বড় প্রকল্পে শঙ্কা****

প্রথম আলো, ০৮ জানুয়ারি ২০১৮
এম ফাওজুল কবির খান: সাবেক সচিব, অধ্যাপক ও মেগা প্রকল্প বিশ্লেষক


বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে বড় বড় অবকাঠামো প্রকল্প হাতে নেয়। আকার ও ব্যয়ের দিক থেকে উচ্চাভিলাষী প্রকল্পগুলো সরকারের উন্নয়নের প্রচারণারও প্রধান উপকরণ হয়ে দাঁড়ায়। এগুলো বাস্তবায়িত হলে দেশে অমিত সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত হতো। তবে সরকারের মেয়াদের শেষ বছরে এসে দেখা যাচ্ছে, অন্য অনেক খাতের মতো এখানেও খুব একটা সুসংবাদ নেই। অধিকাংশ প্রকল্পের বাস্তবায়ন বিলম্বিত হয়েছে, ব্যয় বেড়েছে। কোনো কোনো প্রকল্পের এখনো অর্থের সংস্থান হয়নি। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন (আইএমইডি) ও বিভিন্ন সংবাদপত্র থেকে পাওয়া তথ্যে যে চিত্র পাওয়া যাচ্ছে, তাতে এগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন হবে বলে আশাবাদী হওয়ার সুযোগ নেই।

পদ্মা সেতু
অনেক স্বপ্নের পদ্মা সেতুর নির্মাণ ব্যয় তিন গুণ বেড়ে বর্তমানে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। ২০০৭ সালে এ প্রকল্পের অনুমিত ব্যয় ছিল ১০ হাজার ১৬২ কোটি টাকা। বারবার বিলম্বের পর প্রকল্প বাস্তবায়নের নতুন সময়সীমা নির্ধারিত হয়েছে জুন ২০১৯। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী বলেছেন, প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি প্রায় ৫০ শতাংশ। তিনি আরও বলেছেন, পদ্মার নিচে অনিশ্চিত পরিস্থিতি বিরাজমান। সেখানে গভীরতা ও টেকনিক্যাল কিছু সমস্যা আছে। মোট ৪১টি স্প্যানের মধ্যে ১টি স্প্যান বসানো হয়েছে। নিজস্ব অর্থায়নে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে।

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প
দীর্ঘ প্রতীক্ষিত এ প্রকল্প থেকে ২০২৪ সাল নাগাদ ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে, এমনটি আশা। পদ্মা সেতুর মতো এ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য নির্ধারিত সর্বশেষ সময় ছিল ২০১৮ সাল। প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য রুশ সংস্থা রোসাটমের সঙ্গে ১২ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলারের অর্থাৎ লক্ষাধিক কোটি টাকার চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে। প্রধানত রুশ অর্থায়নে চলমান প্রকল্পটিতে প্রতি মেগাওয়াট বিদ্যুতের মূলধন ব্যয় ৫০ লাখ ডলার। সম্প্রতি স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী, প্রতিবেশী ভারতে রাশিয়ার নির্মিত কুদানকুলাম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষেত্রে এ ব্যয় সাড়ে ৩০ লাখ ডলারের মতো।

ঢাকা মেট্রোরেল প্রকল্প
গত চার বছরে প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকার এ প্রকল্পের অগ্রগতি মাত্র ১২ শতাংশ। প্রকল্পটির পুরকাজের দায়িত্ব পেয়েছে ইতালিয়ান থাই পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি ও সিনো হাইড্রো করপোরেশন লিমিটেড জেভি এবং ডিপোর ভূমি উন্নয়নের কাজ পেয়েছে টোকিও কনস্ট্রাকশন লিমিটেড। জাইকার অর্থায়নে চলমান এ প্রকল্পটি ২০২০ সাল নাগাদ শেষ হবে বলা হচ্ছে।

রামপাল কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্প
সুন্দরবনের জন্য পরিবেশের হুমকি বলে কথিত কয়লাভিত্তিক ১৩২০ মেগাওয়াটের এ বিদ্যুৎ প্রকল্পটি সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী ২০১৬ সালের মধ্যে বাস্তবায়নের কথা ছিল। প্রকল্পটি নির্মাণের দায়িত্ব পেয়েছে ভারতীয় কোম্পানি ভারত হেভি ইলেকট্রিক্যাল লিমিটেড (ভেল) এবং বাস্তবায়নের পুনর্নির্ধারিত সময়সীমা ২০২১ সাল। পরিবেশবাদীদের বিরোধিতা ছাড়াও ইনস্টিটিউট অব এনার্জি ইকোনমিকস অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল অ্যানালাইসিসের ২০১৬ সালের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ প্রকল্পের উৎপাদন ব্যয় নানাবিধ ভর্তুকি সত্ত্বেও বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যয়ের চেয়ে ৩২ শতাংশ বেশি। তাদের হিসাবে বাংলাদেশকে এ প্রকল্পে কয়লা সরবরাহের জন্য নদীর নাব্যতা বজায় রাখতে বছরে গড়ে ২৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ভর্তুকি দিতে হবে।

পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর
ব্রিটিশ পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এইচ আর ওয়ালিংফোর্ডের মতে, এ প্রকল্পে ব্যয় হবে প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলার। ২০১৫ সালে অনুমোদিত এ প্রকল্পটি ২০১৮ সালের মধ্যে বাস্তবায়িত হওয়ার কথা ছিল। এ মেগা প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতির পরিমাণ ২ দশমিক ১ শতাংশ এবং প্রকল্প বাস্তবায়নের পুনর্নির্ধারিত সময়সীমা ২০২২ সাল।

অন্যান্য প্রকল্প
মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ প্রকল্প, পদ্মা সেতু রেলসংযোগ এবং দোহাজারী-কক্সবাজার-গুনদুম প্রকল্পের অগ্রগতি সামান্য। দুটি মেগা প্রকল্প, সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর ও এলএনজি টার্মিনালের কাজ এখনো নথিপত্রে সীমিত রয়েছে।

অসুবিধা কোথায়?
মেগা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে একটু না হয় দেরিই হলো, তাতে অসুবিধা কোথায়? প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্দেশ্য হচ্ছে সামাজিক সম্পদ বৃদ্ধি। প্রকল্প বাস্তবায়নে দেরি হলে প্রকল্পের সুবিধা হ্রাস পায়। আবার একই সঙ্গে প্রকল্প ব্যয় বাড়লে প্রকল্পের নিট বর্তমান মূল্য কমে এমনকি তা ঋণাত্মক হতে পারে। ফলে সামাজিক সম্পদ কমে যায়। ফলে এ ধরনের প্রকল্প দেশের জন্য শেষ পর্যন্ত মঙ্গলজনক থাকে কি না, সেটা বাস্তববাদী হয়ে বিবেচনা করতে হয়।

কেন এমন হচ্ছে?
সরকারের পক্ষেও যুক্তি আছে। পৃথিবীর সব দেশেই মেগা প্রকল্পে মূল্যবৃদ্ধি ও বাস্তবায়নে বিলম্ব ঘটে। এ ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। আবার কিছু প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্বের সুনির্দিষ্ট কারণ আছে। যেমন পদ্মা সেতু (অর্থায়ন বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত) ও মেট্রোরেল (হোলি আর্টিজান বেকারিতে জাপানি বিশেষজ্ঞ হত্যা)। কিন্তু প্রকল্প বাস্তবায়নের ব্যয় বৃদ্ধি ও বিলম্ব (কোনো কোনো ক্ষেত্রে তিন গুণ ও পাঁচ বছরের বেশি) এত ব্যাপক যে ওপরের কারণগুলো দিয়ে তা ব্যাখ্যা করা যাবে না। তা ছাড়াও বৃহৎ প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের ব্যয় ও সময় আরও বাড়বে বলে ধারণা করা যায়। এ জন্য আমাদের দেশের প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের রাজনৈতিক অর্থনীতি বুঝতে হবে।

লক্ষণীয় যে বেশ কটি প্রকল্পেরই বাস্তবায়নের সীমা ছিল ২০১৮ সাল অর্থাৎ নির্বাচনের আগের বছর। এ থেকে মনে হয় রাজনৈতিক বিবেচনায় এসব বৃহৎ প্রকল্পের সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। আবার ২০ বিলিয়ন ডলারের পায়রা সমুদ্রবন্দর প্রকল্প, ‘কাপড় দেখে (আমাদের সম্পদের সীমাবদ্ধতা) কোট’ কাটা হয়েছে বলে মনে হয় না।

তবে এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় কারণগুলো হলো বৃহৎ প্রকল্পের প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে অদক্ষতা এবং ঠিকাদার নির্বাচনে অস্বচ্ছতা। যদি তাই না হয় তবে এত দিন পর ‘পদ্মার নিচে অনিশ্চিত পরিস্থিতি’র কথা আসবে কেন? আমাদের দেশে প্রধানত চীনা ও ভারতীয় ঠিকাদারেরা কাজ পেয়ে থাকেন। গণচীন ও ভারতে অনেক ভালো নির্মাতাপ্রতিষ্ঠান আছে। সাধারণত তারা এমুখো হয় না। উদাহরণস্বরূপ, ভারতীয় ভেল কিংবা চীনা সিনো হাইড্রো এ দুটি প্রতিষ্ঠানেরই বাংলাদেশে প্রকল্প বাস্তবায়নের অভিজ্ঞতা প্রশ্নবিদ্ধ। অথচ এ ধরনের প্রতিষ্ঠানই বারবার কাজ পেয়ে থাকে। এদের কাজ পাইয়ে দেওয়ার জন্য অনেকেই মুখিয়ে থাকেন এবং এ জন্য প্রকল্প ব্যয় ও বাস্তবায়নের সময়সীমা কম ধরা হয়। পরে প্রকল্প পাওয়ার পর এরা করসুবিধা, মূল্য ও সময় বৃদ্ধি আদায় করে নেয়। অথচ আগেভাগেই কর, প্রকল্প ব্যয় ও বাস্তবায়নের সময় সঠিকভাবে ধরা হলে অন্যান্য দেশের যোগ্য প্রতিষ্ঠান টেন্ডার-প্রক্রিয়ায় অংশ নিত।

উত্তরণের উপায়
পরামর্শক প্রতিষ্ঠান কিস্টোন-এর গবেষণা থেকে দেখা গেছে, আমাদের সিংহভাগ শীর্ষ ব্যবসায়ী মেগা প্রকল্পের চেয়ে প্রয়োজনীয় এবং দ্রুত ও ব্যয়সাধ্যসীমার মধ্যে বাস্তবায়নযোগ্য প্রকল্পের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। বিষয়টি ভেবে দেখার মতো।

বিদেশি কেউ কেউ বলে থাকেন, বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক নেতৃত্বের মডেল সিঙ্গাপুর, অর্থাৎ ‘গণতন্ত্রের বিনিময়ে উন্নয়ন’। দেশেও অনেককে বলতে শুনেছি মেগা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হলে দেশ সিঙ্গাপুর হয়ে যাবে এবং তাতে গণতন্ত্রের ঘাটতি মিটে যাবে।

ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরে আমার তিন বছর শিক্ষকতাকালের অভিজ্ঞতা থেকে এখানে কিছু কথা বলতেই হয়। সেখানে থাকাকালে সম্ভবত ১৯৯৪ সালে রাষ্ট্রদূত কায়সার মোরশেদের স্ত্রী সুরাইয়া ভাবিকে চোখের ডাক্তার ভিভিয়ান বালাকৃষনানকে দেখাতে গিয়ে তাঁর পারদর্শিতা দেখে মুগ্ধ হই। পরে ২০০১ সালে আরেকজন বলেন সিঙ্গাপুরে একজন ভালো চোখের ডাক্তারের সঙ্গে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দিতে। ডাক্তার বালাকৃষনানের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানতে পারি, তিনি মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়েছেন। বর্তমানে তিনি সিঙ্গাপুরের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। সিঙ্গাপুরে রাজনৈতিক নেতৃত্ব নির্বাচনের পদ্ধতিটি হলো অসাধারণ শিক্ষাজীবন, কর্মজীবনে দৃষ্টান্তমূলক সাফল্য, পিপলস অ্যাকশন পার্টিতে যোগদান ও এমপি নির্বাচন এবং অতঃপর মন্ত্রিত্ব। সিঙ্গাপুরের মন্ত্রীদের জীবনবৃত্তান্ত তা-ই বলে। লক্ষণীয় যে ব্যবসাবান্ধব দেশ সিঙ্গাপুরের মন্ত্রীদের মধ্যে বেসরকারি খাতে কাজের অভিজ্ঞতা থাকলেও কোনো ব্যবসায়ী নেই। বেশির ভাগ মন্ত্রীই বিভিন্ন পেশার সফল মানুষ। শীর্ষ নির্বাহী আমলা নির্বাচনের পদ্ধতিটিও অনুরূপ। কোনো শীর্ষ পদ খালি হওয়ার আগেই যোগ্য লোক খোঁজা শুরু হয়। তাঁর ঠিকুজি (রাজনৈতিক নয়) বের করে খুঁটিনাটি সব পরীক্ষা করে দেখা হয়। এ কাজটি শেষ পর্যায়ে দেখেন প্রধানমন্ত্রী নিজে।

আমার অবস্থানকালে, একবার লি কুয়ান ইউ ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরে বক্তৃতা দিতে এলে একজন ছাত্রী তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কোন কাজে আপনি সবচেয়ে বেশি সময় দিতেন?’ লির সরাসরি জবাব, ‘হেড হান্টিংয়ের জন্য ২০ শতাংশ সময়—টু ফাইন্ড দ্য বেস্ট পারসন ফর দ্য জব (এ কাজে সবচেয়ে যোগ্য লোকটিকে খুঁজে পাওয়ার জন্য)।’ তাই সিঙ্গাপুর হতে চাইলে, বাংলাদেশকে সিঙ্গাপুরের মতো মেধাতন্ত্র, পেশাদারি, স্বজনপ্রীতিমুক্ত ও দুর্নীতিমুক্ত হওয়ার পথ অনুসরণ করতে হবে। অযোগ্য, চাটুকার, অপেশাদার, দুর্নীতিপ্রবণ মন্ত্রী ও আমলা দিয়ে দেশকে সিঙ্গাপুর বানানো কিংবা মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন কোনোটাই সম্ভব নয়।

Add a Comment