বুদ্ধিজীবীরা কখন অবান্তর হয়ে যান?**

প্রথম আলো, ১০ মার্চ ২০১৮
সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি


অগ্রজ লেখক-সাংবাদিক আবুল মোমেন ৩ মার্চ প্রথম আলোর লেখায় একটি জরুরি প্রশ্ন তুলেছেন। যখন বাংলাদেশে ক্ষমতা নিয়ে কেউ কথা বলতেই সাহস পান না, তখন তিনি ‘ক্ষমতাধর শাসক ও নাগরিক সমাজের’ মধ্যকার টানাপোড়েন এবং কার কী করণীয়, সে সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন। এ জন্য তাঁকে ধন্যবাদ জানাই।

তবে লেখার শুরুতে আবুল মোমেন চীন ও রাশিয়ার যে উদাহরণ টেনেছেন সেটি কতটা যৌক্তিক, তা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ আছে। কমিউনিস্ট আদর্শে বিশ্বাসী সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে ভিন্ন দল ও মতের কোনো সুযোগ ছিল না। পুতিনের বর্তমান রাশিয়ায় বহুদলীয় ব্যবস্থা চালু থাকলেও কাজকর্মে তাঁর বিরোধিতা কতটা সম্ভব, সেটাও ভেবে দেখার বিষয়। পুতিন দুই দফা প্রেসিডেন্ট থাকার পর এক দফা প্রধানমন্ত্রিত্ব করে ফের প্রেসিডেন্ট পদে আসীন আছেন। বিপ্লবোত্তর চীন যেমন সোভিয়েত ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল; সি চিন পিংয়ের চীনও সম্ভবত পুতিনকে মডেল হিসেবে বেছে নিতে চাইছে।

চীন বা সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের কর্তৃত্ববাদী শাসন আর বাংলাদেশের সমাজবাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পেছনে গণতন্ত্রই ছিল অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী জনগণের রায় বানচাল করার কারণেই যে বাংলাদেশ আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, সে কথা আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রেই স্বীকৃত। অতএব, স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু কর্তৃত্ববাদী শাসন জারি করলেই বাংলাদেশের ইতিহাস বদলে যেত, তা মনে করার কারণ নেই। বরং শুরু থেকে গণতন্ত্র ঠিকমতো কাজ করলে ইতিহাসের দুর্ঘটনাগুলো হয়তো এড়ানো যেত। এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের আলাপচারিতা স্মরণ করা যেতে পারে। আবদুর রাজ্জাক শক্তিশালী বিরোধী দলের তাগিদ দিয়েছিলেন। (সূত্র: যদ্যপি আমার গুরু, আহমদ ছফা)

আবুল মোমেন উল্লেখ করেছেন, ভারতে জওহর লাল নেহরু একটানা ১৭ বছর প্রধানমন্ত্রী পদে থেকে দেশের অর্থনীতি ও রাজনীতি ঠিক করে যেতে পেরেছিলেন। এটি যেমন সত্য, তেমনি অসত্য নয় তিনি দীর্ঘদিন প্রধানমন্ত্রী থাকলেও কর্তৃত্ববাদী শাসন চাপিয়ে দেননি। বহুদলীয় গণতন্ত্র চালু রেখেছিলেন। আমরা সেটি পারিনি। এ জন্য তৎকালীন ক্ষমতাসীনদের ব্যর্থতা, না বিরোধী দলের হঠকারিতা বেশি দায়ী, সে নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। কিন্তু ইতিহাসকে বদলানো যাবে না।

আবুল মোমেন লিখেছেন, বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় তাদের (নাগরিক সমাজ) অন্তর্জ্বালা ও হতাশার শেষ নেই। এর আগেও একাধিক লেখায় তিনি নাগরিক সমাজের ভূমিকা সম্পর্কে সজাগ করার চেষ্টা করেছেন। ধারণা করি, আরও অনেকের মতো নাগরিক সমাজের একজন হিসেবে তিনিও অন্তর্জ্বালা ও হতাশা থেকে মুক্ত নন। কারণ, তাঁর ভাষায়, ‘বড় অংশই (নাগরিক সমাজের) ব্যক্তিগত সুযোগ গ্রহণে আর বাক্সর্বস্ব নিষ্ক্রিয় আলোচনার পণ্ডশ্রমে জড়িয়ে পড়েছে।’

পৃথিবীর সব গণতান্ত্রিক দেশে নাগরিক সমাজের একটি আলাদা অবস্থান থাকে। তারা কোনোভাবেই ক্ষমতাকাঠামোর অংশ নয়। কোনো দলকে ক্ষমতায় বসানো বা ক্ষমতা থেকে নামানো নাগরিক সমাজের কাজ নয়। তারা কথা বলবে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, আইনের শাসন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং সমাজের দুর্বল ও প্রান্তিক মানুষের অধিকারসহ কতগুলো নীতিগত বিষয়ে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কিংবা যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিষয়টিও দেখতে হবে এই আলোকে। এখানে কোনো একটি বাদ দিয়ে অপরটি আঁকড়ে ধরার সুযোগ আছে বলে মনে করি না।

আবুল মোমেনের বক্তব্যের প্রতি সহমত পোষণ করে বলতে চাই, যাঁরা সরকারের কাছ থেকে ব্যক্তিগত সুযোগ-সুবিধা নেন, তাঁরা কোনোভাবে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি হতে পারেন না। নুন খাওয়ার গুণ তাঁদের গাইতেই হয়। কিন্তু এর বাইরেও তো লেখক-বুদ্ধিজীবী-শিক্ষাবিদ-সাংবাদিক-আইনজীবীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ আছেন, যাঁরা স্বাধীনভাবে চিন্তা করেন এবং দেশের মঙ্গল চান।

মনে রাখতে হবে, ভাষা আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানে নাগরিক সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। আশির দশকে স্বৈরাচারবিরোধী লড়াইয়েও ছাত্রসমাজের পাশাপাশি তাদের উদ্যোগেই গড়ে উঠেছিল সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট ও জাতীয় কবিতা পরিষদসহ বিভিন্ন নাগরিক সংগঠন। সে সময় ৩১ বুদ্ধিজীবীর বিবৃতি ও তাঁদের সাহসী ভূমিকা স্বৈরাচারের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল। খালেদা জিয়ার প্রথম সরকারের আমলে ভারতে বাবরি মসজিদ ভাঙার পর এবং ২০০১ সালের নির্বাচনের পর সংখ্যালঘুদের ওপর যে সংঘবদ্ধ আক্রমণ হয়েছিল, তার বিরুদ্ধেও নাগরিক সমাজ প্রথম মাঠে নামে।

তাহলে এখন কেন সেই নাগরিক সমাজ আজ ‘বাক্সর্বস্ব নিষ্ক্রিয় আলোচনার পণ্ডশ্রমে জড়িয়ে পড়েছে’?

সাধারণভাবে অভিযোগ আছে যে বিএনপি আমলে রাষ্ট্রীয় অনাচারের বিরুদ্ধে নাগরিক সমাজ যতটা সোচ্চার, আওয়ামী লীগ আমলে ততটাই নমনীয় থাকে। এর পেছনে হয়তো এই বিশ্বাস কাজ করে যে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী দলকে’ ক্ষমতায় রাখতে হবে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলতে আমরা কী বুঝি? গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ কিংবা ভয়ভীতিতে রাখা, ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করা কোনোভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হতে পারে না। বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, অপহরণ, দলীয় মাস্তানিও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হতে পারে না।

আবুল মোমেন বলেছেন, বিএনপির বিপুল জনসমর্থন থাকা সত্ত্বেও জামায়াত ও যুদ্ধাপরাধীদের প্রতি দুর্বলতা দেখানোয় নাগরিক সমাজ দলটিকে আওয়ামী লীগের বিকল্প শক্তি হিসেবে ভাবতে পারছে না এবং সেটাই আওয়ামী লীগকে অধিকতর কর্তৃত্ববাদী করেছে। কিন্তু যে নাগরিক সমাজ আওয়ামী লীগকে একমাত্র রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে মেনে নিয়েছে, তার প্রতি সরকারের আচরণ কতটা সহিষ্ণু? আওয়ামী লীগ বুদ্ধিজীবী তথা নাগরিক সমাজের স্বাতন্ত্র্য অবস্থান ততটুকুই চায়, যতটুকু তার জন্য সহায়ক হবে। ২০১৩ সালের গণজাগরণ মঞ্চের বিকাশ ও পরবর্তীকালে বিলয় এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

গণজাগরণ মঞ্চ ছিল বাংলাদেশের সবচেয়ে সফল ও ব্যতিক্রমী নাগরিক আন্দোলন। এই আন্দোলনের উদ্যোক্তারা কেউ ক্ষমতার হিস্যা চাননি। যুদ্ধাপরাধের বিচার ও মুক্তিযুদ্ধের ধারায় দেশ পরিচালনার আকাঙ্ক্ষা থেকেই তাঁরা মাঠে নেমেছিলেন। সরকার প্রথমটি বাস্তবায়ন করলেও দ্বিতীয়টির বিষয়ে দেশবাসী তাদের উল্টোযাত্রা প্রত্যক্ষ করেছে। হেফাজতে ইসলাম নামে যে মৌলবাদী সংগঠনটি ২০১৩ সালের ৫ মে ঢাকা শহরে ভয়াবহ তাণ্ডব চালিয়েছিল, সেই হেফাজতের দাবি মেনে তারা ২০১৭ সালে পাঠ্যবইয়ে অদলবদল করেছে। এর বিরুদ্ধে নাগরিক সমাজের মৃদু প্রতিবাদ হলেও সরকার সেসব আমলে নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি। এখানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার চেয়ে ভোটের হিসাব-নিকাশ অগ্রাধিকার পেয়েছে।

আবুল মোমেন বলার চেষ্টা করেছেন, নাগরিক সমাজের বড় অংশের সুবিধাবাদিতা ও নিষ্ক্রিয়তার কারণে সরকার কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠেছে। তাহলে কি সরকার প্রলোভন ও ভয়ভীতি দেখিয়ে নাগরিক সমাজের মুখ বন্ধ করতে চাইছে? যাঁরা প্রলোভনে তুষ্ট হবেন, তাঁদের সুবিধা দেওয়া আর যাঁরা প্রলোভনে তুষ্ট হবেন না, তাঁদের ভয়ভীতি দেখিয়ে খামোশ করা হবে। এই নীতি দেশকে কোথায় নিয়ে যাবে?

আবুল মোমেন স্বাধীন বুদ্ধিজীবীর অস্তিত্ব ও ভূমিকা প্রায় অবান্তর হয়ে যাচ্ছে বলে আফসোস করেছেন। কিন্তু উত্তরণের উপায় কী, তা বলেননি। যখন একটি দেশের সরকার সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী হয়, শিক্ষাঙ্গন থেকে শেয়ারবাজার, গণমাধ্যম থেকে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান সবকিছু নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করে, তখন বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা পালন মারাত্মকভাবে সংকুচিত হয়ে পড়ে।

বর্তমান সরকার বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করেছে, যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি দিয়েছে, অর্থনীতির অগ্রযাত্রা ধরে রেখেছে। নাগরিক সমাজ এসব কাজের অকুণ্ঠ প্রশংসা করেছে। কিন্তু যখন তারা দেখছে দলীয় মাস্তানি বেড়েছে, ঘুষ-দুর্নীতি অতীতের রেকর্ড ছাড়িয়েছে, মানুষের ভোটাধিকার খর্ব হচ্ছে, তখন তো নিশ্চুপ থাকতে পারে না। নাগরিক সমাজের দায়িত্ব চোখ-কান খোলা রেখে সবকিছু দেখা এবং যা গণতন্ত্র ও বৃহত্তর জনগণের জন্য কল্যাণকর, তার পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নেওয়া।

‘বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ ও তার জন্মের ইতিহাস ও নায়কদের অস্বীকার করতে পারবে না’ বলেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা তথা গণতন্ত্রে ফিরে যেতে হবে; কর্তৃত্ববাদী শাসনে নয়। বাংলাদেশের নাগরিক সমাজের হাজারটা দুর্বলতা আছে। তাদের মধ্যে সুবিধাবাদিতাও কম নয়। কিন্তু রাষ্ট্রের কর্তৃত্ববাদী শাসনের দায় তাদের ওপর চাপানো বোধ করি ঠিক হবে না।

Add a Comment