনীতিবিদ রণেশ দাশগুপ্তের অনুরোধে, ১৯৫৩ সালে প্রথম ভাষাদিবস পালন উপলক্ষে পরিবেশনের জন্য তিনি রচনা করেন কবর নাটক। এবং এটি যথাসময়ে কারাকক্ষেই মঞ্চস্থ হয়।

আপাতভাবে ফরমায়েসি সৃষ্টি মনে হলেও এর কাঠামোয় রয়েছে শিল্পী মুনীরের মনে গেঁথে-থাকা অনুভবের প্রবল-প্রভাবি চিন্তার ছাপ। ভাষা-আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি বর্ষণে নিহতদের রাতারাতি কবর দেওয়ার জন্য, রাজনৈতিক হাঙ্গামা কৌশলে এড়ানোর জন্য, শাসকগোষ্ঠী ছিন্নভিন্ন মৃতদেহগুলিকে পুঁতে ফেলতে চাইলে ইসলাম ধর্মের রীতিবিরোধী বলে গোর-খুঁড়েরা আপত্তি তোলে; আর বারুদের গন্ধ থাকায় এ লাশ কবর দেওয়া উচিৎ হবে না বলে মত দেয় মুর্দা ফকির। এমতাবস্থায় বিপাকে পড়ে দায়িত্বে থাকা পুলিশ অফিসার এবং নেতা। পুলিশ-অফিসারের নির্মোহতা এবং নেতার অতিরিক্ত মদ্যপানজনিত ভারসাম্যহীনতা ও ভীতির পরিবেশে নাটকের আবহ প্রলম্বিত হয়; লাশগুলি সমবেতভাবে প্রতিবাদ জানায়- ‘আমরা কবরে যাবো না। আমরা বাঁচবো।’ এই হলো কবর নাটকের মূল পরিসর।

এই ক্যানভাসে নির্মিত হয় সংলাপ ও পরিবেশের সমূহ কলা-কৌশল। কাহিনিতে প্রবেশ করে পূর্বাপর আবহের আলো-আঁধার। নাটকের আবহে লাশগুলি জীবিতের ভূমিকায় অবতীর্ণ। কথোপকথনে তাদের অংশগ্রহণ আর তাদের প্রতিবাদের বাস্তব অবস্থা পাঠককে প্রকৃত ঘটনার কাছাকাছি নিয়ে দাঁড় করায়। নেতা ও পুলিশ-ইন্সপেক্টর তাদেরকে বুঝানোর চেষ্টা করে, ভয় দেখায়, আস্বস্ত করতে চায়; কিন্তু তারা নাছোরবান্দা। কাহিনিটিতে ক্ষমতাসীন সরকারের প্রতিনিধিদের আচরণ এবং ভাষা-ঐতিহ্য-মর্যাদা রক্ষাপ্রত্যয়ী জনতা-প্রতিনিধির ভূমিকা চিত্রিত হয়েছে একটি সমাজ-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক বাস্তব পরিস্থিতির পেক্ষাপটে। নামহীন নেতার নির্মমতা-বিশ্বাসঘাতকতা-মিথ্যাচারিতা আর ক্ষমতার প্রতি অপরিসীম লোভ- এই কথামালা সাজানো হয়েছে তৎকালীন রাজনীতির নোংরা রূপ তুলে আনার প্রয়াসে। নেতার দমননীতির একটি ছবি এখানে উদ্ধৃত করা যেতে পারে-‘পুঁতে ফেল। দশ-পনেরো বিশ-পঁচিশ হাত- যত নিচে পারো। একেবারে পাতাল পর্যন্ত খুঁড়তে বলে দাও। পাথর দিয়ে, মাটি দিয়ে, ভরাট করে গেঁথে ফেল। কোনদিন যেন আর ওপরে উঠতে না পারে। কেউ যেন টেনে ওপরে তুলতে না পারে, যেন চ্যাঁচাতে ভুলে যায়।’

প্রগতিশীল চিন্তার লালনকারী নাট্যকার মুনীর তাঁর নাটকে মানবতাবাদী ভাবনার প্রকাশ দেখাতে চেয়েছেন; পেরেছেনও। রক্ষণশীলতা আর প্রগতিশীলতার যে দ্বন্দ্ব, তা তিনি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন আপন অনুভবের শক্তিতে। পরাক্রমশালী রাজনীতির দৌরাত্ম্য ও অসহায়তা এবং আদর্শবাদী চিন্তাধারার মাহাত্ম্য রচিত হয়েছে নাটকটির সংলাপের চমৎকারিত্বে ও আভিজাত্যে। রাজনৈতিক প্রতাপ, অহমিকা, জনগণের নাম করে নিজেদের উদরপুর্তি আর দায়িত্বের (ক্ষমতার নয়) অপপ্রয়োগ যে জাতিগতভাবে হীনমন্যতাকে লালন করে, তার বাস্তব চিত্র মুনীর নির্মাণ করেছেন। প্রসঙ্গত, সংলাপের অতি জরুরি অংশবিশেষ দেখে নেওয়া যাক-“নেতা : দেখ ছেলে, আমার বয়স হয়েছে। তোমার মুরব্বিরাও আমাকে মানে। বহুকাল থেকে এ দেশের রাজনীতি আঙ্গুলে টিপে টিপে গড়েছি, শেপ দিয়েছি। কওমের বৃহত্তর রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের, বলতে পার, আমিই একচ্ছত্র মালিক। কোটি কোটি লোক আমার হুকুমে ওঠে বসে। মূর্তি : কবরে যাব না। নেতা: আগে কথাটা ভালো করে শোন। তুমি বুদ্ধিমান ছেলে, শিক্ষিত ছেলে। চেষ্টা করলেই আমার কথা বুঝতে পারবে। বিশ্ববিদ্রালয়ের সব চেয়ে উঁচু ক্লাসে উঠেছ। অনেক কেতাব পড়েছ। তোমার মাথা আছে। মূর্তি : ছিল। এখন নেই, খুলিই নেই। উড়ে গেছে। ভেতরে যা ছিল, রাস্তায় ছিটকে পড়ে নষ্ট হয়ে গেছে। নেতা : জীবিত থাকতে তুমি দেশের আইন মানতে চাওনি। মরে গিয়ে তুমি এখন পরপারে কানুনকেও অবজ্ঞা করতে চাও। কম্যুনিজমের প্রেতাত্মা তোমাকে ভর করেছে, তাই মরে গিয়েও এখন তুমি কবরে যেতে চাও না। তোমার মত ছেলেরা দেশের মরণ ডেকে আনবে। সকল সর্বনাশ না দেখে বুঝি কবরে গিয়েও শান্ত থাকতে পারছো না। তোমাকে দেশের নামে, কওমের নামে, দ্বীনের নামে যারা এখন মরেনি, তাদের নামে মিনতি করছি- তুমি যাও, যাও, যাও। মূর্তি : আমি বাঁচবো। নেতা : কি লাভ তোমার বেঁচে? অশান্তি ডেকে আনা ছাড়া তোমার বেঁচে কি লাভ? তুমি বেঁচে থাকলে বারবারদেশে আগুন জ্বলে উঠবে, সব কিছু পুড়িয়ে ছারখার না করে সে আগুন নিভবে না। তার চেয়ে লক্ষী ছেলের মত কবরে চলে যাও। দেখবে দু’দিনেই সব শান্ত হয়ে যাবে। দেশের সুখ ফিরে আসবে। (মূর্তি মাথা নাড়ে) আমি ওয়াদা করছি তোমাদের দাবী অক্ষরে অক্ষরে আমরা মিটিয়ে দেবো। তোমার নামে মনুমেন্ট গড়ে দেবো। তোমার দাবী এ্যাসেম্বীলিতে পাশ করিয়ে নেবো। দেশ জোড়া তোমার জন্য প্রচারের ব্যবস্থা করবো। যা বলতে তাই করবো।”

নাটকটিকে বর্ণিত কেরানি মূর্তির অভিজ্ঞতা থেকে পাঠক জানতে পারেন, নেতা বারবার ওয়াদা ভঙ্গ করেন; কথা দিয়ে কথা রাখেন না। মিথ্যাবাদী। দাবী আদায়ের কর্মসূচিকে নস্যাৎ করার জন্য নেতা অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়ে পরবর্তীকালে সে কথা ভুলে যান। এ চিত্রাবলির মাধ্যমে নাট্যকার জাতীয় নেতাদের চরিত্রবৈশিষ্ট্য আঁকতে চেয়েছেন। আর পলিটিক্যাল পার্টির নেতৃবৃন্দের অভিপ্রায়-স্বার্থপরতা-নির্মমতা বাস্তবায়নের জন্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনির সদস্যরা কীভাবে নির্লজ্জের মতো সহায়তা করে, তার স্বরূপ অঙ্কনের জন্য পুলিশ ইন্সপেক্টর হাফিজের ভূমিকা উপস্থাপন করেছেন। সরকারের ভক্ত-দায়িত্বশীল কর্মচারী হিসেবে, হঠকারিতা-কৌশলে পারদর্শী অফিসার রূপে পুলিশের আত্মকেন্দ্রিকতা ও তোষামোদি মানসিকতাকে প্রকাশ করেছেন নাট্যকার। হাফিজের অভিব্যক্তি- ‘পাকিস্তান হবার পর আমরা পেটি-অফিসাররাই কেবল কিছু পেলাম না। বৃটিশ আমলেও সমাজে মিশতে পারিনি। পাকিস্তানের জন্য এত ফাইট করে, আমাদের এখনও সেই দশা। যদি আপনারাও আমাদের দিকে ফিরে না তাকান আমরা বাঁচবো কি করে? আমাদের ত কোন রাজনীতি নেই স্যার! সরকারই মা-বাপ। যখন যে দল হুকুমত চালায় তার হুকুমই তামিল করি।’

আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার সাথে পুলিশের ছলনা-নিবেদন, মিথ্যাচার, আর প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের সাথে ব্যক্তিত্বহীন আচরণকে পরিবেশন করতে গিয়ে লেখক হাস্য-কৌতুকের আশ্রয় গ্রহণ করেছেন। নাটকের গতি আর রস নির্মাণে মুনীর চৌধুরী অত্যন্ত সচেতন ছিলেন বলেই সিরিয়াস বিষয়কে হালকাভাবে উপস্থাপন করতে পেরেছেন। প্রশাসনের মানবিক দুর্বলতা আর শোষন-পীড়ন নীতির প্রতি নাট্যকারের স্পষ্ট ইঙ্গিত কাহিনির গতিময়তাকে ত্বরান্বিত করেছে বলে ধারণা করা যায়। এ নাটকে মূর্দা ফকির চরিত্রটির মধ্য দিয়ে মুনীর চৌধুরী প্রতিক্রিয়াশীলতার বিপরীতে সত্য জীবনবোধকে আলোকিত করতে চেয়েছেন। প্রতীকি অর্থে ফকির জাতির জাগ্রত বিবেক। অমানবিকতার প্রবল প্রবাহে লোকটি মানবিকতা-নামক প্রবণতার একাকি ধারক ও বাহকের ভূমিকায় অবতীর্ণ। হাফিজের জবানিতে নাট্যকার জানাচ্ছেন ফকিরের অবস্থান ও চরিত্র-স্বরূপ- ‘লোকটা এমনিতে ভাল লেখা-পড়া জানে। ভাল আলেম। গ্রামের স্কুলে মাস্টারী করত। তেতাল্লিশে দুর্ভিক্ষে চোখের সামনে ছেলে-মেয়ে-মা-বৌকে মরতে দেখেছে। কিন্তু কাউকে কবরে যেতে দেখেনি। মুর্দাগুলো পচেছে। শকুনের খুবলে দিয়েছে। রাতের বেলায় শেয়াল এসে টেনে নিয়ে গেছে। সেই থেকে পাগল। গোরস্থান থেকে কিছুতেই নড়তে চায় না। বলে, মরে গেলে কেউ যদি কবর না দেয়। মরার সময় হলে, কাছাকাছি থাকব, চট করে যাতে কবরে ঢুকে পড়তে পারি। বড় ট্র্যাজিক স্যার।’

রাজনৈতিক-সামাজিকভাবে অস্থির এই সমাজ-ব্যবস্থায় সর্বহারা মানুষগুলি যে জীবনবাদী-জাগরণী আচরণে উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠে, তারই বাস্তব রূপায়ন এই ফকির। না-পাবার যাতনা আর অসম রাষ্ট্রকাঠামোর নির্মম শিকার সে। নিরাপত্তা নামক বিষয়াবলির সাথে, আন্তরিকতা-সহমর্মিতা নামক বোধের সাথে তার পরিচয় নেই। সে কেবল দেখেছে বর্বরতা-প্রতিহিংসা আর অসহযোগিতার প্রবল ছোবল। বাহ্যিক-বিশ্লেষণে মনে হতে পারে, নাটকটির ঘটনা-পরম্পরা ও চিত্রায়ন চিরন্তন কোনো অনুভবের সত্যকে হয়তো ধারণ করে না; সমসাময়িক রাজনৈতিক সংকটকে কেবল উপস্থাপন করে। কিন্তু বাস্তবে, বিশ্ব-পরিসরে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক অনিরাপত্তার পেক্ষাপটে এই নাটকটির প্রাসঙ্গিকতার কথা অস্বীকার করা চলে না।

সংগ্রহঃ সাম হয়ার ইন ব্লগ- মোঃ মুশফিকুর রহমান

Exit mobile version