সমালোচক মানেই শত্রু, রাষ্ট্রদ্রোহী**

প্রথম আলো, ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮
মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক


নাগরিক সমাজ, সুশীল সমাজ, বুদ্ধিজীবী—এই শব্দগুলো আজকাল হামেশাই ব্যবহার করছি আমরা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এগুলো সমার্থক। ইংরেজি ভাষায় ‘সিভিল সোসাইটি’ বলতে যা বোঝায়, তার ভুল ভাষান্তর ‘সুশীল সমাজ’ নানান প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এটাকে বরং জনসমাজ বা নাগরিক সমাজ বললে সিভিল সোসাইটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থের অনেক কাছাকাছি যাওয়া যায়।

সমাজে সবচেয়ে ক্রিয়াশীল ও প্রভাবশালী দুটি শক্তিকেন্দ্র আছে। একটি হলো ‘রাষ্ট্র’ অন্যটি ‘বাজার’। এর বাইরে একটি তৃতীয় স্রোতোধারা অথবা প্রবণতা যা-ই বলা হোক না কেন, তার অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়। এই ধারা যত বেগবান হয়, সংহত হয়, প্রকাশমান হয়, ততই তার শক্তি উপলব্ধি করা যায়।

কোনো বিশেষ উদ্দেশ্যে, সচেতনভাবে এবং স্বেচ্ছায় জড়ো হয়ে একটা ঢেউ বা বুদ্‌বুদ তোলার চেষ্টা করে যে জনগোষ্ঠী, সহজ কথায় তা হলো সিভিল সোসাইটি বা নাগরিক সমাজ। এদের মধ্যে সুশীল-কুশীল উভয়ই থাকতে পারে। যেমন রাষ্ট্রের নিয়ামক শক্তি হতে পারে সাধারণ মানুষ এবং তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা অথবা একটি অনির্বাচিত সামরিক জান্তা। তেমনি ‘বাজার’ দায়িত্বশীলতা ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের নিয়ন্ত্রণে থাকতে পারে অথবা তা ঢুকে যেতে পারে মাফিয়া চক্রের পকেটে। তেমনি নাগরিকদের মধ্যেও ভালো-মন্দের মিশেল আছে। আছে বিপরীত মন ও মতের মানুষ। তা সত্ত্বেও নাগরিক সমাজ রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণকারী সরকার বা রাজনৈতিক দলের প্রতিপক্ষ নয়, আবার তাদের পক্ষভুক্তও নয়। এই স্বাতন্ত্র্যবোধকে অনেক রাজনীতিবিদ আমলে নিতে চান না। তাঁরা তাঁদের পক্ষভুক্ত করতে চান। আবার নাগরিক সমাজের অনেক ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা সংগঠন সরকার বা রাজনৈতিক দলের পক্ষভুক্ত হয়ে পড়ে। কখনো সচেতনভাবে, কখনো নানান চাপে পড়ে। তখন নাগরিক সমাজ তার নিজস্ব কাজটি ঠিকমতো করতে পারে না, লাইনচ্যুত হয় এবং অনেক ক্ষেত্রে সরকার ও জনগণ—উভয়ের চোখে হাসির খোরাক হয়। তখনই তাদের ‘সুশীল’ নামে ডেকে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ চলে। নাগরিক সমাজের অনেক প্রতিনিধি নিজেদের ভুলের কারণে অথবা নানান মোহে পড়ে রাজনীতিবিদদের তল্পিবাহক হন, তাঁদের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধেন। এই প্রবণতা নতুন নয়।

আমরা জানি, ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট ‘পাকিস্তান’ সৃষ্টির আগেই রাষ্ট্রভাষা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছিল। দেশভাগের আগেই জুন মাসের প্রথম দিকে সংবাদপত্রে খবর বের হয় যে উত্তর-পশ্চিম ভারতের (পশ্চিম পাকিস্তান) নেতারা উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করতে চাইছেন। ওই সময় বেশ কয়েকজন বাঙালি বুদ্ধিজীবী এর বিরোধিতা করে কলম ধরেছিলেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌, কাজী মোতাহার হোসেন, আবুল মনসুর আহমদ, মুহম্মদ এনামুল হক, আবদুল হক, ফররুখ আহমদ, আবুল হাশিম প্রমুখ। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগেই বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে তাঁদের লেখা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। ওই সময় বাঙালি মুসলমান রাজনীতিবিদদের বড় অংশটিই মুসলিম লীগের ছাতার তলায় ছিল এবং তারা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার ব্যাপারে উদ্যোগী ছিল না। অনেকে তো বিরোধিতাই করেছেন। সুতরাং বলা চলে, পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের যে সূচনা হয়েছিল, তার প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিলেন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা, বুদ্ধিজীবীরা।

পঞ্চাশের দশকের শেষে ও ষাটের দশকে আমরা একই ছবি দেখতে পাই। সর্বভারতীয় প্রেক্ষাপটে দ্বিজাতিতত্ত্বের অস্ত্র ব্যবহার করে তৈরি হয়েছিল মুসলমানের রাষ্ট্র পাকিস্তান। পরে পাকিস্তানের ভেতরে তৈরি হলো অন্য রকমের দ্বিজাতিতত্ত্ব। পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য নিয়ে উচ্চকিত হলেন এ দেশের অগ্রগণ্য কয়েকজন বাঙালি অর্থনীতিবিদ। অধ্যাপক নুরুল ইসলাম, রেহমান সোবহান, এম এন হুদা, আবদুস সাদেক, আনিসুর রহমান, মোজাফফর আহমদ, স্বদেশ রঞ্জন বোস, আবদুল্লাহ ফারুক, মোশাররফ হোসেন প্রমুখ বুদ্ধিবৃত্তিক যুক্তি ও লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে উপস্থাপন করলেন নতুন ধরনের দ্বিজাতিতত্ত্ব—দুই অর্থনীতির ধারণা। পাকিস্তানের দুই অংশে যে দুটি অর্থনীতি বিরাজ করছে, এ ধারণা প্রথম তোলা হয় ১৯৫৬ সালে। এরই ধারাবাহিকতায় আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের রাজনৈতিক দাবিটি জোরালো হতে থাকে এবং ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা কর্মসূচির মাধ্যমে এই দাবিকে আরও স্পষ্ট ও ধারালো করতে সক্ষম হন। বলা চলে, রাজনীতিবিদদের সঙ্গে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের এক যুগলবন্দী তৈরি হয়েছিল, স্বাধিকারের দাবিতে যাঁরা এক মোহনায় মিলেছিলেন।

নাগরিক সমাজ থেকে যখনই কোনো কণ্ঠ উচ্চকিত হয়, সমাজে বিদ্যমান অসামঞ্জস্য ও বঞ্চনা নিয়ে জোরালো আওয়াজ ওঠে, রাষ্ট্র তখন তাদের বিরুদ্ধে নিপীড়কের ভূমিকায় নামে। আরোপ করা হয় নানান বিধিনিষেধ। তাঁদের লেখা যাতে ছাপানো না হয়, তার জন্য চলে নানান ফন্দি-ফিকির। একপর্যায়ে দেখা যায়, তাঁদের নানানভাবে দমন-পীড়ন করা হয়। বাজেয়াপ্ত হয় তাঁদের লেখা বই। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমল থেকে একই চিত্র দেখে আমরা অভ্যস্ত।

আমরা জানি, কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর লেখাজোকার কারণে ব্রিটিশরাজের চক্ষুশূল হয়েছিলেন। তাঁর দুটি বই বাজেয়াপ্ত হয়েছিল। তাঁকে গ্রেপ্তার করে জেলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আনা হয়েছিল।

পাকিস্তান আমলেও আমরা একই চিত্র দেখেছি। সরকারের ছাত্রসংগঠনের লাঠিয়াল বাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক আবু মাহমুদকে পিটিয়ে রক্তাক্ত করেছিল। ছয় দফার পক্ষে দুর্বার প্রচার চালানোর অভিযোগে ইত্তেফাক পত্রিকার ছাপাখানা সিলগালা করে দেওয়া হয়েছিল, সম্পাদক মানিক মিয়াকে জেলে ঢোকানো হয়েছিল। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। নিপীড়নকারী আইয়ুব-মোনায়েম সরকারের পতন হয়েছিল।

উনিশ শতকের প্রতিনিধিত্বশীল দার্শনিক কার্ল মার্ক্স রাষ্ট্রকে একটি নিপীড়ক যন্ত্র হিসেবে দেখেছেন। গত ২০০ বছরে নানান ওলট-পালট ঘটে গেলেও রাষ্ট্রের চরিত্রের খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। পরিবর্তন হয়নি সরকারি প্রেসনোটের ভাষা ও ভাষ্য। ‘আত্মরক্ষার্থে প্রথমে পুলিশের মৃদু লাঠিপেটা এবং পরে অবস্থা আয়ত্তে আনতে উচ্ছৃঙ্খল জনতার ওপর গুলিবর্ষণ’—এই বাক্যটি শত বছরের পুরোনো। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কোনো কর্মচারী কবে এই ড্রাফট করে গেছেন, জানি না। তবে একই ভাষা এখনো ব্যবহার করা হচ্ছে, শুধু স্থান-কাল-পাত্র যাচ্ছে বদলে।

পশ্চিমের অনেক দেশে নাগরিকেরা রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণ করেন। নাগরিকেরাই ঠিক করে দেন, রাষ্ট্র কোন কোন ক্ষমতার অধিকারী হবে। দিনে দিনে রাষ্ট্র হয়ে উঠছে একটি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান। আমাদের মুলুকে দেখি এর বিপরীত চিত্র। এখানে নাগরিকেরা রাষ্ট্র চালান না। রাষ্ট্রই নাগরিকদের নিয়ন্ত্রণ করে। যখন যে দল রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ নেয়, সে যেন একটা তালুকদারি পেয়ে যায়। তার চোখে সমালোচক মানেই শত্রু, রাষ্ট্রদ্রোহী। বিগত বিএনপি সরকারের আমলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সম্রাট বাবর বলেছিলেন, ‘উই আর লুকিং ফর শত্রুজ।’ সরকার সব সময় যেন শত্রুই খুঁজে বেড়ায়! ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলের রাষ্ট্রের এই চরিত্র এখনো বজায় আছে। রাজা যায় রাজা আসে। দৃশ্যপট বদলায় না।

সবচেয়ে বড় দুর্ভাবনার বিষয় হলো, নাগরিকেরা কী ভাববেন, কী বলবেন, কী লিখবেন, কী প্রকাশ করবেন, এটাও রাষ্ট্র ঠিক করে দেবে। টাইম মেশিন ছবিতে এ রকম একটি দৃশ্য দেখেছিলাম। এমন একটা সময় আসবে, যখন বই থাকবে না, মানুষগুলো রোবটের মতো চলাফেরা করবে। এইচ জি ওয়েলস কী ভয়ংকর একটি সমাজের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। আমরা কি সেদিকেই হাঁটছি?

Add a Comment