সুশাসন ও শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠা কেন জরুরি

বাংলাদেশ প্রতিদিন, ৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৪
মো. মতিউর রহমান সাবেক সচিব।


১. বাংলাদেশের বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি ও দলীয়করণ সুলভে ও সহজে সেবা প্রাপ্তির পথে প্রধান অন্তরায়। এর সঙ্গে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক নেতৃত্বের অযোগ্যতা ও অদক্ষতার একটা যোগসূত্র রয়েছে। সিবিএগুলো সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহে সবার জন্য সমান সেবা প্রাপ্তির পথে একটি কঠিন বাধা। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনে শুদ্ধাচার উৎকটভাবে অনুপস্থিত। ফলে সেবাপ্রত্যাশীরা ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। আর সার্বিকভাবে দেশে সুশাসনের অভাবে অন্যায়-অবিচার, দুর্নীতি, বৈষম্য, সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজির শিকার হচ্ছেন জনগণ এবং বিরোধী দল দমন-পীড়নের শিকার হচ্ছে।

২. শুদ্ধাচারের কনসেপটি সুশাসনের তত্ত্ব থেকে নিঃসৃত। শুদ্ধাচার সুশাসনের পূর্বশর্ত। আবার তারা একে অপরের পরিপূরক বটে। বাংলাদেশের দুর্নীতি ও অনাচারের ব্যাপক চর্চা ও বিস্তৃতির কারণে দাতা সংস্থা তথা উন্নয়ন সহযোগীরা সুশাসনকে ঋণ ও অনুদান প্রদানে পূর্বশর্ত হিসেবে নির্ধারণ করে। তারা তিনটি বিষয়কে সুশাসনের জন্য অপরিহার্য জ্ঞান করেন। এগুলো হলো- স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও অংশীদারিত্ব। এগুলোর অভাবে সুশাসন এবং শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠায় ব্যাঘাত ঘটে।

৩. তথ্য প্রকাশ কিংবা শেয়ার করার মানসিকতা আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোতে একেবারেই নেই। এর পেছনে ব্যক্তিগতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার তথা অপকর্ম উন্মোচিত হওয়ার আশঙ্কা কাজ করছে। এক কথায় দুর্নীতি স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠার পথে এক ধরনের অন্তরায়। এ জন্য দুর্নীতি নির্মূলকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। এ জন্য সরকার ও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)-কে ব্যাপক কর্মকৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন এবং আইনি প্রক্রিয়া জোরদার করতে হবে।

৪. আমাদের দেশের বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানে জবাবদিহিতা নেই। বিশেষ করে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে জবাবদিহিতার কোনো বালাই নেই। এসব প্রতিষ্ঠানে শুদ্ধাচার চর্চা তো দূরের কথা, চলছে চরম স্বেচ্ছাচারিতা। আইন ও বিধিবিধানের ব্যত্যয় ঘটিয়ে কিংবা ইচ্ছামাফিক এগুলো ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে স্বার্থ হাসিল করাই প্রথা বা আচার হয়ে গেছে। কোথাও সিস্টেম কাজ করছে না। সুশাসনের জন্য প্রয়োজন উত্তম আইনের শাসন এবং সিস্টেমের কঠোর অনুশীলন। একটি কথা আছে- Rule by the best law is preferable to the rule by the best man দুর্নীতির ঊর্ধ্বমুখী উলস্ফলন ঘটায় চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়েছে। কথায় আছে- মাছের পচন ধরে মাথায়। অতএব, ঊর্ধ্বতন সোপানে অধিষ্ঠিতদের সততা, দক্ষতা ও জবাবদিহিতার অনুকরণীয় নজির সৃষ্টি করতে হবে। আর তা শুরু করতে হবে রাজনৈতিক নেতৃত্ব থেকে। কেননা, দেশ তথা সরকার পরিচালনার ভার তাদের হাতেই।

৫. গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থায় উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় অংশীদারিত্ব সুশাসন তথা শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠা অপরিহার্য শর্ত। আমাদের দেশে অধিকাংশ ক্ষেত্রে উন্নয়ন প্রকল্প গৃহীত হয় তদবিরের ভিত্তিতে। আমাদের সংবিধানে ৫৯ অনুচ্ছেদে প্রশাসনিক প্রত্যেক একাংশে জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা শাসিত হওয়ার বিধান রয়েছে। বাস্তবে দেখা যাচ্ছে যে, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী করা তো দূরের কথা এগুলোকে অকেজো করে রাখা হয়েছে। সংবিধান লংঘন করে জেলা পরিষদগুলোতে প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে যাদের কোনো জবাবদিহিতা নেই। জেলা পরিষদের কোনো সদস্য না থাকায় প্রশাসকের জবাবদিহিতার অবকাশই বা কোথায়? আর প্রশাসকরা সরকারি দলের অনুগত লোক বিধায় প্রকল্প বাছাই এবং যত্রতত্র অনুদান প্রদানসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে চরম স্বেচ্ছাচারিতা প্রদর্শন করছেন। জেলা পরিষদের টাকায় শ্বশুরবাড়ির সামনের খালে ঘাটলা বানিয়ে দেওয়ার নজিরও আছে। প্রশাসকরা আত্মীয় তোষণ ও পক্ষপাতিত্বের দোষে দুষ্ট হওয়ায় সম্পদের অপচয় ও অপব্যয় ঘটছে। ঢাকা সিটি করপোরেশন দুটো চলছে বছরের পর বছর ধরে সরকারি কর্মকর্তাদের দ্বারা। এখানেও জবাবদিহিতার বালাই নেই। ইউনিয়ন পরিষদ ও উপজেলা পরিষদগুলোতে নির্বাচিত প্রতিনিধি থাকলেও এমপিদের ইচ্ছার কাছে তাদের আত্মসমর্পণ ছাড়া গত্যন্তর নেই।

৬. সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠান ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে নৈতিকতা ও সততার চর্চাও অত্যন্ত জরুরি। অনেক প্রতিষ্ঠানে স্বাধীনভাবে ও স্বেচ্ছায় কাজ করার প্রবৃত্তি নেই। সেবা প্রাপ্তির জন্য প্রয়োজন Speed money। সুপারভিশন ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা খুবই দুর্বল। ব্যাপক ও নিবিড় প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে প্রেষণা সৃষ্টি করার প্রয়াস নেওয়া যেতে পারে। সমস্যা হলো, দলীয় আনুগত্য প্রদর্শনের কারণে অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতা করেও পার পেয়ে যাচ্ছে। সরকারও এ ক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা রাখছে না। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তাদের ক্ষমতা প্রয়োগে আগ্রহী নয়। ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে দূরে অবস্থিত কিংবা ক্ষমতা থেকে ছিটকে পড়াদের এবং বিরোধী দলের ক্ষেত্রে ক্ষমতা প্রয়োগে সংস্থাটি অতি তৎপর বলে প্রতীয়মান হয়। ক্ষমতায় আসীন ব্যক্তিরা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছে। রাজনৈতিক অঙ্গীকার ছাড়া সহজে কিংবা অনায়াসে সমান আচরণ নিশ্চিত এবং সুশাসন ও শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। সুতরাং সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সমাজ থেকে দুর্নীতি এবং সব ধরনের অন্যায়-অবিচার, বৈষম্য, সন্ত্রাস ও দমন-পীড়ন বন্ধ করার জন্য দৃঢ় রাজনৈতিক অঙ্গীকার অপরিহার্য।

৭. জনসেবার নামে রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুণ্ঠনের মাধ্যমে রাজনীতিকে পুঁজিহীন ব্যবসায় পরিণত করেছেন একশ্রেণীর রাজনীতিক। এদের কথা ও কাজে আকাশ-পাতাল ফারাক। চিকিৎসা বিজ্ঞানে একে বলে Schizophrenia। এসব কারণে সুশাসন ও শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠা সুদূরপরাহত। আর সুশাসন ও শুদ্ধাচারের অভাবে বলি হচ্ছে সাধারণ জনগণ। সুতরাং সুশাসন ও শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠায় অংশীদারিত্বমূলক প্রশাসন তথা উন্নয়ন প্রশাসনের কোনো বিকল্প নেই। আর শাসন-প্রশাসনে চেক অ্যান্ড ব্যালান্স প্রতিষ্ঠায় সংবিধানে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনাও অত্যাবশ্যক বলে অনুভূত হচ্ছে।

৮. অতএব, দেশের তথা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা ভেবে রাজনীতিবিদ থেকে রাষ্ট্রনায়কের স্তরে উত্তরণ ঘটিয়ে ও দলীয় স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে জনগণের স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে হবে। এতে স্বল্প মেয়াদে অপ্রিয় হলেও দীর্ঘ মেয়াদে তারা লাভবান হবেন এবং দেশ ও জনগণ উপকৃত হবে। শুধু মধ্যম আয়ের দেশ কিংবা উন্নত দেশে পরিণত হওয়াই চূড়ান্ত লক্ষ্য হলে হবে না, এর সুফল সফলভাবে ও সমভাবে ভোগ করতে সুশাসন ও শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এ লক্ষ্যে উদার ও মুক্ত বাতাবরণে রাজনৈতিক সমাজ এবং বিভিন্ন পেশার প্রতিনিধিত্বকারী সুশীল সমাজের মধ্যে নীতি সংলাপ অতি জরুরি হয়ে পড়েছে। আর এ জন্য রাজনৈতিক নেতৃত্ব বিশেষ করে ক্ষমতাসীনদের ওপর সুশীল সমাজ ও অংশীজনদের প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করতে হবে।

Add a Comment