ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস

ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস নামক গ্রন্থটি রচনা করেছেন বশীর আলহেলাল, সাহিত্যপ্রকাশ প্রকাশনি থেকে প্রকাশিত। প্রথম আলোয় ‘ইতিহাসেরও ইতিহাস থাকে’ শিরোনামে সমালোচনা লিখেছেন সৈয়দ আজিজুল হক।


কোনাে কিছু নিয়ে যখন ইতিহাস সৃষ্টি হয়, তখন অনিবার্যভাবে তার পেছনেও থাকে হয়ে ওঠার আরেকটি ইতিহাস। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন সে রকমই এক গৌরবময় ইতিহাস; ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২–এই কালপরিধির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এর ঐতিহাসিক তাৎপর্য এর পেছনে রয়েছে এক দীর্ঘ পটভূমি। মাতৃভাষা নিয়ে এ অঞ্চলের বাঙালির সংগ্রামের ইতিহাস আসলেই বড় দীর্ঘ। পেছনে তাকালে একে শুধু চল্লিশের দশকেই সীমাবদ্ধ করা যাবে না, বিশ শতকের শুরু থেকে পূর্বাঞ্চলীয় বাঙালি মধ্যবিত্তের উদ্ভব পর্বের ইতিহাসের মধ্যে কিংবা দুই শ বছরের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলের বিভেদমূলক নীতি, যা বাঙালির একটি অংশকে পশ্চাৎপদতার তিমিরে নিক্ষেপ করেছে, তার মধ্যেও খুঁজে পাওয়া যাবে না এর সব বীজ। আরও পেছনে গিয়ে মধ্যযুগীয় এ অঞ্চলের লেখককুল, যারা বাংলায় রােমান্সধর্মী প্রণয়ােপাখ্যান রচনা করতে গিয়ে মাতৃভাষার পক্ষে সংগ্রাম করেছেন, এমনকি নিজ ধর্মগ্রন্থের ভাষার বিপরীতে সুস্পষ্ট অবস্থান নিয়েছেন, তাদের দিকেও দৃষ্টি ফেরাতে হবে।

সুতরাং ভাষা আন্দোলন যে ইতিহাসটা সৃষ্টি করেছে, সেই সংগ্রাম শুধু একালের নয়, শুধু রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক নয়, এমনকি শুধু ভাষারও নয়, সামগ্রিকভাবে শিক্ষা ও সংস্কৃতির। অতএব, বশীর আলহেলাল যখন ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস লিখতে প্রবৃত্ত হন, তখন যথার্থভাবেই দীর্ঘ পরিসরে এর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পটভূমি বিশ্লেষণ করেন। তিনি নিশ্চিতভাবে হিসাবে রাখেন, ওই কালগত ব্যাপ্তির ইতিহাসকে। আর আমরা পাঠকেরাও এর তাৎপর্য উপলব্ধি করতে তখনই সমর্থ হই, যখন যথার্থভাবে মূল্যায়ন করতে পারি এ দেশের মানুষের অন্তর্নিহিত ওই শক্তিকে, যার উদ্যমে মাত্র পাঁচ-ছয় বছরের ব্যবধানে একটি জনগােষ্ঠী সম্পূর্ণ ভিন্নতর পরিপ্রেক্ষিতে আপন স্বরূপে নিজেদের দাঁড় করাতে সক্ষম হয়। ১৯৪৬-এ দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে একটি নতুন রাষ্ট্রের পক্ষে একটি জনগােষ্ঠী নিরঙ্কুশভাবে তাদের নির্বাচনী রায় ব্যক্ত করার ফলে এমন রাষ্ট্র গঠন সম্ভবপর হয়েছিল। অথচ ওই রাষ্ট্র গঠনের এক বছরের কম সময়ের মধ্যে তারা মাতৃভাষার প্রশ্নে নতুন করে ফুঁসে ওঠে নতুন রাষ্ট্রের কর্ণধারদের বিরুদ্ধেই, কোমর বাঁধে মাতৃভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে। বায়ান্নতে এই আন্দোলন এমন রূপ ধারণ করে যে দ্বিজাতিতত্ত্বের মােহ বলে আর কিছু অবশিষ্ট থাকে না। সম্পূর্ণ ভাষাভিত্তিক সেকুলার চিন্তার জাতীয়তাবােধে উজ্জীবিত হয়, শাসকশ্রেণির মুষ্টিমেয় কিছু লােক ব্যতীত, সমগ্র দেশ।

কোন শক্তিবলে এটা সম্ভবপর হলাে, তার রহস্য উদ্ঘাটন করতে হলে এর পটভূমির দিকে দৃষ্টি ফেরাতে হবে। বশীর আলহেলাল ওই পটভূমির ওপর জোর দেওয়ায় তার ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস রচনা তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে, হতে পেরেছে এমন সামগ্রিকতাস্পন্দী।

এ অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষ অনার্য নিম্নবর্গীয়। প্রায়শ বন্যাকবলিত, ঝড়-জলােচ্ছাসপীড়িত ও নদীভাঙন-আক্রান্ত হওয়ায় প্রতিনিয়ত তারা
সংগ্রামশীল। পলিমাটিবিধৌত এ অঞ্চল তাদের মনকে করেছে কোমল, উদার, শাস্ত্রের কাঠিন্যমুক্ত। নানা বহিঃশক্তির শাসন ও সাংস্কৃতিক প্রভাবে তার
মধ্যে নানা পরিবর্তন এলেও, নানা রকম ধর্মান্তরকরণ ঘটলেও, অব্যাহত থেকেছে যেমন তার আর্থিক দারিদ্র্য, তেমনি আতিথেয়তা আর সবকিছুকে সহজভাবে গ্রহণ করার ঔদার্যে মনােভূমির বিশালতা। দুই শ বছরের ঔপনিবেশিক শাসনের বিভেদাত্মক নীতির শিকার হয়ে পশ্চাৎপদতার শেষ সীমায় পৌঁছার কারণে শেষ পর্যায়ে সর্বভারতীয় রাষ্ট্রকাঠামাের মধ্যে সে মুক্তির পথ খুঁজে পায়নি। দারিদ্র্য থেকে মুক্তিলাভের জন্য স্বতন্ত্র রাষ্ট্রকাঠামােই তাকে নতুন পথের সন্ধান দিয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে নতুন রাষ্ট্রের কর্ণধাররা যখন তার মুক্তির পথে নতুন বাধা
সৃষ্টি করল, তখন বিদ্রোহে-বিপ্লবে উচ্চকিত হতেও তার মােটেই দ্বিধান্বিত হতে হয়নি। এই হলাে ভাষা আন্দোলনের যুক্তি। আর এর মধ্যেই নিহিত এ অঞ্চলের মানুষের মুক্তির অন্তর্গত শক্তি, যা তাকে শেষ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে দেশকে স্বাধীন করতে সাহসী করেছে।

বাংলাদেশের মানুষের এই সংগ্রামশীল শক্তিকে অনুধাবনে ব্যর্থ হলে ভাষা আন্দোলনের গৌরবকে যথার্থভাবে মূল্যায়ন করা সম্ভব নয়। বশীর আলহেলাল মূলত কথাশিল্পী ও প্রাবন্ধিক হলেও এ গ্রন্থ রচনায় ইতিহাসবিদ ও গবেষকের ভূমিকায় আসীন। তিনি সমকালীন পত্রপত্রিকা – বইয়ের সাহায্য যেমন নিয়েছেন অজস্রভাবে, তেমনি ভাষা আন্দোলনসংক্রান্ত অন্য গ্রন্থেরও সহায়তা গ্রহণ করেছেন অবলীলায়। যথার্থ গবেষকের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী তিনি সন্দেহজনক তথ্য যাচাই-বাছাইয়ের
মাধ্যমে মীমাংসায় পৌঁছার চেষ্টা করেছেন। যেমন বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারিতে মােহাম্মদ সালাহুদ্দীনের শহীদ হওয়া নিয়ে পরদিন পত্রিকায় যে খবর প্রকাশিত হয়, তা যে ভুল ছিল, ওই নামে কেউ যে প্রকৃতপক্ষে শহীদ হয়নি, সেটা তিনি বইয়ের দ্বিতীয় সংস্করণে নিশ্চিতভাবে প্রকাশ করেন। একুশে ফেব্রুয়ারিতে ১৪৪ ধারা ভাঙার ব্যাপারে কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকা নিয়েও যে বিভ্রান্তি প্রচারিত, তারও একটি যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা তাঁর বইয়ের দ্বিতীয় সংস্করণে আছে। আছে কমিউনিস্ট নেতা কমরেড মুজফ্ফর আহমদকে নিয়ে তমদুন মজলিশের নেতাদের উত্থাপিত অভিযােগ স্খলনের তথ্যনিষ্ঠ প্রয়াস।

আদি ভাষাসৈনিক হিসেবে আবদুল হকের ঐতিহাসিক ভূমিকারও যথাযথ মূল্যায়ন তিনি করেছেন। ভাষা-আন্দোলনের পক্ষ-বিপক্ষ শক্তির শ্রেণিচরিত্র বিশ্লেষণেও তিনি মনােযােগী থেকেছেন। বিশেষত, পক্ষশক্তির মধ্যেই ছিল বিচিত্র সব শ্রেণি-উপাদান। সেই উপাদানগুলাের সূক্ষ্মতর বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যায় লেখক গবেষকসুলভ নিষ্ঠার পরিচয় দিয়েছেন। সর্বোপরি ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস ও তাৎপর্য যে ভাষা আন্দোলনের কালেই সীমাবদ্ধ নয়, সেই মর্মবাণীটি উচ্চকিত হয়ে ওঠায় পাঠক এ গ্রন্থ থেকে বাঙালি সংস্কৃতির একটি সামগ্রিক রূপ অনুধাবনে সমর্থ হবেন।

Add a Comment