সুশাসনের হাল-হকিকত

দৈনিক সংগ্রাম, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৫
এম এ বাতেন


‘সু’ উপসর্গযোগে ‘সুশাসন’ শব্দটি গঠিত হয়েছে। ‘সু’ অর্থ হলো ভালো, উত্তম, উৎকৃষ্ট, সুন্দর, মধুর, শুভ ইত্যাদি। আর ‘সুশাসন’ হলো ন্যায়নীতি অনুসারে উত্তমরূপে সুষ্ঠুভাবে ও নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে দেশ বা রাষ্ট্র শাসন। সুশাসন হলো একটি কাঙ্ক্ষিত রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার প্রতিফলন। সময়ের প্রয়োজনে এবং শাসক ও শাসিতের সম্পর্কের ভিত্তিতে কোনো দেশের শাসন পদ্ধতির বিবর্তন হয়ে থাকে। শাসিতের কাম্য শুধু শাসন নয়, সুশৃঙ্খল ও নিয়মতান্ত্রিক শাসন- যাকে আমরা সুশাসন বলতে পারি। কোনো দেশে সুশাসন আছে কিনা তা বোঝার জন্য প্রথমে দেখতে হবে সে দেশে শাসকের বা সরকারের জবাবদিহিতা আছে কি-না এবং গণতান্ত্রিক পরিবেশে দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসনিক স্বচ্ছতা আছে কি-না।

সুশাসন একটি রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থাকে কাঙ্ক্ষিত উন্নয়নের চরম শিখরে পৌঁছে দেয়। সুশাসনকে এক প্রকার মানদণ্ডও বলা যায় যে মানদণ্ডের সাহায্যে একটি রাষ্ট্র বা সমাজের সামগ্রিক অবস্থা যাচাই করা যায়। যে রাষ্ট্র বা সমাজ যত বেশি সুশাসন দ্বারা পরিচালিত হয় সেই রাষ্ট্র বা সমাজ ততো বেশি অগ্রগতির দিকে ধাবিত হয়।
একজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সুশাসনের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন, ‘সুশাসন হলো একটি দেশের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সম্পদের কার্যকরী ব্যবস্থা, তবে ব্যবস্থাটি হবে উন্মুক্ত, স্বচ্ছ জবাবদিহিতামূলক ও ন্যায্য সমতাপূর্ণ।’

বিশ্বব্যাংকের ধারণাসূত্রে সুশাসন নিম্নে বর্ণিত বিষয়গুলো নিশ্চিত করে- ১. সরকারি কাজে দক্ষতা, ২. স্বাধীন বিচারব্যবস্থা, ৩. বৈধ চুক্তির প্রয়োগ, ৪. জবাবদিহিমূলক প্রশাসন, ৫. স্বাধীন সরকারি নিরীক্ষক, ৬. প্রতিনিধিত্বমূলক আইনসভার কাছে দায়বদ্ধতা, ৭. আইন ও মানবাধিকার সংরক্ষণ, ৮. বহুমুখী সাংগঠনিক কাঠামো ৯. গণমাধ্যমর স্বাধীনতা।

অপরপক্ষে, পাশ্চাত্যের রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ সুশাসন বলতে গণতান্ত্রিক শাসন ও গণতান্ত্রিক সরকারকে বুঝিয়েছেন। তারা সুশাসনের চারটি বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেছেন। এগুলো হলো-

  1. সুশাসন হলো অধিকতর রাজনৈতিক প্রক্রিয়া এবং জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে শাসনব্যবস্থা পরিচালনা।
  2. সুশাসন অবশ্যই আইনের শাসনের ওপর প্রতিষ্ঠিত।
  3. রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা।

প্রশাসনিক দক্ষতা ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা হবে শাসন কাঠামোর অন্যতম দিক।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী পিয়েরে ল্যান্ডের মিলস এবং ইসমাইল সেরাজেলডিন সুশাসনের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন, ‘জনগণের সুষ্ঠু চাহিদা, ন্যায্য অধিকার উপভোগের নিশ্চয়তা প্রদানের লক্ষ্যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা চর্চার মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনার প্রক্রিয়াই হলো সুশাসন।’ বাস্তবিকপক্ষে সুশাসনের বহুবিধ অর্থ উল্লেখ করা হলেও বাস্তবতার নিরিখে একটি দেশের সুশাসন সে দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থার উপর নির্ভরশীল। তবে সকল জাতীয় সরকার ও আন্তর্জাতিক সংস্থা সুশাসনের লক্ষ্যে রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক জবাবদিহিতা, স্বাধীন ও দক্ষ বিচারব্যবস্থা, শক্তিশালী সরকারি প্রতিষ্ঠান, স্বচ্ছ ও দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছে। মূলত সুশাসন এমন একটি শাসন প্রক্রিয়া যাতে সমাজের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি এবং রাষ্ট্রের কর্মকাণ্ডের মধ্যকার সুসমন্বিত মিল বিরাজমান থাকে।

উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে সুশাসনের যে সব আবশ্যকীয় উপাদান পাওয়া যায় তা নিম্নরূপ-

সরকারের বৈধতা এবং স্থায়িত্বের জন্য জনগণের সম্মতি ও অংশগ্রহণ প্রক্রিয়ার আবশ্যকতা, ২. সরকার ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার কর্মকাণ্ডের দায়িত্বশীলতা, ৩. তথ্যের সহজলভ্যতা, ৪. গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, ৫. সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্বচ্ছতা, ৬. সরকারি ও দাপ্তরিক কাজে জননিরীক্ষণ, ৭. দক্ষতা নির্মাণ, ৮. সময়োপযোগী নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, ৯. সুষ্ঠু সেবা প্রদান, ১০. আইনের শাসন ও মানবাধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন, ১১. নাগরিকের অধিকার সমুন্নত রাখা ও নিরাপত্তা বিধান, ১২. গণতন্ত্র সমুন্নত রাখা, ১৩. মুক্ত ও বহুভিত্তিক সমাজব্যবস্থা এবং ১৪. বিকেন্দ্রীকৃত ও কার্যকর স্থানীয় শাসন।

দেশের মানুষ সরকারের কাছে সর্বনিম্ন খরচ বা বিনিয়োগের মাধ্যমে সর্বোচ্চ ফলাফল প্রত্যাশা করে। সুশাসন তখনই ভালো হয় যখন সরকারের সিদ্ধান্ত ও কর্মগুলো জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা পূরণে সহায়ক হয় এবং সরকার জনগণের কাছে তার কর্মের জন্য দায়ী থাকে।

সুশাসন আইনের শাসন নিশ্চিত করে। এ ছাড়া এটি রাষ্ট্র বা সমাজে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক অগ্রগণ্যতাকে প্রাধন্য দেয় যা উন্নয়নের ক্ষেত্রে যে সকল সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় তাতে দরিদ্র ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর সিদ্ধান্তকে গুরুত্ব দেয়। সুশাসন শুধুমাত্র রাষ্ট্র বা সরকার নয়- বেসরকারি খাত এবং সুশীল সমাজকেও গুরুত্ব দেয়। কারণ, রাষ্ট্রের অগ্রগতিতে বেসরকারি খাতের ভূমিকা অনস্বীকার্য এবং সরকারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নির্ধারণে সুশীল সমাজের ভূমিকা অপরিসীম।
সুশাসনের ধারণার প্রেক্ষিতে সুশাসনের যে সব বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায় তা হলো-

১. অংশগ্রহণ: জাতি-ধর্ম-বর্ণ, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল নাগরিকের সমান অংশগ্রহণ হচ্ছে সুশাসনের প্রধান বৈশিষ্ট্য। অংশগ্রহণ হলো মানবাধিকার। প্রতিনিধি নির্বাচনে সকল নাগরিকের সমান অংশগ্রহণ থাকবে। এক্ষেত্রে প্রতিনিধি নির্বাচনে কোনো কারণে জনগণ বাধাগ্রস্ত হলে তা সুশাসনের অন্তরায় বলে বিবেচিত হবে। যে কোনো রজানৈতিক সংগঠন, ব্যক্তি বা গোষ্ঠী তাদের মতামত প্রকাশ ও দাবি উত্থাপন করার অবাধ অধিকার সংরক্ষণ করবে।
অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো প্রত্যেক নাগরিকের ভোটদান নিশ্চিত করা। সকল নাগরিক অবাধে ও নির্বিঘ্নে ভোটদানে অংশগ্রহণ করবে। এ ধরনের অংশগ্রহণ যেমন গণতন্ত্রকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে, তেমনি রজনৈতিক সমতায়নে সহায়তা করে। এই অংশগ্রহণ হতে হবে সকলের জন্য উন্মুক্ত, অবাধ ও নির্বিঘ্ন। সকলের অধিকার থাকবে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের। অংশগ্রহণ বিভিন্নভাবে নিশ্চিত হতে পারে- যেমন, রাজনৈতিক দল গঠন বা সভা-সমাবেশের মধ্য দিয়ে। এর অর্থ হচ্ছে- সকল নাগরিকের জন্য এ সব রাজনৈতিক কর্মসূচি উন্মুক্ত থাকবে- কখনো কারো দ্বারা বাধাগ্রস্ত হবে না।

অংশগ্রহণের একটি বড় উপাদান হচ্ছে- নাগরিকের ক্ষমতায়ন। একজন নাগরিক যখন তার সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা লাভ করে, তখন বোঝা যায় তার ক্ষমতায়ন হয়েছে। অর্থাৎ প্রতিপক্ষ তার ক্ষমতায়নে বাধা না দিলেই বোঝা যাবে তার ক্ষমাতয়ন নিশ্চিত হয়েছে। নিম্নোক্ত চারটি বিষয় কার্যকর হলে ক্ষমতায়ন নিশ্চিত হয়- ক. মতামত প্রদানের ক্ষমতা, খ. দক্ষতা, গ. সমস্যা চিহ্নিতকরণ এবং ঘ. বিচার ক্ষমতা।

২. আইনের শাসন: সুশাসনের অন্যতম দাবি হলো- একটি স্বচ্ছ আইনি কাঠামো থাকবে এবং এটি প্রতিটি মানুষের জন্য সমভাবে প্রযোজ্য হবে। অর্থাৎ ‘আইনের চোখে সবাই সমান’- এটি হবে সুশাসনের ভিত্তি। আইনের শাসনের উপস্থিতি ব্যতীত সুশাসন কায়েম হয় না। আইনের শাসনের অর্থ হলো আইনের প্রাধান্য স্বীকার করা এবং আইন মোতাবেক শাসন করা। অধ্যাপক এভি ডাইসি (Professor A.V. Diecy) আইনের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছেন, ‘আইনের শাসনের অর্থ হলো-

১. আইনের দৃষ্টিতে সকলেই সমান, ২. সকলের জন্য একই প্রকারের শাসনব্যবস্থা থাকবে, ৩. কাউকে বিনা অপরাধে গ্রেফতার করা যাবে না এবং ৪. বিনাবিচারে কাউকে আটক রাখা যাবে না। এছাড়া অভিন্ন বিচারালয়ের ব্যবস্থাও আইনের শাসনের অন্তর্ভুক্ত। আইনের শাসন যেখানে বর্তমান সেখানে জনগণের স্বাধীনতা বিরাজমান। আইনের শাসনের দ্বারা সাম্য স্বাধীনতা ও মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। এসব কারণে আইনের শাসন সুশাসনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।

৩. স্বচ্ছতা: স্বচ্ছতা বলতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া এবং সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া পরিপূর্ণ নিয়মতান্ত্রিকভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে কি-না তা বোঝায়। স্বচ্ছতা বলতে তথ্যের অবাধ প্রবাহ এবং তথ্য প্রাপ্তির সহজলভ্যতাকেও বোঝায়। আয়নায় যেমন সব কিছু পরিষ্কার দেখা যায়, স্বচ্ছতাও তদ্রুপ। স্বচ্ছতা বজায় থাকলে দুর্নীতির আশংকা থাকে না এবং নাগরিকদের কোনো প্রকার অন্যায় হয়রানির সম্ভাবনাও থাকে না। তাই সুশাসনের জন্য স্বচ্ছতা একটি বড় উপাদান।

৪. সংবেদনশীলতা: নাগরিকদের সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে কোনো প্রতিষ্ঠানকে বেঁধে দেয়া নির্দিষ্ট সময় কাঠামোকে সংবেদনশীলতা বোঝায়। অর্থাৎ যথাসময়ে নাগরিকদের সেবা প্রদান করতে হবে। কোনো প্রকার সময়ক্ষেপণ করে জনভোগান্তির সৃষ্টি করা যাবে না। তাহলে সুশাসনের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যাবে। তাই সংবেদনশীলতা সুশাসনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।

৫. ঐকমত্যে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে সহযোগিতা: একটি সমাজে বা রাষ্ট্রে বহু ক্রিয়াশীল গোষ্ঠী এবং বহুধা বিভক্ত মতাদর্শের উপস্থিতি বিদ্যমান থাকে। এক্ষেত্রে সুশাসনের দাবি হলো এ ভিন্ন ভিন্ন মত ও স্বার্থের মধ্য থেকে একটি বৃহৎ ঐকমত্যে পৌঁছানো সেখানে পুরো সমাজ বা রাষ্ট্রের প্রধান প্রধান দাবি ও স্বার্থের সমন্বয় ঘটে। ঐকমত্যের বিষয়গুলোকে কিভাবে সফল করা যায় সে সম্পর্কে একটি কর্মপন্থা নির্ধারণ করা জরুরি। এজন্য দরকার একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। যার দ্বারা টেকসই মানব উন্নয়ন সম্ভবপর করা যায় এবং জাতির মধ্যে বিরাজমান দ্বন্দ্বকে হ্রাস করা যায়। এ দায়িত্ব পালনে সরকারের পাশাপাশি বিরোধী দলের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। অর্থাৎ সমাজ ও রাষ্ট্রে যত বেশি ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হবে সেই সমাজ ও রাষ্ট্রে ততো বেশি সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। যেহেতু সুশাসনের ফল সবাই ভোগ করে তাই সরকার ও বেসরকারি উভয়ের পারস্পরিক সহযোগিতা একান্ত জরুরি।

৬. সাম্য: সমাজে বা রাষ্ট্রে প্রত্যেক নাগরিক সমান অধিকার ভোগ করবে। এখানে নারী-পুরুষ, সরকারি-বেসরকারি, আশরাফ-আতরাফ, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ধনী-গরিব কোনো ভেদাভেদ থাকবে না। সকলেই সমান সুযোগ ও সেবা পাবে। কাউকে বিশেষ কোনো সুযোগ-সুবিধা না দিয়ে সকলের জন্য সমান সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা থাকবে। সুশাসন সাম্যকে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ব্যক্তিগত, আইনগত অর্থাৎ সকল ক্ষেত্রেই প্রয়োগ করে থাকে। রাজনীতিতে অংশগ্রহণ, ন্যায্য মজুরি পাওয়া, সামাজিক নিরাপত্তা লাভ, আইনের সমান সুযোগ লাভ প্রভৃতি বিষয় সাম্যের আওতাভুক্ত।

৭. কার্যকারিতা ও দক্ষতা: কার্যকারিতা ও দক্ষতার অর্থ হলো এমন প্রতিষ্ঠান ও কার্য প্রক্রিয়া স্থাপন করা যা রাষ্ট্রীয় সম্পদসমূহের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করে নাগরিকের সর্বোচ্চ প্রয়োজন পূরণ করে। সুশাসনে দক্ষতার বিষয়টির সাথে প্রাকৃতিক সম্পদের টেকসই ব্যবহার এবং পরিবেশ-প্রতিবেশের সংরক্ষণকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এর সাথে পরিকল্পনা গ্রহণ ও তা বাস্তবায়নের বিষয়টিও গভীরভাবে জড়িত। শুধু পরিকল্পনা গ্রহণ করলেই চলবে না। তা যথাযথভাবে যথাসময়ে বাস্তবায়িত করতে হবে।

৮. জবাবদিহিতা:
জবাবদিহিতা হলো সুশাসনের মূল চাবিকাঠি। জবাবদিহিতা হচ্ছে সম্পাদিত কর্ম সম্পর্কে একজন ব্যক্তির ব্যাখ্যাদানের বাধ্যবাধকতা। এক্ষেত্রে সরকারের যেমন জনগণের কাছে তার কর্মের জন্য জবাবদিহি করতে হবে, তেমনি অন্যান্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেরও জবাবদিহি করতে হবে। জবাবদিহিতা না থাকলে সরকার স্বোচ্ছাচারী হতে পারে। সরকার স্বেচ্ছাচারী হলে সুশাসন থাকে না।
জবাবদিহিতার ক্ষেত্রে প্রশাসনিক বা আমলাতান্ত্রিক জবাবদিহিতার গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। রাজনৈতিক জবাবদিহিতা যদি দুর্বল হয় তবে তা সামাজিক ও অর্থনৈতিক- উভয় খাতকে প্রভাবিত করে। দুর্নীতি কমানোর ক্ষেত্রে রাজনৈতিক জবাবদিহিতা অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

রাজনৈতিক জবাবদিহিতার দু’টি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র রয়েছে। ক্ষেত্র দু’টি হলো-
ক) কার্যকরীকরণ: রাজনৈতিক জবাবদিহিতার প্রথম শর্ত হচ্ছে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। ‘অবাধ’ অর্থ- প্রয়োজনীয় স্বাধীনতা ব্যবহারের সমান সুযোগ। ‘নিরপেক্ষ’ অর্থ- নির্বাচনী আইনের প্রশাসনিক নিরপেক্ষতা। একটি নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর নির্বাচন হওয়া এবং সেটি প্রশাসনের সহায়তায় নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠিত হবে। গণমাধ্যমগুলো জনগণ এবং সমর্থকদের মতামত তুলে ধরবে সেখানে সরকারের কোনো একচেটিয়া প্রভাব ও প্রাধান্য থাকবে না।

খ) জবাবদিহি: রাজনৈতিক জবাবদিহিতার আরেকটি শর্ত হচ্ছে জবাবদিহি। গণমাধ্যমে রাজনীতিবিদদের দ্বারা জনগণ পূর্ণ জবাবদিহিতা এবং সমর্থন গ্রহণ করে। দুর্নীতি, অর্থের বিনিময়ে ক্ষমতা দখল এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন এগুলো প্রকাশ করার জন্য স্বাধীন গণমাধ্যম প্রয়োজন। জবাবদিহিতার জন্য আইনের প্রয়োজন, যেগুলো নির্বাহী সদস্যদের জবাবদিহি করতে বাধ্য করে। জবাবদিহির অপর গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে- বিরোধী রাজনৈতিক দলের কার্যকরী অংশগ্রহণ। বিরোধী রাজনৈতিক দলের কার্যকরী অংশগ্রহণ ছাড়া সরকার সুশাসন কায়েমে অনিচ্ছা প্রকাশ করতে পারে, দুর্নীতিপরায়ণ হতে পারে, স্বেচ্ছাচারী হতে পারে।

৯. বিকেন্দ্রীয়করণ: কোনো দেশের যাবতীয় কার্যাবলি শুধুমাত্র কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে সুশৃঙ্খলভাবে সম্পাদন করা সম্ভবপর হয় না; তাই কেন্দ্রীয় সরকারকে তার কিছু কিছু ক্ষমতা স্থানীয় পর্যায়ে ছেড়ে দিতে হয়। এর ফলে সরকারের কার্যাবলি দক্ষতার সাথে সুষ্ঠুভাবে সম্পাদিত হয়। একেই ক্ষমতা বিকেন্দ্রীয়করণ বলা হয়। একটি কার্যকরী বিকেন্দ্রীয়করণ স্থানীয় পর্যায়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় ব্যাপক সুযোগ-সুবিধা প্রদান করতে পারে এবং জাতীয় পর্যায়ে সুশাসনের উন্নতিতে সাহায্য করে। বিকেন্দ্রীয়করণের ফলে স্থানীয় পর্যায়ে জনগণের চাহিদা পূরণ অধিকতর কার্যকরী হয়, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং স্থানীয় পর্যায়ে ক্ষমতায়ন হয়।

১০. স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থা: একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থার উপস্থিতি সুশাসনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থা ভিন্ন সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। সরকার শাসনকার্য পরিচালনা করতে গিয়ে অনেক সময় আইন-বহির্ভূত আচরণ করতে পারে। বিচারবিভাগ সরকারকে সঠিক পথে রাখার জন্য রুল জারি করতে পারে। অথবা সরকার যদি কোনো নাগরিকের অধিকারে হস্তক্ষেপ করে তাহলে ঐ নাগরিক বিচার বিভাগের মাধ্যমে তার অধিকার ফিরে পেতে পারে। যে দেশের বিচারবিভাগ যত বেশি দক্ষতা ও নিরপেক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করতে পারে সে দেশের সুশাসনের ভিত ততো বেশি মজবুত হয়। বিচার বিভাগ শাসন বিভাগকে সুনির্দিষ্ট গতিপথে পরিচালিত হতে সাহায্য করবে এবং নাগরিকের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ করে ও আইনের শাসন অক্ষুণ্ন রেখে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সজীব ও প্রাণবন্ত রাখে। তাই সুশাসন ও নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থা একে-অপরের পরিপূরক হিসেবে বিবেচিত। উভয়ের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এক ও অভিন্ন- নাগরিকদের কল্যাণ সাধন করে একটি সুষ্ঠু, স্বাধীন ও সমৃদ্ধশালী সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন করা।

সুশাসন হলো একটি প্রত্যাশিত রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার প্রতিফলন। বর্তমান বিশ্বে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার সুশাসনের ওপর সবিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। সুশাসনের মাধ্যমেই দেশের মানুষ তাদের আগ্রহ বা প্রত্যাশাকে প্রকাশ করতে পারে, তাদের অধিকার ভোগ করে এবং তাদের চাহিদাগুলো পূরণ করতে পারে। সুশাসনের ফলে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক সম্পদগুলোর টেকসই উন্নয়ন ঘটে থাকে। বস্তুত রাষ্ট্রের সকল ক্ষেত্রে উন্নয়নের জন্য সুশাসন অত্যাবশ্যক।

সুনির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নয়- রাষ্ট্রের সকল দিক ও পর্যায়ের উন্নয়নের জন্য সুশাসন জরুরি। রাষ্ট্রের নাগরিকদের জন্য শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, মৌলিক মানবাধিকার নিশ্চিত করা। সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠা করা, মানবসত্তার মর্যাদা নিশ্চিত করা, নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা। নাগরিকদের মধ্যে সম্পদের সুষম বণ্টন ও সুষম সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা, ন্যায়ভিত্তিক, দুর্নীতিমুক্ত ও শুদ্ধাচারী সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন হলো সুশাসন প্রতিষ্ঠা। জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নেতৃত্বে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হলে আইনের শাসন, প্রশাসনের সর্বস্তরে গণতান্ত্রিক শাসন, মানবাধিকার সংরক্ষণ, সমতা, ন্যায়পরায়ণতা, দায়বদ্ধতা, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে। পাশাপাশি সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হলে সাধারণ জনগণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন এবং তাদের প্রতি শোষণ-বঞ্চনার অবসান ঘটানো সম্ভবপর হবে।

সনুশাসন যখন থাকে না, তখন সরকারি সম্পদের অপচয়ের পাশাপাশি রাষ্ট্রের স্বার্থের পরিপন্থী নীতি-নির্ধারণের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা এবং বেসরকারি খাতের প্রতি সহযোগিতার অভাব থাকে। বর্তমানে বিশ্বের সর্বত্রই সরকারি খাতের পাশাপাশি নাগরিকদের কর্মসংস্থানে বেসরকারি খাতও যথেষ্ট অবদান রাখছে। তাই বেসরকারি খাতের প্রতি সরকারের সহযোগিতা না থাকলে রাষ্ট্রের বেকারত্ব বাড়বে। বেকারত্ব বাড়লে দারিদ্র্য বাড়বে। সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হলে সরকারি সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার হবে এবং দারিদ্র্যবিমোচন হবে এবং বেসরকারি খাতে কর্মসংস্থান বাড়বে।

উপসংহারে এসে আমরা বলতে পারি, দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হলে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্য বিমোচন হবে। বেকারত্ব দূর হবে, কর্মসংস্থান বাড়বে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। জবাবদিহিতামূলক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে। দুর্নীতিমুক্ত সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে। গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাবে- দেশ সুখী-সমৃদ্ধশালী হবে, ক্রমান্বয়ে উন্নতির চরম শিখরে উন্নীত হবে।

Add a Comment