সুশাসনের অন্তরায় : উত্তরণের উপায়

দৈনিক সংগ্রাম, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৬
এম এ বাতেন :


সুশাসন হলো একটি কাঙ্ক্ষিত রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার প্রতিফলন। আধুনিক বিশ্বের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় সুশাসন প্রতিষ্ঠানকে রাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে বিবেচনা করা হয়। সুশাসনের মাধ্যমেই নাগরিকগণ তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করতে পারে, তাদের অধিকার ভোগ করে এবং তাদের চাহিদাগুলো মেটাতে পারে। সুশাসনের ফলে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক সম্পদগুলোর টেকসই উন্নয়ন ঘটে থাকে। তাই রাষ্ট্রের সকল ক্ষেত্রেই উন্নয়নের জন্য সুশাসন অত্যাবশ্যক। সুশাসন ব্যতীত রাষ্ট্রের কোনোরূপ উন্নয়ন সম্ভব নয়।

যে দেশে সুশাসন যত বেশি সুদৃঢ়, সে দেশ ততো বেশি উন্নত। তবে সুশাসন প্রতিষ্ঠা সহজ নয়। এজন্য অনেকগুলো চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে হয়। সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে যেসব চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে হয় তা নিম্নরূপ :

১. শান্তি ও স্থিতিশীলতার সঙ্কট: যুদ্ধ, জাতিগত দাঙ্গা, ধর্মীয় উগ্রবাদ যদি কোনো দেশে বিরাজমান থাকে, তবে সেখানে জীবন, স্বাধীনতা ও সম্পদ হুমকির সম্মুখীন হয়, মানবাধিকার ও মানবতা ভূলুণ্ঠিত হয়। পাশাপাশি ছিনতাই, রাহাজানি, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ইত্যাদি যেকোনো দেশে সর্বদাই ঘটে থাকে। এ কারণে রাষ্ট্রে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বিনষ্ট হয়। এ সকল অবস্থা নাগরিক জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে। নাগরিকগণ একটা ভীতির মধ্যে কালাতিপাত করে। সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এটি একটি ভয়াবহ সমস্যা।

২. দারিদ্র্য: সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এটি একটি অন্যতম বাধা। দারিদ্র্য এবং সুশাসন কখনো একসাথে চলতে পারে না। দুর্ভিক্ষ, অনাহার, অর্ধাহার, অপুষ্টি, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর অপ্রতুলতা, নিত্যপণ্যের মূল্যের সীমাহীন ঊর্ধ্বগতি এগুলো সুশাসনের অন্তরায় সৃষ্টি করে। দারিদ্র্য মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণের প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করে। মুক্ত ও স্বাধীনভাবে জীবনযাপনের পথে দারিদ্র্য মানুষের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। দারিদ্র্যকে মোকাবিলা করতে না পারলে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা যায় না।

৩. ক্ষমতার ভারসাম্য: রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গের মধ্যে ক্ষমতার বণ্টন ও ভারসাম্য আনয়ন সুশাসন প্রতিষ্ঠার প্রধন নিয়ামক। সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে আইন, বিচার ও শাসন বিভাগের মধ্যে নিয়মতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতার বণ্টন থাকতে হবে। এ ক্ষেত্রে একটি স্বাধীন বিচার বিভাগ থাকতে হবে এবং জনপ্রতিনিধিদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে যথাযথ ক্ষমতাসম্পন্ন একটি আইন সভা থাকতে হবে। এছাড়া নির্বাচন কমিশন, মানবাধিকার কমিশন, মহাহিসাব নিয়ন্ত্রক প্রভৃতি সুশাসন প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। তাই এসব প্রতিষ্ঠানের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ ব্যতীত সুশাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। কেননা, এসব প্রতিষ্ঠান সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে।

৪. গতানুগতিক আমলাতন্ত্র: সুশাসন প্রতিষ্ঠায় দক্ষ আমলার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। অনেক সময় আমলারা তাদের সিদ্ধান্ত গোপন রাখেন। এতে জনসাধারণ ভোগান্তিতে পড়ে। আমলারা তাদের কার্যক্রমে জটিলতার সৃষ্টি করেন। তখন ‘লাল ফিতার দৌরাত্ম্যে’ সুশাসন বিঘ্নিত হয়। গতানুগতিক আমলাতন্ত্র তাই সুশাসনের অন্তরায়।

৫. দুর্নীতি: সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হলো দুর্নীতি। যে কাজ মানুষের বিবেককে তাড়িত করে সাধারণভাবে তাই দুর্নীতি। রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, সামাজিক ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি খাটিয়ে অবৈধ সুযোগ নেয়া, কারো সম্পদ ও সম্পত্তি জবর দখল করা, জনগণের অধিকার ভোগে বিঘ্ন সৃষ্টি এ সবই দুর্নীতির পর্যায়ভুক্ত। খাদ্যে ভেজাল, নকল ওষুধ তৈরি, ওজনে কম দেয়া, খাদ্যসামগ্রীতে ফরমালিন দেয়া সর্বোপরি আইন ফাঁকি দিয়ে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষা করাও দুর্নীতির অন্তর্ভুক্ত। ক্ষমতার অপব্যবহারই দুর্নীতি। দুর্নীতি জনগণের দুর্ভোগ বাড়ায়। দুর্নীতি জাতীয় উন্নয়নের অন্তরায় এবং দুর্নীতি হলো দারিদ্র্যের মূল কারণ। এসব কারণে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় দুর্নীতি মস্ত বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষ করে প্রশাসন ও রাজনীতিতে যদি দুর্নীতি বাসা বাঁধে তবে সুশাসন পথ হারায়।

৬. অগণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা: সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অন্যতম সমস্যা হলো গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থার অভাব। গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা ছাড়া সুশাসন প্রতিষ্ঠা হয় না। সুশাসন প্রতিষ্ঠিত করতে হলে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হবে। গণতন্ত্র যখন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাবে তখন তার প্রতিষ্ঠিত কার্যাবলি থাকবে। আর এ কার্যাবলি সমাজকে শান্তিপূর্ণ ও সুশৃঙ্খল রাখবে। সুশাসন প্রতিষ্ঠার একটি সমস্যা হলো শান্তি ও স্থিতিশীলতার অভাব। শান্তি ও স্থিতিশীলতার অভাবও দূর হয় গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের দ্বারা। গণতন্ত্র হলো কতকগুলো মূল্যবোধ, শিষ্টাচার, আদর্শ, মানব আচরণ ও মানব সম্পর্কের নিয়ন্ত্রক। কেবল নির্বাচন এবং তার মাধ্যমে ক্ষমতার পালাবদলের দ্বারা গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয় না। গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় নাগরিকদের সাধারণ ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটে। পরস্পরের প্রতি সহনশীল হয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের প্রতিফলনই হলো সাধারণ ইচ্ছা। তাহলে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সকল সংগঠন, প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক দল এমন কি পরিবারের সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের প্রতিফলন থাকতে হবে। এ দৃষ্টিকোণ থেকে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত না হলে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয় না। গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা যদি শুধু নামসর্বস্ব হয় তবে স্বৈরাচারিতা, স্বেচ্ছাচারিতার জন্ম হবে যা সুশাসনের আকাঙ্ক্ষাকে দুর্লঙ্ঘ করে তোলে।

৭. নেতৃত্বের সঙ্কট: সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে দক্ষ ও গণতান্ত্রিক নেতৃত্বের প্রয়োজন হয়। নেতৃত্ব হবে গণতন্ত্রের মূল্যবোধসম্পন্ন। এরূপ নেতৃত্ব নিজের দলের চেয়ে দেশের জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতকে প্রাধান্য দেবে। সাধারণ নাগরিকদের নিকট থেকে তাদের চাওয়া-পাওয়া প্রত্যাশা সম্পর্কে অবগত হবে। সুশাসনের অন্তরায়সমূহ চিহ্নিত করে তা দূরীকরণে উদ্যোগ নিবে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধসম্পন্ন নেতৃত্ব কখনোই শাসন ক্ষমতা বা রাজনৈতিক পদ আঁকড়ে ধরে রাখতে চাইবে না। নামমাত্র গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নয় বরং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ লালন করে এমন নেতৃত্বের প্রয়োজন।
বর্তমান সময়ে গণতন্ত্র হলো প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র। এ গণতন্ত্রের সফলতাও বহুলাংশে নির্ভর করে নেতৃত্বের গুণাগুণের ওপর। দক্ষ ও সুযোগ্য নেতৃত্বই পারে একটি রাষ্ট্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে। দক্ষ ও যোগ্য নেতৃত্বের সঙ্কট দেখা দিলে রাষ্ট্রটি গণতন্ত্র ও সুশাসন থেকে বহুদূরে সরে যায়।

৮. নাগরিক অসচেতনতা: সুশাসন প্রতিষ্ঠার আরেকটি অন্যতম বাধা হলো নাগরিকদের সচেতনতার অভাব। নাগরিকগণ যদি তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন না হয় তাহলে সুশাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয় না। নাগরিক সচেতনতা সৃষ্টির অন্তরায় হলো শিক্ষার অভাব। এজন্য শিক্ষিত জাতি দরকার। প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্রের মৌলিক উপাদান হলো নির্বাচন। নির্বাচনের মাধ্যমেই জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়। কিন্তু জনগণ যদি সচেতন না হয় তাহলে অসৎ, অযোগ্য, দুর্নীতিবাজ প্রতিনিধি নির্বাচিত হতে পারে। সুশাসন প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয় উপাদান যেমন আইনের শাসন, মানবাধিকার সংরক্ষণ, সমাজের সকল স্তরে নারী-পুরুষের মধ্যে সমতা, সমাজের সকল শ্রেণীর প্রতি ন্যায়পরায়ণতা, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা চর্চা প্রভৃতির কার্যকর ভূমিকা পালনের জন্য দরকার নাগরিক সচেতনতা। সচেতনতার অভাব সুশাসন প্রতিষ্ঠার অন্যতম অন্তরায়।


৯. কর্তৃত্বমূলক ক্ষমতা কাঠামো: ক্ষমতা কাঠামো যদি কর্তৃত্বমূলক হয় তবে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয় না। ক্ষমতা কাঠামো মূলত রাজনৈতিক ব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল। তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোতে নামসর্বস্ব গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা কার্যকর আছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার আনুষ্ঠানিক রীতিনীতিসমূহ যেমন- সার্বজনীন ভোটাধিকার, বাক-স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, সভা-সমিতির অধিকার প্রভৃতি বহাল থাকে ঠিকই কিন্তু কর্তৃত্বমূলক ক্ষমতার জন্য তা কার্যকর হয় না। শাসকগোষ্ঠী গণতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতাপ্রাপ্ত হলেও ক্ষমতা চর্চা করে স্বেচ্ছাচারিতার সাথে। এছাড়া এসব দেশে সনাতনী উত্তরাধিকার ভিত্তিক ক্ষমতা কাঠামোও বজায় থাকে। এর ফলে কোনো ব্যক্তি নির্দিষ্ট কোনো শ্রেণীতে জন্মগ্রহণ করার কারণে নাগরিকগণ মনে করে যে, সে ভবিষ্যৎ শাসন ক্ষমতার কর্ণধার হবে। কর্তৃত্বমূলক ক্ষমতা কাঠামোতে নাগরিকগণ রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করে ঠিকই কিন্তু তারা মনে করে যে, তারা নেতা হতে পারবে না। নেতা হবেন যারা বংশ পরম্পরায় নেতৃত্ব দিয়ে এসেছেন তাদের সন্তানরাই। কর্তৃত্বমূলক ক্ষমতা কাঠামোতে স্বাধীনভাবে গণতন্ত্রের চর্চা না হয়ে পরিবারতন্ত্রের চর্চা হয়।

১০. প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের অভাব: সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এটি একটি বড় বাধা। প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ ছাড়া টেকসই উন্নয়ন সম্ভব হয় না। আর টেকসই উন্নয়ন ব্যতীত সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয় না। সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সবচেয়ে বেশি দরকার হলো গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ। গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠায় সরকার ব্যর্থ হলে সুশাসন মুখ থুবড়ে পড়ে।

১১. ই-গভর্ন্যান্সের অনুপস্থিতি: দক্ষ, অংশগ্রহণমূলক ও স্বচ্ছ শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য ই-গভর্ন্যান্স প্রতিষ্ঠা গুরুত্বপূর্ণ। ই-গভর্ন্যান্স ছাড়া বর্তমান সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা বড়ই কঠিন। ই-গভর্ন্যান্সের অনুপস্থিতি সুশাসন প্রতিষ্ঠার বিরাট অন্তরায়। প্রশাসনিক ব্যবস্থা গতানুগতিক হয়ে থাকলে নাগরিক পর্যায়ে স্বল্পতর সময় ও স্বল্প ব্যয়ে সেবা পৌঁছানো সম্ভব হয় না। এতে করে নাগরিকদেরও যেমন ভোগান্তি বাড়ে, তেমনি প্রশাসনিক ব্যয়ও অনেক বেড়ে যায়। বর্তমান সময়ে পৃথিবী তথ্য-প্রযুক্তিতে অনেক বেশি অগ্রসর হয়েছে। সে অগ্রসরতাকে কাজে লাগিয়ে উন্নত বিশ্বের রাষ্ট্রগুলো ই-গভর্ন্যান্সের প্রয়োগ ঘটাচ্ছে। এ অবস্থায় কোনো রাষ্ট্র বা সরকার যদি ই-গভর্ন্যান্সের প্রয়োগ ঘটাতে অনীহা দেখায়,তবে তা অবশ্যই সুশাসন প্রতিষ্ঠার অন্তরায় হিসেবে দেখা দিবে।

# সুশাসনের অন্তরায়গুলো উত্তরণের উপায়: সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে যেসব অন্তরায় লক্ষ্য করা যায় তা নিম্নোক্ত উপায়ে উত্তরণ সম্ভব:

১. নাগরিক সচেতনতা বৃদ্ধি: সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন নাগরিকদের অংশগ্রহণ। নাগরিকরা যদি সচেতন হয় তাহলে সুশাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে নাগরিকদের শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে হবে। তাহলে তাদের সচেতনতা বৃদ্ধি পাবে। সুশাসনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার জন্য সচেতনতা প্রয়োজন। নাগরিকগণ যদি তাদের অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হয়, তবে তাদের পক্ষে অংশগ্রহণ সম্ভব হবে। নাগরিকদের সচেতনতা বৃদ্ধি পেলে সুশাসন প্রতিষ্ঠা সহজতর হবে।

২. শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠা: সুশাসন প্রতিষ্ঠার সমস্যা শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দূর করা যায়। শুদ্ধাচার বলতে সাধারণভাবে নৈতিকতা ও সততার দ্বারা প্রভাবিত আচরণগত উৎকর্ষতাকে বোঝায়। ব্যক্তি পর্যায়ে শুদ্ধাচারের অর্থ হলো কর্তব্যনিষ্ঠা ও সততা তথা চরিত্রনিষ্ঠা। রাষ্ট্রের মূল চালিকাশক্তি হলো নাগরিক। নাগরিকগণ রাষ্ট্রের সকল কাজের অংশীদার। তাই সুশাসন প্রতিষ্ঠিত করতে চাইলে নাগরিকদের শুদ্ধাচারের চর্চা করতে হবে। শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠা পেলে দুর্নীতি হ্রাস পায়। শুদ্ধাচারে নাগরিক শুদ্ধ হলে অন্যায় কর্ম থেকে বিরত থাকবে। সামাজিক ও রাষ্ট্রিক অনাচার দূর হবে। নীতি-নৈতিকতা, পাপবোধ জাগ্রত হলে নাগরিক সৎ পথ অবলম্বন করবে। শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠিত হলে সুশাসনের পথ সুগম হবে।


৩. দুর্নীতি প্রতিরোধ:
কোন দেশের সুশাসনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পূর্বশর্ত হলো দুর্নীতি। দুর্নীতি জাতীয় সম্পদের সঠিক বণ্টনে বাধা প্রদান করে এবং ধনী ও গরিবের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি করে। সুশাসন প্রতিষ্ঠিত করতে হলে অবশ্যই দুর্নীতিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। নাগরিকদের তথ্যপ্রাপ্তির অধিকার প্রতিষ্ঠা, সরকারি কাজে জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠা, স্বচ্ছ সংগ্রহ পদ্ধতি প্রতিষ্ঠা, নৈতিকতা ও মূল্যবোধের উন্নয়ন সাধন, কার্যকর ন্যায়পাল প্রতিষ্ঠা, দুর্নীতিবিরোধী সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে কার্যকরভাবে দুর্নীতি প্রতিরোধ করা সম্ভব। আর তার ফলে রাষ্ট্র ও সমাজে সুশাসনের পথ নিষ্কণ্টক, নির্ঝঞ্ঝাট ও সুগম হবে।

৪. গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ: সুশাসন প্রতিষ্ঠায় গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে কার্যকর করতে হবে। গণতন্ত্র মানে শুধু জনগণের ভোটে নির্বাচিত হওয়া নয়। নির্বাচন নাগরিকদের মত প্রকাশের একটি তাৎপর্যবহ শর্ত বটে। গণতন্ত্রের আরো সহযোগী শর্ত রয়েছে। গণতন্ত্র রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের জনগণের কল্যাণের জন্য, রাষ্ট্রকে আধুনিকতার উচ্চ শিখরে পৌঁছে দেবার জন্য কাজ করে। গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ হলো জনগণের হিসাব-নিকাশ কড়ায় গণ্ডায় শোধ করা। নাগরিকের মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে উপভোগ করা, তার শিক্ষা-দীক্ষা, নিরাপত্তা এবং জীবন যাপনের প্রতিটি ক্ষেত্রকে সুখময় করে তোলা। গণতন্ত্র একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, রাষ্ট্রের চোখ দিয়ে জনগণকে দেখা নয়, বরং জনগণের চোখ দিয়ে রাষ্ট্রকে দেখার অনুশীলনই গণতন্ত্রের লক্ষ্য। তাই গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ প্রয়োজন। রাষ্ট্রের সকল পর্যায়ে গণতন্ত্রের সুসংহত চর্চা করে সুশাসনের ভিত মজবুত ও সৃদৃঢ় করা যায়। বিশেষ করে রাজনৈতিক দলগুলোর গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চা সুশাসন কায়েমে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।

৫. দারিদ্র্য বিমোচন: সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে দারিদ্র্য একটি অন্যতম বাধা। এ জন্য সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে দারিদ্র্য বিমোচন করা খুবই জরুরি। দারিদ্র্য নাগরিকদের অধিকার অর্জনের ক্ষেত্রে বাধার সৃষ্টি করে। দারিদ্র্য নানা ধরনের অসামাজিক কার্যকলাপ এবং সামাজিক অপরাধ সৃষ্টির অন্যতম কারণ। দারিদ্র্যের কারণে মানুষ হতাশায় ভোগে, মানুষ মানবেতর জীবন যাপনে বাধ্য হয়। দারিদ্র্য একাধারে সামাজিক অনেক সমস্যার কারণ এবং বিভিন্ন সামাজিক সমস্যার ফলও বটে। এসব কারণে সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে দারিদ্র্য বিমোচনে পদক্ষেপ গ্রহণ অত্যাবশ্যক। দারিদ্র্য বিমোচনে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করে দারিদ্র্য বিমোচন করা হলে সুশাসনের পথ প্রশস্ত হবে, সুগম হবে।

৬. স্বশাসিত রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান: সুশাসনের পূর্বশর্ত হচ্ছে সর্ব পর্যায়ে, বিশেষ করে স্থানীয় পর্যায়ে স্বশাসিত রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান কার্যকর থাকা। স্থানীয়ভাবে জনগণের দ্বারা নির্বাচিত, স্থানীয় জনগণের জন্য এবং স্থানীয় জনগণের নিকট দায়ী প্রতিষ্ঠানসমূহ হলো স্বায়ত্তশাসিত স্থানীয় প্রতিষ্ঠান। নিজ নিজ এলাকার জনপ্রতিনিধি দ্বারা নিজ নিজ এলাকার উন্নয়ন ও জনগণের প্রত্যাশা পূরণ যতটা সহজ, কেন্দ্রীয়ভাবে ততটা সহজ নয়। তাই স্থানীয় প্রশাসন স্বশাসিত হওয়া জরুরি। সুশাসন প্রতিষ্ঠায় তাই স্বশাসিত রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান থাকা আবশ্যক। তাহলে সুশাসনের প্রতিষ্ঠা বহুলাংশে ফলপ্রসূ হবে।

৭. উগ্রবাদের বিস্তার রোধ: যে কোন প্রকার উগ্রবাদ সুশাসনের পথে প্রধান অন্তরায়। উগ্রবাদের বিস্তার হয়ে থাকে নাগরিকদের সুশিক্ষা ও সচেতনতার অভাবে, দারিদ্র্য, বেকারত্ব, উন্নয়ন বৈষম্যে, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বন্ধ্যত্বের কারণে। সুশাসন প্রতিষ্ঠায় ধর্মীয়, জাতিগত, সাম্প্রদায়িক উগ্রবাদ নিয়ন্ত্রণ অতীব জরুরি। উগ্রবাদ প্রতিরোধে সচেতনতা সৃষ্টি, দারিদ্র্য বিমোচন, শিক্ষা কাঠামো সংস্কার, উন্নয়ন বৈষম্য কমানো আবশ্যক। উগ্রবাদ রাষ্ট্রের শান্তি ও স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করে, নাগরিকের জীবনকে আতঙ্কিত ও ভীতিগ্রস্ত করে। উগ্রবাদের বিস্তার রোধে দলমত নির্বিশেষে সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। তাহলে রাষ্ট্র ও সমাজে সুশাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে। সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য আইনের শাসন, মানবাধিকার সংরক্ষণ, সমাজের সকল স্তরে নারী-পুরুষের সমতা, সকল শ্রেণীর প্রতি ন্যায়পরায়ণতা, স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতার চর্চা, সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও সম্পদের বিকেন্দ্রীকরণ অত্যন্ত জরুরি। তবেই সুশাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব, উগ্রবাদ বিস্তার রোধ সম্ভব।

৮. গণমুখী সেবা উদ্ভাবন: সুশাসনের সমস্যা সমাধানের অন্যতম অনুষঙ্গ হলো গণমুখী সেবা উদ্বোধনে গুরুত্ব দেয়া। জনগণের সেবায় নিত্য নতুন উদ্ভাবনার সৃষ্টি করতে হবে। সুশাসন প্রতিষ্ঠায় গণমুখী সেবা উদ্ভাবনের প্রয়োজন অবশ্যম্ভাবী। কারণ দ্রুত পরিবর্তনশীল প্রেক্ষাপটে নতুন নতুন উদ্ভাবনা জনগণের সেবায় কাঙ্ক্ষিত ফল লাভে কার্যকর ভূমিকা পালন করে। এর অর্থ হলো গণমুখী সেবা অধিকতর উন্নত করা, স্বল্প সময় সেবা প্রদান, কম ব্যয়ে সেবা প্রদান। জনগণ সর্বোচ্চ সেবা পেতে চায় সর্বনিম্ন খরচ করে। এটি কার্যকর হলে সুশাসনের প্রতিষ্ঠা সহজতর হবে।

# সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সরকার ও নাগরিকদের তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তবে সরকারের ভূমিকাই অধিক গুরুত্বপূর্ণ। সরকার রাষ্ট্রের পরিচালক হিসেবে ভূমিকা পালন করে। তাই সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করতে পারে সরকার। অংশীদারিত্বপূর্ণ উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ, মানবসম্পদ উন্নয়ন, মানবাধিকার চর্চা, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, আইনের যথাযথ প্রয়োগ, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, গণতান্ত্রিক অধিকার সংরক্ষণ, নাগরিকদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, নারীর অধিকার ও ক্ষমতায়ন, কার্যকর আমলাতন্ত্র গঠন, আইন-শৃঙ্খলার উন্নয়ন, স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ, নাগরিকের সেবার মান উন্নয়ন, ই-গভর্ন্যান্স প্রক্রিয়া চালুকরণ, শুদ্ধাচার চর্চা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ, স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও নিয়মিত নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা, সামাজিক নিরাপত্তা বিধান, গণতন্ত্রের চর্চা করা ইত্যাদি সকল বিষয়ের যথার্থ প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন করা সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। তবেই রাষ্ট্র ও সমাজে সুশাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব হতে পারে।

Add a Comment