বিশ্বব্যবস্থা বদলে দিতে পারেন ট্রাম্প!**

প্রথম আলো, ২৭ জুলাই ২০১৮
হাসান ফেরদৌস যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি


কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্ট আগে যা করেননি, করার কথা ভাবেনওনি, তাই করতে গিয়ে বিপাকে পড়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। প্রথমে ব্রাসেলসে, পরে হেলসিঙ্কিতে এসে তিনি এমন সব কাণ্ড করেছেন, যা দেখেশুনে তাঁর দলের লোকজনই খেপে অস্থির। তাঁর প্রধান অপরাধ, নিজের দীর্ঘদিনের মিত্র ন্যাটো ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তিনি রাশিয়ার পুতিনকে বন্ধু বলে সম্বোধন করেছেন। একি সর্বনাশ!

নিজের দলের সদস্যরা, যাঁরা এত দিন মুখ উঁচিয়ে কথা বলতে ভয় পেতেন, তাঁরা পর্যন্ত অসৌজন্যমূলক ভাষায় প্রেসিডেন্টের সমালোচনা করেছেন। ট্রাম্পের কোনো কোনো সমর্থক ঢোঁক গিলতে গিলতে স্বীকার করেছেন, কাজটা ভালো করেননি ট্রাম্প। তবে সমালোচকদের হাতে যতই নিন্দিত তিনি হোন না কেন, নিজের অনুগত সমর্থকদের কাছে তিনি এখনো ত্রাতা। রিপাবলিকান দলের ৮০-৯০ শতাংশ সদস্য এখনো ট্রাম্পের পক্ষে।

তবে এ সমর্থনের জমিনে কোথাও কোথাও কিঞ্চিৎ টুটাফাটা নজরে আসছে। রাশিয়া নিয়ে নয়, নারীঘটিত স্ক্যান্ডাল নিয়ে নয়, ম্যুলার তদন্ত নিয়েও নয়। ট্রাম্পের সমর্থনে ফাটলে ধরেছে অথবা সঠিক করে বললে, ধরার আশঙ্কা রয়েছে, তাঁর বাণিজ্যযুদ্ধ নিয়ে। ইতিমধ্যেই এ বাণিজ্যযুদ্ধের ক্ষতিকর দিকগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠছে। সবচেয়ে বড় ভয় চীনকে নিয়ে। ট্রাম্প প্রথমে ৩৪ বিলিয়ন ডলারের চীনা পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপ করেন। আগামী মাসে আরও ৫০ বিলিয়ন ডলারের শুল্ক আরোপ করবেন। আগামী বছরে এ শুল্কের পরিমাণ ৫০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে ট্রাম্প প্রশাসন জানিয়েছে।

রক্ষণশীল গবেষণা সংস্থা ট্যাক্স ফাউন্ডেশন এক বিশ্লেষণে জানিয়েছে, সত্যি সত্যি যদি এ পরিমাণ শুল্ক আরোপ করা হয়, দীর্ঘমেয়াদি হিসাবে তার প্রতিক্রিয়া মার্কিন অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক হতে বাধ্য। সবচেয়ে বড় বিপদ আসবে কৃষির ওপর। সয়াবিনজাতীয় পণ্যের একটি প্রধান বাজারই হলো চীন। অতিরিক্ত শুল্কের ফলে সয়াবিনের দাম বাড়তে বাধ্য, ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে তার চাহিদা কমে যেতে বাধ্য। ট্যাক্স ফাউন্ডেশন মনে করে, দীর্ঘমেয়াদি হিসাবে এ বাণিজ্যযুদ্ধের ফলে আমেরিকার মোট জাতীয় উৎপাদন শূন্য দশমিক ৪৭ শতাংশ হ্রাস পেতে পারে।

ন্যাটো, হেলসিঙ্কি, পুতিন, বাণিজ্যযুদ্ধ ইত্যাদি বিতর্কের ফাঁদে পড়ে আমরা একটা জিনিস লক্ষ করতে ভুলে গেছি, আর তা হলো ইচ্ছায় হোক অথবা অনিচ্ছায়, ট্রাম্প দ্বিতীয় মহাযুদ্ধোত্তর আন্তর্জাতিক বিশ্বব্যবস্থা ভেঙে ফেলার উদ্যোগ নিয়েছেন। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, ন্যাটো, মস্কোবিরোধী পশ্চিমা ফ্রন্ট, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা—এসবই যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর বানানো হয়। উদ্দেশ্য একটাই, আমেরিকার নেতৃত্বে পশ্চিমা আধিপত্য অব্যাহত রাখা। এ আধিপত্যে প্রধান বাধা ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। সেই আপদ গেছে, যার বড় কৃতিত্ব আমেরিকার। এখন দেখেশুনে মনে হচ্ছে, বুঝে হোক অথবা না বুঝে, ট্রাম্প সেই ব্যবস্থা ভেঙে ফেলতে চান।

ভেবে দেখুন। এত দিন আমেরিকা বলে এসেছে, পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে নানা অপকর্মের জন্য সব দোষ একা রাশিয়া (বা সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের)। ট্রাম্প এখন বলছেন, না, দোষ আমেরিকারও রয়েছে। তিনি ন্যাটোকে বলেছেন ‘অকেজো’, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নকে বলেছেন ‘কার্যত অর্থহীন’। এমনকি জাতিসংঘকেও ফালতু বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। আমেরিকার এস্টাবলিশমেন্টপন্থীরা সদ্য মানতে শুরু করেছেন, ট্রাম্প যা করছেন, তাতে সফল হলে বড় ধরনের ‘বিপ্লব’ ঘটে যাবে। আর এ বিপ্লবের ঝড়ে সবার আগে মারা পড়বে আমেরিকার মাতব্বরি। ‘মুক্তবিশ্বের’ নেতা হিসেবে আমেরিকা এত দিন ইচ্ছেমতো ছড়ি ঘুরিয়েছে। এর জন্য তাকে খরচা করতে হয়েছে তা ঠিক—সারা দুনিয়ায় সামরিক বহর রক্ষা করতে হলে টাঁকশালে তো টান পড়বেই। ট্রাম্প সেই পুরোনো ব্যবস্থা ভাঙতে চান। এমনকি যে বিশ্ব বাণিজ্যব্যবস্থা আমেরিকার নিজের স্বার্থে নির্মাণ করেছে, ট্রাম্প সেটিও লাথি মেরে দূরে সরিয়ে দিতে চান।

ট্রাম্প যে পুরোনো বিশ্বব্যবস্থা মানেন না, নির্বাচনী ক্যাম্পেইনের সময়েই জানিয়েছেন। তিনি পুতিনকে শক্তিশালী নেতা বলে প্রশংসা করেছেন তা–ই নয়, রাশিয়ার সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক নির্মাণের প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন। আমরা বন্ধু হলে বিশ্বের অনেক সমস্যাই মিটিয়ে ফেলতে পারব, হেলসিঙ্কিতেও এমন কথা বলেছেন। ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের খ্যাতনামা বিশেষজ্ঞ টমাস রাইট ট্রাম্পের নির্বাচনের আগেই সতর্ক করে দিয়েছিলেন, এ লোক প্রেসিডেন্ট হলে যে ‘উদারনৈতিক’ বিশ্বব্যবস্থা আমরা গড়ে তুলেছি, তা বাতিল হবে। রাইটের বিবেচনায়, ট্রাম্প যে বিশ্ববীক্ষা দ্বারা পরিচালিত, তার তিনটি উপাদান রয়েছে: একলা চলো নীতি ও সামরিক জোটবিরোধিতা, মুক্ত বাণিজ্যের বিরোধিতা এবং কর্তৃত্ববাদের প্রতি সমর্থন।

গত ১৮ মাসে কথায় ও কাজে এ তিন পথই ট্রাম্প অনুসরণ করে চলেছেন। বিষয়টি আমেরিকার প্রথাগত বুদ্ধিজীবীদের শঙ্কিত করেছে। ফরেন অ্যাফেয়ার্স পত্রিকায় বিশিষ্ট আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ স্টুয়ার্ট প্যাট্রিক লিখেছেন, গত ৭০ বছরে আমেরিকার প্রত্যেক প্রেসিডেন্ট মনে করেছেন, মুক্তবিশ্বের নেতা হিসেবে আমেরিকার বিশেষ দায়িত্ব আছে। অন্যের দেখভাল করা এ দায়িত্বের অন্যতম। সে জন্যই চাই ন্যাটো, সে জন্যই চাই রাশিয়ার চারপাশে মিসাইল বসান, সে জন্যই চাই ইরাকে হামলা। কিন্তু ট্রাম্প এসব বদলাতে চান, যে জাতীয়তাবাদী ও আদান-প্রদানভিত্তিক রাষ্ট্রনীতি তিনি পরিচালনা করতে চান, তাতে সবার আগে আমেরিকার নিজের স্বার্থ—আমেরিকা ফার্স্ট। ইউরোপের প্রতিরক্ষা আমাদের অর্থ ব্যয় করতে হবে কেন? মন্টেনেগ্রো ন্যাটোর সদস্য হতে পারে, কিন্তু তার জন্য আমার দেশের মানুষ কেন জান দেবে, এমন প্রশ্ন হেলসিঙ্কি থাকতেই ট্রাম্প তুলেছিলেন।

তো এসবের সবকিছুই কি খারাপ? ন্যাটো দুর্বল হলে অথবা বিশ্ব অর্থনীতির ওপর পশ্চিমা নিয়ন্ত্রণ হ্রাস পেলে, আমরা যারা তৃতীয় বিশ্বের, তাদের ক্ষুব্ধ হওয়ার কি থাকতে পারে? ন্যাটো দুর্বল হওয়া মানে, বিশ্বের ওপর, বিশেষত তৃতীয় বিশ্বের ওপর, আমেরিকা তথা পশ্চিমা জোটভুক্ত দেশগুলোর থাবা কিছুটা আলগা হওয়া। তাতে তো আমাদেরই লাভ। ২০০১ সালে বুশ না হয়ে যদি ট্রাম্প আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হতেন, তাহলে হয়তো ইরাক নামক এক মহাদুর্যোগ অথবা ইসলামি সন্ত্রাসবাদ নামক এক দানবের জন্ম হতো না।

ট্রাম্প যে নতুন বিশ্বব্যবস্থার কথা বলছেন, তা বাস্তবায়িত হলে দুনিয়াটাই তো বদলে যায়! ভাবুন তো, আমেরিকা ও রাশিয়া একে অপরের শত্রু না হয়ে যদি বন্ধু হয়, তাহলে সম্ভাবনার কত দুয়ারই না খুলে যায়। আমি শুধু সম্ভাবনার অর্থে এ কথা বলছি। কারণ, মুখে যা-ই বলুন, ট্রাম্প এখন পর্যন্ত এমন কিছুই করেননি অথবা চাপের মুখ করতে পারেননি, যা তাঁর পূর্বসূরিদের চেয়ে ভিন্ন। করতে গেলে তাঁকে নিজের দলের লোকেরাই টেনে নামাবেন, তাতেও কোনো সন্দেহ নেই। ন্যাটোর ব্যাপারে ভিন্ন কথা বলেছিলেন, পুতিনকে বন্ধু বলে সম্বোধন করেছিলেন। অমনি মার্কিন সিনেট ৯৮-০ ভোটে প্রস্তাব নিয়ে তাঁকে সাবধান করে দিয়েছে, বাপু হে, মুখে যা খুশি বলো, সত্যি সত্যি এমন কিছু করতে যেয়ো না।

Add a Comment