পূর্ববঙ্গ গীতিকা

পূর্ববঙ্গ-গীতিকা পূর্ববাংলার লোকসাহিত্যের একটি সংকলন। মুখে মুখে রচিত ও লোকসমাজে প্রচলিত এর পালাগুলি বাংলা সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ। ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, , সিলেট (শ্রীহট্ট), ত্রিপুরা প্রভৃতি অঞ্চল থেকে পালাগুলি সংগৃহীত হয়েছে। এগুলির প্রধান প্রধান সংগ্রাহক হলেন চন্দ্রকুমার দে, দীনেশচন্দ্র সেন, আশুতোষ চৌধুরী প্রমুখ। সংগৃহীত পালাগুলির সংখ্যা পঞ্চাশের অধিক। পালাগুলির অধিকাংশই চোদ্দ শতকে রচিত। তবে কিছু কিছু পালা ষোল ও সতের শতকেও রচিত হয়েছে। পালাগুলির রচয়িতারা ছিলেন পল্লীর অশিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিত কৃষক, পাটনী প্রভৃতি নিম্নবৃত্তির সাধারণ লোক। প্রণয়ঘটিত উপাখ্যান, জমিদারদের দলাদলি বা লোকজীবনের কোনো ঘটনা নিয়ে ছড়া-পাঁচালির ঢঙে মুখে মুখে এগুলি রচিত হতো। পরে গায়েনের দল সুরারোপ করে এগুলি গ্রামে গ্রামে গেয়ে বেড়াত।

১৯১৩ সাল থেকে চন্দ্রকুমার দে প্রথম এ ধরণের লোকগাথা প্রকাশ করতে থাকেন। দীনেশচন্দ্র সেন সেগুলি পড়ে আকৃষ্ট হন এবং চন্দ্রকুমারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তাঁর সহযোগিতায় পল্লী অঞ্চলের কৃষকদের কাছ থেকে বেশ কিছু গাথা সংগ্রহ করে দীনেশচন্দ্র ১৯২৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থসাহায্যে পূর্ববঙ্গ-গীতিকা নামে সেগুলি প্রকাশ করেন। পরে Eastern Bengal Ballads নামে ইংরেজি অনুবাদের মাধ্যমে দীনেশচন্দ্র একে প্রথমবারের মতো বিশ্বের দরবারে তুলে ধরেন।

গীতিকার পালাসমূহে বাঙালি জীবনের সহজ-সরল বৈশিষ্ট্যসমূহ প্রতিফলিত হয়েছে। তবে সব পালাই যথার্থ গীতিকার মর্যাদা পায়নি। নিছক বর্ণনার কারণে কোনো কোনো পালার শিল্পমান ক্ষুণ্ণ হয়েছে। এর মধ্যে হাতিধরা, জমিদারদের বিরোধ, তীর্থস্থান নিয়ে কলহ ইত্যাদির নাম উল্লেখযোগ্য।

আবার কোনো কোনো পালায় পূর্ব বাংলার প্রকৃতি ও পল্লীর নরনারীর সুখ-দুঃখের অনুভূতি এমনভাবে বর্ণিত হয়েছে যে, সেগুলি যথার্থ গীতিকার মর্যাদা পেয়েছে। মাঞ্জুর মা, ধোপার পাট, মইষাল বন্ধু প্রভৃতি পালায় মহুয়া পালার (ময়মনসিংহ গীতিকার পালা )ন্যায় প্রেমের স্বাধীনতা ও উদ্দাম স্ফূর্তি পরিদৃষ্ট হয়। আয়নাবিবি পালায় হিন্দু-মুসলমানের গৃহস্থালির করুণ চিত্র ফুটে উঠেছে। কাঞ্চনমালা, কমল সদাগর, মদনকুমার ও মধুমালা প্রভৃতি পালায় রূপকথার চিত্র প্রাধান্য পেয়েছে। চৌধুরীর লড়াই হলো তৎকালীন সমাজের একখানি নিখুঁত চিত্রপট। ভেলুয়া পালায় প্রধানত নারীহূদয়ের আর্তি ফুটে উঠেছে। মুসলমান রমণীরা এখনও বিবাহ-বাসরে এ পালাটি গেয়ে থাকেন। কমল সদাগর, জিরালনী এবং মাঞ্জুর মা এই তিনটি পালায় ব্যভিচারিণী পুরমহিলার বর্ণনা পাওয়া যায়। সমসের গাজীর গান পালাটি হলো একটি নিখুঁত ঐতিহাসিক চিত্রপট। এমনিভাবে বিভিন্ন কাহিনী অবলম্বনে গীতিকার পালাগুলি রচিত হয়েছে। পালাগুলি নাটকীয় গুণে গুণান্বিত এবং এগুলির কাহিনীও চিত্তাকর্ষক।

Add a Comment