সুশাসন ছাড়া গণতন্ত্র ও উন্নয়ন উভয়ই অকার্যকর***

যুগান্তর, ০৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৭
এমএ খালেক : অর্থনীতিবিষয়ক কলাম লেখক


তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোতে প্রায়ই বিতর্ক লক্ষ করা যায়- একটি দেশের সাধারণ মানুষের সর্বোত্তম কল্যাণ সাধনের জন্য গণতন্ত্র ও উন্নয়ন এ দু’টির মধ্যে কোনটি বেশি জরুরি? গণতন্ত্রের প্রবক্তারা মনে করেন, একমাত্র নির্ভেজাল গণতন্ত্রই একটি দেশের কার্যকর অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত ও নিশ্চিত করতে পারে। কোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হলে চূড়ান্ত পর্যায়ে সেই দেশের সার্বিক জনকল্যাণ সাধিত হতে বাধ্য। সবার আগে চাই গণতন্ত্র। তাই গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে হবে। গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা থাকলে একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি অর্জন কঠিন কিছু নয়। তারা আরও মনে করেন, গণতন্ত্রের মাধ্যমেই একটি দেশ ও সমাজ দ্রুত এগিয়ে যেতে পারে। তাই গণতন্ত্রের কোনো বিকল্প নেই। তারা সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির উদাহরণ টেনে বলতে চান, সমাজতন্ত্র বা অন্য কোনো অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সর্বোচ্চ জনকল্যাণ সাধন করতে পারে না। সমাজতান্ত্রিক অর্থ ব্যবস্থা ব্যক্তির সৃজনশীলতাকে বাধাগ্রস্ত করে। কারণ সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উৎপাদন প্রক্রিয়া পরিচালিত হয় রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে। ব্যক্তির স্বাধীনতা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা সেখানে সীমিত। অন্যদিকে গণতন্ত্র মানুষের ব্যক্তিগত সৃজনশীলতাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব প্রদান করে।

বর্তমানে বিশ্বব্যাপী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং মুক্তবাজার অর্থনীতির জয়জয়কার। বিশ্ব এগিয়ে যাচ্ছে তার আপন গতিতে। অন্যদিকে যারা নির্ভেজাল উন্নয়নে বিশ্বাসী এবং উন্নয়নের প্রয়োজনে সীমিত গণতন্ত্রকেও সমর্থন করেন তাদের মতে, শুধু গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলেই একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত এবং সর্বোচ্চ জনকল্যাণ সাধিত হবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। বিশ্বের এমন অনেক দেশের উদাহরণ দেয়া যাবে যারা গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হয়েছে; কিন্তু সর্বোত্তম জনকল্যাণ সাধন করতে পারেনি। বিশ্ব আর্থ-রাজনৈতিক ব্যবস্থায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হচ্ছে গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় উদাহরণ। কিন্তু সেই যুক্তরাষ্ট্রও কিন্তু তার দেশের সব শ্রেণী-পেশার মানুষের জন্য সর্বোত্তম কল্যাণ সাধন অথবা দারিদ্র্য দূরীকরণে সফল হতে পারেনি। মার্কিন যুুক্তরাষ্ট্রে রয়েছে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ধনী ব্যক্তিদের বসবাস। কয়েক বছর আগে দি ইকোমনিস্ট পত্রিকার এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ তিন ধনী ব্যক্তির মিলিত মোট সম্পদের পরিমাণ বিশ্বের ৪৭টি স্বল্পোন্নত দেশের মোট জিডিপির প্রায় সমান। এটা যেমন এক দিকের চিত্র, এর বিপরীত চিত্র হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের পার্ক এবং অন্যান্য স্থানে এখনও অনেকেই খোলা আকাশের নিচে রাত যাপন করে। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের প্রশ্নাতীত গণতন্ত্র দেশটির সাধারণ মানুষের সর্বোত্তম কল্যাণ সাধন করতে পারেনি। যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের এক নম্বর অর্থনৈতিক শক্তি হলেও তারা নিজ দেশের জনগণের জন্য সুষম বণ্টন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারেনি। ফলে দেশটিতে এখনও ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য পর্বত প্রমাণ। শুধু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং সর্বাধিক জনকল্যাণকর সমাজব্যবস্থার নিশ্চয়তা দিতে পারে না।

এদিকে যারা উন্নয়নের স্বার্থে গণতন্ত্রের প্রশ্নে কিছুটা হলেও ছাড় দিতে প্রস্তুত তারা দক্ষিণ এশিয়ার বিস্ময়কর দেশ মালয়েশিয়ার উদাহরণ দিয়ে থাকেন। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী ডা. মাহাথির মোহাম্মদ প্রায় ২২ বছর দেশটি শাসন করেছেন। তার সময়ে মালয়েশিয়ায় গণতন্ত্র কাক্সিক্ষত মাত্রায় ছিল না। কিন্তু উন্নয়ন হয়েছে বিস্ময়করভাবে। আর এটা সম্ভব হয়েছে শাসনক্ষমতার ধারাবাহিকতা বজায় থাকার কারণেই। মাহাথির মোহাম্মদের পর যারা মালয়েশিয়ার রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হয়েছেন, তারা কিন্তু একইভাবে দেশটিকে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারছেন না। উন্নয়নের গতি কিছুটা হলেও মন্থর হয়ে পড়েছে। মাহাথির মোহাম্মদের নেতৃত্বাধীন মালয়েশিয়া শাসনক্ষমতার ধারাবাহিকতা এবং উন্নয়নের গতি সচল রাখার পাশাপাশি আরও যে কাজটি অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে করেছেন তা হল সর্বস্তরে সুশাসন প্রতিষ্ঠা। আমরা গণতন্ত্রই বলি আর উন্নয়নই বলি, সবকিছুর মূলে রয়েছে সুশাসন
একটি দেশ যদি সমাজের সর্বস্তরে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারে তাহলে উন্নয়ন ও গণতন্ত্র উভয়ই সঠিকভাবে কাজ করতে পারে। বিশ্বে এমন একটি দেশেরও উদাহরণ দেয়া যাবে না, যারা সুশাসন প্রতিষ্ঠা ছাড়া সত্যিকার উন্নয়ন ঘটাতে পেরেছে। সেটা যতই গণতান্ত্রিক দেশ হোক না কেন। কর্পোরেট গুড গভর্নেন্স বলে একটি কথা সব দেশেই প্রচলিত আছে। সমাজের সর্বস্তরে যেমন সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন, তেমনি প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে অভ্যন্তরীণ সুশাসন প্রতিষ্ঠা করাও জরুরি। কারণ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নিয়েই রাষ্ট্র গড়ে ওঠে। সমাজ ও প্রতিষ্ঠানে অভ্যন্তরীণ সুশাসন কাক্সিক্ষত মাত্রায় না থাকলে একটি দেশ কখনোই সার্বিকভাবে উন্নতির শিখরে পৌঁছাতে পারে না। অর্থনৈতিকভাবে বিপুল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও শুধু সুশাসন প্রতিষ্ঠার অভাবে অনেক দেশ হতদরিদ্রই থেকে যাচ্ছে।

সুশাসন না থাকলে সমাজের বিভিন্ন স্তরে বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে। দুর্নীতি ও অপরাধ বেড়ে যেতে পারে। আমাদের সমাজব্যবস্থার দিকে তাকালে আমরা কী দেখতে পাই? সরকার নানাভাবে সমাজে এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সুশাসন প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে সুশাসন প্রতিষ্ঠার তাগিদ দেয়া হলেও নিন্মস্তরের প্রতিষ্ঠানগুলোতে কার্যকর সুশাসন প্রতিষ্ঠিত না হওয়ায় অবস্থার দৃশ্যমান কোনো উন্নতি হচ্ছে না। এক্ষেত্রে সাফল্য যতটা অর্জিত হওয়া উচিত ছিল তা হচ্ছে না। একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা কিছুদিন আগে বলেছে, প্রতি বছর দুর্নীতির কারণে বাংলাদেশের আড়াই থেকে তিন শতাংশ জিডিপি অর্জন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত বিপুল পরিমাণ টাকা প্রতি বছর দেশের বাইরে পাচার হয়ে যাচ্ছে। অথচ এসব টাকা যদি স্থানীয়ভাবে বিনিয়োগ হতো তাহলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন অনেকটাই ত্বরান্বিত হতে পারত। রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠানগুলোর অধিকাংশেই সুশাসনের অভাব রয়েছে। ফলে প্রতিষ্ঠানগুলোর যে মাত্রায় জনসেবা প্রদান করার কথা ছিল, তারা তা দিতে পারছে না। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নির্বাহী পর্যায় থেকে যতই স্বচ্ছতার কথা বলা হোক না কেন, প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসন নিশ্চিত করা না গেলে কোনো কাজ হবে না।

দুর্নীতি প্রতিষ্ঠানের উচ্চপর্যায় থেকে নিচের দিকে ধাবিত হয়। এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয় যা হল, ব্যক্তিখাতে প্রতিষ্ঠিত কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানগুলো লাভজনকভাবে পরিচালিত হলেও একই ধরনের রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিষ্ঠানগুলো বছরের পর বছর লোকসান দিয়ে চলেছে। এর অন্যতম কারণ সুশাসনের অভাব। রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালিত হয় প্রতিনিধির মাধ্যমে। এখানে মালিক থাকেন অনুপস্থিত। অর্থাৎ রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠান মালিক নিজে পরিচালনা করেন না। এগুলো পরিচালিত হয় রাষ্ট্র কর্তৃক মনোনীত প্রতিনিধির মাধ্যমে। প্রতিনিধিরা কখনোই মালিকের মতো দায়িত্বশীল হন না। তারা মনে করেন, আমরা এসেছি মাত্র কয়েক বছরের জন্য। কাজেই ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধারে যা করণীয় তা-ই করতে হবে। অন্যদিকে ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হয় সরাসরি মালিকের অধীনে। ফলে সেখানে জবাবদিহিতা থাকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে। ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি বা প্রতিষ্ঠানের জন্য ক্ষতিকর কিছু করে টিকে থাকা যায় না। ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি করে পার পাওয়া খুবই কঠিন।

কোনো দেশ যদি সত্যিকার অর্থে টেকসই উন্নয়ন সাধন করতে চায়, তাহলে তাকে প্রথমেই সর্বস্তরে সুশাসন প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিতে হবে। কারণ সুশাসন না থাকলে একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও গণতন্ত্র বিপর্যস্ত হতে পারে। তাই সবার আগে একটি দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করাই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। উন্নয়ন ও গণতন্ত্রের সঙ্গে সুশাসনের কোনো বিরোধ নেই। বরং গণতন্ত্র ও উন্নয়নকে টেকসই এবং অধিকতর কার্যকর করতে হলে সুশাসনের হাত ধরে চলতে হবে। সুশাসন ছাড়া উন্নয়ন ও গণতন্ত্র পৃথকভাবে জনকল্যাণ সাধন করতে পারে না। তাই উন্নয়ন ও গণতন্ত্রকে সুশাসনের সঙ্গে হাত ধরাধরি করে চলতে হয়।

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অনেক উন্নতি ঘটিয়েছে। একসময় বাংলাদেশকে নিয়ে যারা উপহাস করত এখন তারাই বাংলাদেশকে ‘উন্নয়নের রোল মডেল’ হিসেবে আখ্যায়িত করছে। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অগ্রযাত্রা শুরু করেছিল। কিন্তু ১৯৭৫-পরবর্তী বাংলাদেশ প্রায় ১৫ বছর সামরিক শাসনের আওতায় ছিল। এসময় দেশে সুশাসনের অভাব দৃষ্ট হয়। বিভিন্ন সেক্টরে ব্যাপক দুর্নীতি এবং অব্যবস্থা ব্যাপক মাত্রায় ছড়িয়ে পড়ে। ’৮০-র দশকের শেষদিকে বিদ্যুতের লোডশেডিং নামক চুরি অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। এক পর্যায়ে লোডশেডিংয়ের হার ৪৫ শতাংশে উন্নীত হয়। সেই সময় (সম্ভবত ১৯৯০ সালে) বিশ্বব্যাংকের একজন ভাইস প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশ সফরে এসে বিদ্যুতের রেকর্ড পরিমাণ লোডশেডিং দেখে মন্তব্য করেছিলেন, বাংলাদেশ যদি বিদ্যুতের লোডশেডিং সহনীয় মাত্রায় কমিয়ে আনতে পারে, তাহলে প্রতি বছর যে অর্থ সাশ্রয় হবে তা দিয়ে প্রতি ৪ বছর অন্তর একটি করে যমুনা সেতু নির্মাণ করা যেতে পারে। পরবর্তী সময়ে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা শুরু হলে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উন্নতি শুরু করে।
বিশেষ করে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশ বিস্ময়কর উন্নতি অর্জন করে চলেছে। গত প্রায় ১০ বছর ধরে বাংলাদেশ ধারাবাহিকভাবে গড়ে সাড়ে ৬ শতাংশের ওপর জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করে চলেছে। বিশ্বের খুব কম দেশের পক্ষেই এমন অর্থনৈতিক সাফল্য প্রদর্শন করা সম্ভব হচ্ছে। জনগণের মাথাপিছু জাতীয় আয় যেখানে ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে ছিল ১২৯ মার্কিন ডলার, এখন তা ১ হাজার ৬০০ মার্কিন ডলার অতিক্রম করে গেছে। একসময় বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের পরিমাণ ১০০ কোটি মার্কিন ডলারে নেমে এসেছিল। এখন তা প্রায় ৩৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের ক্ষেত্রে সার্ক দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান এখন ভারতের পরেই। অর্থনীতির প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমাদের উল্লেখযোগ্য অর্জন রয়েছে। কিন্তু তারপরও আমরা সম্ভাবনার পুরোটা কাজে লাগাতে পারছি না। এজন্য মূলত সুশাসনের অভাবই দায়ী। তাই আমাদের এখন সুশাসন প্রতিষ্ঠার ওপরই বেশি জোর দিতে হবে।

Add a Comment