বিশেষণ পদ

বিশেষণ : যে পদ বিশেষ্য, সর্বনাম ও ক্রিয়াপদের দোষ, গুণ, অবস্থা, সংখ্যা, পরিমাণ ইত্যাদি প্রকাশ করে, তাকে বিশেষণ পদ বলে।

চলন্ত গাড়ি : বিশেষ্যের বিশেষণ।
করুণাময় তুমি : সর্বনামের বিশেষণ।
দ্রুত চল: ক্রিয়া বিশেষণ।

বিশেষণ দুই ভাগে বিভক্ত। যথা—১. নাম বিশেষণ ও ২. ভাব বিশেষণ।

নাম বিশেষণ: যে বিশেষণ পদ কোনো বিশেষ্য বা সর্বনাম পদকে বিশেষিত করে, তাকে নাম বিশেষণ বলে। যথা

বিশেষ্যের বিশেষণ : সুস্থ সবল দেহকে কে না ভালোবাসে?
সর্বনামের বিশেষণ : সে রূপবান গুণবান

নাম বিশেষণের প্রকারভেদ

ক. রূপবাচক: নীল আকাশ, সবুজ মাঠ, কালো মেঘ।
খ. গুণবাচক : চৌকস লোক, দক্ষ কারিগর, ঠাণ্ডা হাওয়া।
গ. অবস্থাবাচক: তাজা মাছ, রোগা ছেলে, খোঁড়া পা।
ঘ. সংখ্যাবাচক: হাজার লোক, দশ দশা, শ টাকা।
ঙ. ক্রমবাচক: দশম শ্রেণি, সত্তর পৃষ্ঠা, প্রথমা কন্যা।
চ. পরিমাণবাচক: বিঘাটেক জমি, পাঁচ শতাংশ ভূমি, হাজার টনী জাহাজ, এক কেজি চাল, দু কিলোমিটার রাস্তা।
ছ. অংশবাচকঃ অর্ধেক সম্পত্তি, ষোল আনা দখল, সিকি পথ।
জ. উপাদানবাচক: বেলে মাটি, মেটে কলসি, পাথুরে মূর্তি।
ঝ. প্রশ্নবাচক: কতদূর পথ? কেমন অবস্থা?
ঞ. নির্দিষ্টতাজ্ঞাপক : এই লোক, সেই ছেলে, ছাব্বিশে মার্চ।

বিভিন্নভাবে বিশেষণ গঠনের পদ্ধতি

ক. ক্রিয়াজাত: হারানো সম্পত্তি, খাবার পানি, অনাগত দিন।
খ. অব্যয়জাত: আচ্ছা মানুষ, উপরি পাওনা, হঠাৎ বড়লোক।
গ. সর্বনাম জাত: কবেকার কথা, কোথাকার কে, স্বীয় সম্পত্তি।
ঘ. সমাসসিদ্ধ: বেকার, নিয়ম-বিরুদ্ধ, জ্ঞানহারা, চৌচালা ঘর।
ঙ. বীপ্সামূলক: হাসিহাসি মুখ, কাঁদকাঁদ চেহারা, ডুবুডুবু নৌকা।
চ. অনুকার অব্যয়জাত : কনকনে শীত, শনশনে হাওয়া, ধিকিধিকি আগুন, টসটসে ফল, তকতকে মেঝে।
ছ. কৃদন্ত: কৃতী সন্তান, জানাশোনা লোক, পায়ে-চলা পথ, হৃত সম্পত্তি, অতীত কাল।
জ. তদ্ধিতান্ত: জাতীয় সম্পদ, নৈতিক বল, মেঠো পথ।
ঝ. উপসর্গযুক্ত: নিখুঁত কাজ, অপহৃত সম্পদ, নির্জলা মিথ্যে।
ঞ. বিদেশি: নাস্তানাবুদ অবস্থা, লাওয়ারিশ মাল, লাখেরাজ সম্পত্তি, দরপত্তনি তালুক।

ভাব বিশেষণ: যে পদ বিশেষ্য ও সর্বনাম ভিন্ন অন্য পদকে বিশেষিত করে তা-ই ভাব বিশেষণ। ভাব বিশেষণ চার প্রকার :

১. ক্রিয়া বিশেষণ
২. বিশেষণের বিশেষণ বা বিশেষণীয় বিশেষণ
৩. অব্যয়ের বিশেষণ
৪. বাক্যের বিশেষণ।

১. ক্রিয়া বিশেষণ: যে পদ ক্রিয়া সংঘটনের ভাব, কাল বা রূপ নির্দেশ করে, তাকে ক্রিয়া বিশেষণ বলে। যথা—

ক. ক্রিয়া সংগঠনের ভাব : ধীরে ধীরে বায়ু বয়।
খ. ক্রিয়া সংগঠনের কাল : পরে একবার এসো।

২. বিশেষণীয় বিশেষণ: যে পদ নাম বিশেষণ অথবা ক্রিয়া বিশেষণকে বিশেষিত করে, তাকে বিশেষণীয় বিশেষণ বলে। যথা

ক. নাম বিশেষণের বিশেষণ : সামান্য একটু দুধ দাও। এ ব্যাপারে সে অতিশয় দুঃখিত।
খ. ক্রিয়া-বিশেষণের বিশেষণ : রকেট অতি দ্রুত চলে।

৩. অব্যয়ের বিশেষণঃ যে ভাব-বিশেষণ অব্যয় পদ অথবা অব্যয় পদের অর্থকে বিশেষিত করে, তাকে অব্যয়ের বিশেষণ বলে। যথা— ধিক্ তারে, শত ধিক্‌ নির্লজ্জ যে জন।

৪. বাক্যের বিশেষণ: কখনো কখনো কোনো বিশেষণ পদ একটি সম্পূর্ণ বাক্যকে বিশেষিত করতে পারে, তখন তাকে বাক্যের বিশেষণ বলা হয়। যেমন— দুর্ভাগ্যক্রমে দেশ আবার নানা সমস্যাজালে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে। বাস্তবিকই আজ আমাদের কঠিন পরিশ্রমের প্রয়োজন।

বিশেষণের অতিশায়ন
বিশেষণ পদ যখন দুই বা ততোধিক বিশেষ্য পদের মধ্যে গুণ, অবস্থা, পরিমাণ প্রভৃতি বিষয়ে তুলনায় একের উৎকর্ষ বা অপকর্ষ বুঝিয়ে থাকে, তখন তাকে বিশেষণের অতিশায়ন বলে। যেমন- যমুনা একটি দীর্ঘ নদী, পদ্মা দীর্ঘতর, কিন্তু মেঘনা বাংলাদেশের দীর্ঘতম নদী। সূর্য, পৃথিবী ও চন্দ্রের মধ্যে তুলনায় সূর্য বৃহত্তম, পৃথিবী চন্দ্রের চেয়ে বৃহত্তর এবং চন্দ্র পৃথিবী অপেক্ষা ক্ষুদ্রতর।

ক. বাংলা শব্দের অতিশায়ন
১. বাংলা শব্দের অতিশায়নে দুয়ের মধ্যে চাইতে, চেয়ে, হইতে, হতে, অপেক্ষা, থেকে ইত্যাদি শব্দ ব্যবহৃত হয়। এসব ক্ষেত্রে দুয়ের মধ্যে তারতম্য বোঝাতে প্রথম বিশেষ্যটি প্রায়ই ষষ্ঠী বিভক্তিযুক্ত হয়ে থাকে এবং মূল বিশেষণের পর কোনো পরিবর্তন সাধিত হয় না। যথা— গরুর থেকে ঘোড়ার দাম বেশি। বাঘের চেয়ে সিংহ বলবান।

২. বহুর মধ্যে অতিশায়ন: অনেকের মধ্যে একের উৎকর্ষ বা অপকর্য বোঝাতে মূল বিশেষণের কোনো পরিবর্তন হয় না। মূল বিশেষণের পূর্বে সবচাইতে, সবচেয়ে, সব থেকে, সর্বাপেক্ষা, সর্বাধিক প্রভৃতি শব্দ ব্যবহার হয়। যথা- নবম শ্রেণির ছাত্রদের মধ্যে করিম সবচেয়ে বুদ্ধিমান। ভাইদের মধ্যে বিমলই সবচাইতে বিচক্ষণ। পশুর মধ্যে সিংহ সর্বাপেক্ষা বলবান।

৩. দুটি বস্তুর মধ্যে অতিশায়নে জোর দিতে হলে মূল বিশেষণের আগে অনেক, অধিক, বেশি, অল্প, কম, অধিকতর প্রভৃতি বিশেষণীয় বিশেষণ যোগ করতে হয়। যথা| পদ্মফুল গোলাপের চাইতে অনেক সুন্দর। ঘিয়ের চেয়ে দুধ বেশি উপকারী। কমলার চাইতে পাতিলেবু অল্প ছোট।

৪. কখনো কখনো ষষ্ঠী বিভক্তিযুক্ত শব্দে ষষ্ঠী বিভক্তিই চেয়ে, থেকে প্রভৃতি শব্দের কার্যসাধন করে। যেমন: এ মাটি সোনার বাড়া।

খ. তৎসম শব্দের অতিশায়ন
১. তৎসম শব্দের অতিশায়নে দুয়ের মধ্যে ‘তর’ এবং বহুর মধ্যে ‘তম’ প্রত্যয় যুক্ত হয়ে থাকে। যেমন—
গুরু-গুরুতর-গুরুতম।
দীর্ঘ-দীর্ঘতর-দীর্ঘতম।

কিন্তু ‘তর’ প্রত্যয়যুক্ত বিশেষণটি শ্রুতিকটু হলে ‘তর’ প্রত্যয় যোগ না করে বিশেষণের পূর্বে ‘অধিকতর’ শব্দটি যোগ করতে হয়। যেমন- অশ্ব হস্তী অপেক্ষা অধিকতর সুশ্রী।
২. বহুর মধ্যে অতিশায়নে তুলনীয় বস্তুর উল্লেখ না করেও ‘তম’ প্রত্যয় যুক্ত হতে পারে। যেমন- মেঘনা | বাংলাদেশের দীর্ঘতম নদী। দেশসেবার মহত্তম ব্রতই সৈনিকের দীক্ষা। |
৩. তৎসম শব্দের অতিশায়নে দুয়ের মধ্যে তুলনায় ‘ঈয়স্’ প্রত্যয় এবং বহুর মধ্যে তুলনায় ‘ইষ্ঠ’ প্রত্যয় যুক্ত হয়। বাংলায় সাধারণত ‘ঈয়স্’ প্রত্যয়ান্ত শব্দগুলো ব্যবহৃত হয় না। যেমন—

মূল বিশেষণদুয়ের তুলনায়বহুর তুলনায়
লঘুলঘিয়ানলঘিষ্ঠ
অল্পকনীয়ান,(অপ্রচলিত)কনিষ্ঠ
বৃদ্ধজ্যায়ানজ্যেষ্ঠ
শ্রেয়শ্রেয়ানশ্রেষ্ঠ

উদাহরণ : তিন ভাইয়ের মধ্যে রহিমই জ্যেষ্ঠ এবং করিম কনিষ্ঠ। সংখ্যাগুলোর লঘিষ্ঠ সাধারণ গুণিতক বের কর।

৪. ‘ঈয়স্’ প্রত্যয়ান্ত কোনো কোনো শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ রূপ বাংলায় প্রচলিত আছে। যেমন— ভূয়সী প্রশংসা।

একই পদের বিশেষ্য ও বিশেষণ রূপে প্রয়োগ
বাংলা ভাষায় একই পদ বিশেষ্য ও বিশেষণ রূপে ব্যবহৃত হতে পারে।
যেমন –
ভালো।

বিশেষণ রূপে – ভালো বাড়ি পাওয়া কঠিন।
বিশেষ্য রূপে -আপন ভালো সবাই চায়।

মন্দ :

বিশেষণ রূপে – মন্দ কথা বলতে নেই।
বিশেষ্য রূপে – এখানে কী মন্দটা তুমি দেখলে?

পুণ্য :

বিশেষণ রূপে – তোমার এ পুণ্য প্রচেষ্টা সফল হোক।
বিশেষ্য রূপে – পুণ্যে মতি হোক।

নিশীথ :

বিশেষণ রূপে – নিশীথ রাতে বাজছে বাঁশি।
বিশেষ্য রূপে – গভীর নিশীথে প্রকৃতি সুপ্ত।

শীত :

বিশেষণ রূপে – শীতকালে কুয়াশা পড়ে।
বিশেষ্য রূপে – শীতের সকালে চারদিক কুয়াশায় অন্ধকার।

সত্য :

বিশেষণ রূপে – সত্য পথে থেকে সত্য কথা বল।
বিশেষ্য রূপে – এ এক বিরাট সত্য।