ভাই গিরিশচন্দ্র সেন

বিগত সালের BCS Preliminary- তে এখান থেকে প্রশ্ন এসেছে টি।

ভাই গিরিশচন্দ্র সেন বর্তমান নরসিংদী জেলার পাঁচদোনা গ্রামে এক বিখ্যাত দেওয়ান বৈদ্যবংশে জন্মগ্রহণ করেন। গিরিশচন্দ্র সেন (জন্ম: ১৮৩৪ – মৃত্যু: ১৯১০)। ভাই গিরিশচন্দ্র সেন নামে তিনি অধিক পরিচিত। তাঁর প্রধান পরিচয় ইসলাম ধর্মের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কুরআন- এর প্রথম বাংলা অনুবাদক হিসেবে। (10তম বিসিএস প্রিলিমিনারি) তখন প্রায় ধর্মগ্রন্থ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণা ছিল যে, মূলভাষা থেকে অনূদিত হলে গ্রন্থটির পবিত্রতা ক্ষুণ্ন হবে। পবিত্র কুরআন সম্পর্কেও এমন ধারণা ছিল। এ কারণে অনেক মুসলিম মনীষী এর বঙ্গানুবাদ করতে সাহস পাননি। গিরিশচন্দ্র সেনই অন্য ধর্মালম্বী (ব্রাহ্ম)হয়েও এই ভয়কে প্রথম জয় করেন। শুধু কুরআন শরীফের অনুবাদ নয় তিনি ইসলাম ধর্ম বিষয়ক অনেক গ্রন্থ অনুবাদ করেন। তিনি ইসলাম ধর্ম নিয়ে অনেক গবেষণাও করেন।

তিনি আরবি ও ফার্সি ভাষা শিক্ষা করেন। কর্ম জীবনের শুরুতে তিনি ময়মনসিংহ জিলা স্কুলে শিক্ষকের (দ্বিতীয় পন্ডিত) পদে যোগদান করেন। কিন্তু গিরিশচন্দ্র সামান্য এক চাকরির মাঝে নিজেকে আবদ্ধ করে রাখতে পারলেন না। তাঁর ছিল জ্ঞানের পিপাসা। তিনি নিজে নিজেই পড়াশোনা শুরু করলেন। সাংবাদিকতা ও সাহিত্যচর্চাও শুরু করলেন গিরিশচন্দ্র। তৎকালীন ঢাকা থেকে প্রকাশিত ‘ঢাকা প্রকাশ’ পত্রিকায় তিনি ময়মনসিংহের সংবাদদাতা ছিলেন। তাছাড়া এই পত্রিকায় তাঁর অনেকগুলো লেখাও প্রকাশিত হয়েছিল।

ব্রাহ্ম ধর্মের দীক্ষালাভ
চাকরি ছেড়ে দিয়ে গিরিশচন্দ্র কলকাতায় গমন করেন। কলকাতায় যাওয়ার পর তাঁর সাথে দেখা হয় রাজা রামমোহন রায় প্রবর্তিত ব্রাহ্মধর্মের তৎকালীন প্রচারক কেশবচন্দ্র সেনের। সে সময় কেশবচন্দ্র ছিলেন ব্রাহ্মধর্মের নববিধান শাখার প্রধান। তাঁরই প্রভাবে গিরিশচন্দ্র সেন ব্রাহ্ম মতবাদে দীক্ষা গ্রহণ করেন। ব্রাহ্মসমাজ তাঁর কর্তব্যনিষ্ঠায় মুগ্ধ হয়ে তাঁকে ভাই উপাধিতে ভূষিত করে।

কুরআনের প্রথম বাংলা অনুবাদক
কেশবচন্দ্রের অনুরোধ ও ব্যবস্থাপনাতে তিনি ফার্সি ভাষায় আরো গভীর জ্ঞান লাভ এবং আরবি-ফার্সি সাহিত্যের ওপর পড়াশোনা করার জন্য কানপুর ও লখনউ গমন করেন। ফিরে আসার পর কেশবচন্দ্রের উৎসাহেই তিনি ইসলামি দর্শনের উপর গবেষণা শুরু করেন। কিন্তু ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে পড়াশোনা ও গবেষণা করার জন্য প্রধান বাঁধাই ছিল ভাষা। হিন্দু ও খ্রিস্ট ধর্মের ধর্মগ্রন্থসমূহ অনেক আগেই বাংলায় অনূদিত হয়েছিল, কিন্তু ইসলাম ধর্মের কোন ধর্মশাস্ত্রই বাংলাভাষায় ছিলনা। বিশেষ করে পবিত্র কুরআন ও হাদিস তখনো বাংলায় প্রকাশিত হয়নি। যার ফলে কুরআনের মর্মার্থ অনুবাধন করা থেকে বৃহত্তর মুসলিম গোষ্ঠী পুরোপুরিই বঞ্চিত ছিল। তাই ব্রাহ্মসমাজের কেশবচন্দ্র সেন পরিচালিত নববিধান সভা ইসলাম ধর্মগ্রন্থসমূহ বাংলায় অনুবাদ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। স্বাভাবিকভাবেই, আরবি-ফার্সি ভাষার সুপন্ডিত ভাই গিরিশচন্দ্র সেন অত্যন্ত দক্ষতার সাথে এ দায়িত্বপূর্ণ কাজ সম্পন্ন করেন।

লেখক গিরিশচন্দ্র সেন
তিনি কুরআন শরীফের সম্পূর্ণ অংশ, মিশকাত শরীফের প্রায় অধিকাংশ, হাদিস, তাজকিরাতুল আউলিয়া, দিওয়ান-ই-হাফিজ, গুলিস্তাঁ, বুঁস্তা, মকতুব্বত-ই-মাকদুস, শারফ উদ্দিন মুনিবী, মসনভী-ই-রুমী, কিমিয়া-ই-সাদত, গুলশান-ই-আসরার ইত্যাদিসহ বহু ইসলামি গ্রন্থ বাংলায় অনুবাদ করেন।

ভাই গিরিশচন্দ্র সেনের মিশনারিসুলভ কাজের মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ছিল ‘তাজকিরাতুল আউলিয়া’-র বাংলা অনুবাদ ‘তাপসমালা’ শিরোনামে একটি ধারাবাহিক গ্রন্থের প্রকাশ। তাজকিরাতুল আউলিয়াতে মোট ৯৬ জন মুসলিম দরবেশের কাহিনী বর্ণিত আছে। এই কাহিনীগুলো ভাই গিরিশচন্দ্র সেন বাংলায় অনুবাদ করেন। তিনি মোট ছয় খন্ডে এই বিশাল অনুবাদ কর্মটি সম্পন্ন করেন।

কুরআনের অনুবাদ প্রকাশ
ভাই গিরিশচন্দ্র সেন অনুবাদক হিসেবে মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর তিনি কুরআনের অনুবাদের কাজ শুরু করেন। তিনি পর্যায়ক্রমে মোট ১২ টি খন্ডে এই অনুবাদকর্ম সমাপ্ত করেন। ‘তাপসমালা’র দুটো খন্ড বের হওয়ার পর ১৮৮১ সালের ১২ ডিসেম্বর কুরআনের প্রথম খন্ড প্রকাশিত হয়। প্রথম খন্ড প্রকাশের সময় গিরিশচন্দ্র অনুবাদকের নাম গোপন রাখেন। কারণ তৎকালীন সময়ে কাজটি যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। মুসলিম সমাজে এর প্রতিক্রিয়া কি হতে পারে সে সম্পর্কে তাঁর কোন ধারণাই ছিলনা। গ্রন্থটিতে শুধুমাত্র প্রকাশক গিরিশচন্দ্র সেন এবং মুদ্রক তারিণীচরণ বিশ্বাসের নাম ছিল। ৩২ পৃষ্ঠার এই খন্ডের মূল্য ছিল মাত্র চারআনা। কিন্তু গিরিশচন্দ্রের আশঙ্কা সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণিত হলো। মুসলমান আলেমসমাজ এই মহৎকর্ম সম্পাদন করার জন্য এই অজ্ঞাতনামা অনুবাদকের প্রশংসা করে ব্রাহ্মসমাজের নিকট পত্র প্রেরণ করেন। তাঁদের প্রশংসাপূর্ণ পত্রের অংশবিশেষ নিন্মে তুলে ধরা হলোঃ

আমরা বিশ্বাস ও জাতিতে মুসলমান। আপনি নিঃস্বার্থভাবে জনহিত সাধনের জন্য যে এতোদৃশ চেষ্টা ও কষ্ট সহকারে আমাদিগের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কুরআনের গভীর অর্থ প্রচারে সাধারণের উপকার সাধনে নিযুক্ত হইয়াছেন, এজন্য আমাদের আত্যুত্তম ও আন্তরিক বহু কৃতজ্ঞতা আপনার প্রতি দেয়।

কুরআনের উপরিউক্ত অংশের অনুবাদ এতদূর উৎকৃষ্ট ও বিস্ময়কর হইয়াছে যে, আমাদিগের ইচ্ছা, অনুবাদক সাধারণ সমীপে স্বীয় নাম প্রকাশ করেন। যখন তিনি লোকমন্ডলীয় এতোদৃশ্য উৎকৃষ্ট সেবা করিতে সক্ষম হইবেন, তখন সেই সকল লোকের নিকট আত্ন-পরিচয় দিয়া তাঁহার উপযুক্ত সম্ভ্রম করা উচিত।

কুরআন অনুবাদ শেষ করে ভাই গিরিশচন্দ্র্র সেন বলেছিলেনঃ

আজ কুরআনের সমাপ্ত দেখিয়া আমার মনে যুগপৎ হর্ষ-বিষাদ উপস্থিত। হর্ষ এই যে, এত কালের পরিশ্রম সার্থক হইল। বিষাদ এই যে, ইহার প্রথমাংশ শ্রী মদাচার্য্য কেশবচন্দ্রের করকমলে অর্পণ করিয়াছিলাম। তিনি তাহাতে পরমাহ্লাদিত হইয়াছিলেন এবং তাহার সমাপ্তি প্রতীক্ষা করিতেছিলেন। শেষাংশ আর তাঁহার চক্ষুর গোচর করিতে পারিলাম না। ঈশ্বর তাঁহাকে আমাদের চক্ষুর অগোচর করিলেন। তিনি অনুবাদের এরূপ পক্ষপাতী ছিলেন যে, তাহার নিন্দা কেহ করিলে সহ্য করিতে পারিতেন না। আজ অনুবাদ সমাপ্ত দেখিয়া তাঁহার কত না আহ্লাদ হইত, এছাড়াও তাঁহার কত আশীর্ব্বাদ লাভ করিত।

কুরআনের সম্পূর্ণ খন্ড একত্রে প্রকাশিত হয় ১৮৮৬ সালে। সম্পূর্ণ খন্ডেই প্রথম তিনি স্বনামে আত্নপ্রকাশ করেন। ভাই গিরিশ্চন্দ্র সেন অনূদিত কুরআনের চতুর্থ সংস্করণে মৌলানা আকরাম খাঁ একটি প্রশংসাসূচক ভূমিকা লিখেছিলেন।

সম্পাদনা কর্ম
ভাই গিরিশচন্দ্র সেন ঢাকা থেকে প্রকাশিত ‘বঙ্গবন্ধু’ ও ‘সুলভ সমাচার’ নামের দুটি পত্রিকার সহযোগী সম্পাদক ছিলেন। তৎকালীন পশ্চাৎপদ নারী সমাজের জাগরণে নিজ উদ্যোগে প্রকাশ করেছিলেন ‘মহিলা’ নামের একটি পত্রিকা। তিনি নিজেই এর সম্পাদক ছিলেন।

মৃত্যু
মুক্তমনা ও অসাধারণ মানুষ ভাই গিরিশচন্দ্র সেন ১৯১০ সালের ১৫ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন

Add a Comment