শব্দকোষ-চর্যাপদ

রাহুল সাংকৃত্যায়ন
রাহুল সাংকৃত্যায়ন তথা কেদারনাথ পাণ্ডে (৯ এপ্রিল, ১৮৯৩ – ১৪ এপ্রিল, ১৯৬৩), ছিলেন ভারতের একজন স্বনামধন্য পর্যটক, বৌদ্ধ সহ বিভিন্ন শাস্ত্রে সুপণ্ডিত, মার্কসীয় শাস্ত্রে দীক্ষিত । তিনি তাঁর জীবনের ৪৫ বছর ব্যয় করেছেন বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করে। তিনি বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদের তাত্ত্বিক ব্যাখ্যাতা হিসাবেও প্রসিদ্ধ ছিলেন। বলা হয়েছে তিনি হিন্দি ভ্রমণসাহিত্যের জনক। ভোলগা থেকে গঙ্গা তাঁর অন্যতম বিখ্যাত গ্রন্থ। বৌদ্ধ দর্শনে তাঁর পাণ্ডিত্য ছিল অসামান্য। কাশীর পণ্ডিতমণ্ডলী তাঁকে “মহাপণ্ডিত” আখ্যায়িত করেছিলেন।

লামা তারানাথ
তিব্বতীয় বৌদ্ধ-ভিক্ষু লামা তারানাথ ষোড়শ শতকের ঐতিহাসিক। ‘কাবাভদুন দন’ নামে একটি গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। তিনি ৯৮২ খ্রিস্টাব্দে বিক্রমপুর পরগনার বজ্রযোগিনী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। এটি বর্তমানে বাংলাদেশের মুন্সিগঞ্জ জেলার অন্তর্ভুক্ত। অতীশ দীপঙ্করের বাসস্থান এখনও ‘নাস্তিক পণ্ডিতের ভিটা’ নামে পরিচিত।

অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান
অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান হলেন একজন প্রখ্যাত পণ্ডিত যিনি পাল সাম্রজ্যের আমলে একজন বৌদ্ধ ভিক্ষু এবং বৌদ্ধধর্মপ্রচারক ছিলেন। ১২ বছর বয়সে নালন্দায় আচার্য বোধিভদ্র তাঁকে শ্রমণ(বৌদ্ধ সন্ন্যাসী, ভিক্ষু) রূপে দীক্ষা দেন এবং তখন থেকে তাঁর নাম হয় দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান। তাঁর একটি বিখ্যাত গ্রন্থ ‘বোধিপথপ্রদীপ’।

বজ্রযান
বজ্রযান বৌদ্ধধর্মের একটি মতবাদ। তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের মন্ত্রযানের সঙ্গে মহাসুখবাদের সংযোগের ফলে উদ্ভূত এ মতবাদ বাংলার সমতট অঞ্চলে বিশেষ প্রসার লাভ করেছিল। বজ্রযানমতে নির্বাণের পর শূন্য, বিজ্ঞান ও মহাসুখ লাভ হয়। শূন্যতার পরম জ্ঞানই নির্বাণ। এই জ্ঞানকে বলে নৈরাত্মা। নৈরাত্মার মধ্যে আত্মা লয়প্রাপ্ত হয়। বোধিচিত্ত যখন নৈরাত্মার আলিঙ্গনবদ্ধ হয়ে নৈরাত্মাতেই লীন হয়, তখন উৎপন্ন হয় মহাসুখ। চিত্তের যে পরমানন্দ ভাব, যে এককেন্দ্রিক ধ্যান, তা-ই বোধিচিত্ত। বোধিচিত্তই বজ্র। কঠোর যোগের দ্বারা ইন্দ্রিয় দমিত হলে চিত্ত বজ্রের ন্যায় দৃঢ় হয়। এ অবস্থায় সাধক বোধিজ্ঞান লাভ করেন। বজ্রকে আশ্রয় করে যে যানে বা পথে নির্বাণ লাভ হয়, তা-ই বজ্রযান।

সহজযান
সহজযান বৌদ্ধধর্মীয় একটি মতবাদ। খ্রিস্টীয় অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতকের মধ্যে এর বিকাশ ঘটে। এর মূল তত্ত্ব- কঠোর সাধনায় মুক্তি কামনার পরিবর্তে সদ্গুরুর নির্দেশ অনুযায়ী জীবন পরিচালনার মাধ্যমে পরম সুখ লাভ করা। এটি চিত্তের এমন এক অবস্থা, যেখানে সুখ ভিন্ন অন্য কোনো বিষয়ের অস্তিত্ব থাকে না। এ পরম সুখ সহজযানমতে কেবল গুরুর মাধ্যমেই লাভ করা যায়। এক্ষেত্রে গুরুই প্রধান এবং তাঁকে বলা হয় ‘বজ্রগুরু’। ‘বজ্র’ মানে শূন্য বা নিরাসক্তি, অর্থাৎ যিনি সাধনার দ্বারা চিত্তকে সর্ববিষয়ে নিরাসক্ত করেন তিনিই বজ্রগুরু। তবে সহজযানে যে পরম সুখের কথা বলা হয়েছে তা স্ত্রী-পুরুষ সংযোগজনিত সুখ। শরীরকে এখানে সাধনার ক্ষেত্ররূপে বিবেচনা করা হয়।

সহজযানীদের মতে সংসারও শূন্য, নির্বাণও শূন্য; পাপ-পুণ্য বলতে কিছু নেই। তাই সবই যখন শূন্য তখন উৎপত্তি নেই, নিবৃত্তিও নেই। এমনকি অন্যান্য মতবাদে যে চিত্তের কথা বলা হয়, তাও শূন্য। চিত্তের এই শূন্যতাই পরমার্থ বা নির্বাণ। নির্বাণে সকল ক্লেশের নাশ হয় এবং এর পরম ফল শান্তি। এ শান্তি গুরুর উপদেশ ছাড়া লাভ করা যায় না।

সহজযানে ইন্দ্রিয় নিরোধ, কঠোর ব্রত ধারণ ইত্যাদি নিয়ম পালন করা বৃথা। কারণ এতে শারীরিক কষ্ট হয় এবং মানসিক স্থিতিশীলতা নষ্ট হয়। আর মন স্থির না থাকলে কখনই সিদ্ধি লাভ হয় না। তাই কঠোর নিয়মে নয়, অত্যন্ত সহজ পথে ইন্দ্রিয় ভোগের অবসান করতে হবে। পাঁচ ইন্দ্রিয়ের যে পাঁচটি বিষয় সেগুলিকে বলা হয় ভোগ বা কাম। সহজিয়ামতে তপস্যার দ্বারা নিজেকে কষ্ট না দিয়ে বরং ভোগের মাধ্যমে বোধির সাধনা করতে বলা হয়েছে। তাই সহজপন্থীদের মতে বোধিলাভের জন্য গুরুর অনুমতি সাপেক্ষে পঞ্চকামের উপভোগ করণীয়। যার এতে নিষ্ঠা নেই তার পক্ষে নির্বাণ লাভও সম্ভব নয়।

সিদ্ধাচার্য
বজ্রযানী ও সহজযানী গুরুদেরকে বলা হয় সিদ্ধাচার্য। জানা যায় এরূপ চুরাশিজন সিদ্ধাচার্য ছিলেন। তাঁরা কেবল বক্তৃতা, উপদেশ বা শাস্ত্রের ব্যাখ্যা দিয়েই নয়, বরং বিভিন্ন রাগ-রাগিণীর সুরে গান গেয়ে সাধারণ মানুষের কাছে সহজযানতত্ত্ব পৌঁছে দিতেন। যে সব গানের সংকলন হিসাবে আমরা চর্যাপদ পেয়েছি।

অনুবাদক
চর্যাপদের প্রায় সকল অনুবাদ গ্রহণ করা হয়েছে সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ- এঁর অনুবাদ থেকে।

Albert Gruenwedel
Albert Gruenwedel (July 31, 1856 – October 28, 1935) একজন জার্মান, এজাধারে প্রত্নতাত্ত্বিক, ভারতবিদ্যা ও তিব্বতবিদ্যা বিশারদ, এবং মধ্য এশিয়া বিষয়ক গবেষক। বৌদ্ধ ধর্ম, মধ্য এশিয়ার প্রত্নতত্ত্ব নিয়ে অনেক লেখা প্রকাশ করেন। এ জন্য তাঁকে নাইট উপাধি দেওয়া হয়। তাঁর দুটি বিখ্যাত গ্রন্থ Buddhist art in India (1893) and Mythology of Buddhism in Tibet and Mongolia (1900)

নীহাররঞ্জন রায়
নীহাররঞ্জন রায় (জন্ম : ১৪ই জানুয়ারি, ১৯০৩ – মৃত্যু : ৩০শে আগস্ট, ১৯৮১) ছিলেন বাঙালি ইতিহাসবিদ, সাহিত্য সমালোচক ও শিল্পকলা-গবেষক পন্ডিত। দেশবরেণ্য ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মনীষী ছিলেন। ১৯০৩ সালের ১৪ জানুয়ারি ময়মনসিংহের কিশোরগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি সম্পাদনা করেছেন বাঙ্গালীর ইতিহাস : আদি পর্ব নামক বিখ্যাত গ্রন্থ।

সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়
হরপ্রসাদ শাস্ত্রী চর্যার ভাষাকে বাংলা বলে সাব্যস্ত করেছিলেন। কয়েকজন কবির শব্দ-বিচার করে তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন। তবে বিজয়চন্দ্র মজুমদার তাঁর The History of the Bengali Language (১৯২০)-এ এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেন। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় The Origin and Development of the Bengali Language-এ সুস্পষ্টভাবেই চর্যার ভাষা বাংলা এই মত ব্যক্ত করেন।

লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে সুনীতিকুমার বাংলা ভাষার উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ সম্পর্কে গবেষণা করে ডি.লিট উপাধি অর্জন করেন ১৯২১ সালে। তাঁর গবেষণা অভিসন্দর্ভটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করেন উপাচার্য আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। ১৯২৬ সালে এটি প্রকাশিত হয় The Origin and Development of the Bengali Language নামে। এই অভিসন্দর্ভটি সুনীতিকুমারের প্রধান কীর্তি, একটি অসাধারণ ও বড় মাপের কাজ, – Magnum Opus।

Add a Comment