ফারাজের আত্মদান ও তারপর***

প্রথম আলো, ০১ জুলাই ২০১৮
আব্দুল কাইয়ুম প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক


সেদিন প্রথম আলোর গোলটেবিল বৈঠকে ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের (Counter Terrorism and Transnational Crime Unit) সহকারী উপকমিশনার আবদুল মান্নান বলেন, হোলি আর্টিজান হামলায় একমাত্র প্রতিবাদকারী ছিলেন ফারাজ আইয়াজ হোসেন। হামলাকারীরা ফারাজকে বলেছিল, তুমি মুসলিম, তুমি চলে যাও। কিন্তু তিনি তাঁর বন্ধুদের মৃত্যুর মুখে রেখে একা চলে যেতে চাননি। ন্যায়-নীতি-মানবিকতার প্রতি তিনি ছিলেন অবিচল। তিনি শুধু ধর্মপ্রাণ মুসলিমই ছিলেন না; তিনি ইসলামের মূল কথা—সব মানুষের প্রতি ভালোবাসার আদর্শে অবিচল ছিলেন।

হোলি আর্টিজানে সেই রাতে ফারাজ আইয়াজ হোসেনসহ নয়জন ইতালীয়, সাতজন জাপানি, একজন ভারতীয় নাগরিক, পুলিশের দুজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাসহ আরও কয়েকজনকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। এ ধরনের আরও কিছু হামলার ঘটনায় আরও অনেকে প্রাণ হারিয়েছেন। ঘটনাগুলোর বিচার–প্রক্রিয়া চলছে। যে চিন্তাধারা থেকে এসব ঘটানো হচ্ছে, তা ঠেকানোর পথ কী?

এই জটিল ও কঠিন প্রশ্নের উত্তরে সেদিন আবদুল মান্নান বলেন, আমাদের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো একশ্রেণির তরুণের মধ্যে উগ্রবাদী চিন্তাধারার (Radicalization) বিস্তার। ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা অথবা বেকারত্বের জ্বালায় যে ওরা সেদিকে যাচ্ছে, তা নয়। ওদের অনেকে এমনকি উচ্চবিত্ত ঘরের সন্তান। প্রতিষ্ঠিত ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার বা বিজনেস ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞ। তারাও কিন্তু উগ্রবাদের দিকে ঝুঁকছে। এই উগ্রবাদ এমন জিনিস, যা একজন ব্যক্তিকে ক্রমে হিংস্র করে তোলে। সে ভাবতে থাকে তার বা তাদের দলীয় সহযোগীদের চিন্তাধারাই একমাত্র সঠিক, তার ধর্মই একমাত্র সত্য, অন্যদের বেঁচে থাকার অধিকার নেই। এবং এ ধরনের উগ্র মতবাদে উত্তেজিত হয়ে ওরা সহিংস হামলা চালায়।

তিনি বলেন, এই বিভ্রান্তি থেকে ওই তরুণদের বের করে আনতে হলে তাদের ঘৃণা নয়, ভালোবাসা দিয়ে কাছে টানতে হবে। ধৈর্য ধরে তাদের বোঝাতে হবে, তারা মানবতার বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছে। এ রকম উগ্র, সহিংসতা কোনো ধর্মেই নেই।

অবশ্য একই সঙ্গে তিনি বলেন, কাউন্টার টেররিজম ইউনিট হত্যা ও হামলাকারীদের বিরুদ্ধে দৃঢ় আইনগত ব্যবস্থা নিচ্ছে। হত্যাকাণ্ডের বিচার তো অবশ্যই হতে হবে। কিন্তু পাশাপাশি বিভ্রান্ত তরুণদের সহনশীল মনোভাব নিয়ে কাছে টেনে নিতে হবে, যেন কেউ তাদের হত্যা-হানাহানির নৃশংসতার পথে ঠেলে দিতে না পারে।

গোলটেবিল আলোচনায় সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভোকেট ও সাবেক মহানগর পিপি বলেন, তিনি বিভিন্ন সন্ত্রাসী হামলার মামলার আসামিদের জেরা করেছেন। তাদের প্রায় সবাই বলেছে, ওরা বেহেশতে যাবে বলেই ওই ধরনের হামলা ও হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। কে তাদের এই ভুল তথ্য দিয়েছে? এ রকম প্রশ্নের উত্তরে তাদের প্রায় সবাই বলেছে, তাদের আস্থাভাজন ব্যক্তিদের কাছ থেকেই তারা এ বিষয়ে জানতে পেরেছে।

কিন্তু এটা তো আমাদের স্বাধীনতার মূল ধারণার সম্পূর্ণ বিপরীত। আমরা সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছি। আমাদের মূল কথা বাংলাদেশে সব মত, সব ধর্ম, সব ধরনের গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করবে। বাংলাদেশ পরিপূর্ণভাবে অসাম্প্রদায়িক। এটা আমাদের স্বাধীনতার মূলমন্ত্র। মতের পার্থক্য নিশ্চয়ই থাকবে। এবং এই পার্থক্য নিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে ভিন্নমত প্রকাশের অধিকারও প্রতিটি নাগরিকের থাকবে। কিন্তু এ নিয়ে হিংসা-হানাহানির কোনো সুযোগ নেই।

আমাদের গোলটেবিল বৈঠকের শিরোনাম ছিল ‘শান্তি ও সহিষ্ণুতা: প্রতিবন্ধকতা ও উত্তরণের উপায়’। এই আহ্বান নিয়ে বিভিন্ন গ্রাম ও শহরে, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বেশ কয়েকটি এনজিও, ইউএনডিপি, ইউএন উইমেনসহ বিভিন্ন উন্নয়ন–সহযোগী সংস্থার সহযোগিতায় ছোট ছোট গ্রুপ কাজ করছে। তাদের একটি প্রকল্প রয়েছে। নাম ‘অবিরোধ’। নাম থেকেই বোঝা যায়, মত-পথের ভিন্নতার সমাধান হবে শান্তিপূর্ণ ও সহনশীলতার পথে।

উগ্রবাদী চিন্তাধারা কেন তরুণদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে? এ প্রশ্নে সেদিন গোলটেবিল বৈঠকের আলোচনায় খুব যুক্তিপূর্ণ একটি কথা এসেছে। আমাদের দেশে পরিবারের মধ্যে যখন তরুণ সন্তান একাকী হয়ে পড়ে, তখনই সে অসহায় বোধ করে। মা-বাবা হয়তো কাজে ব্যস্ত। সন্তানের দিকে নজর দেওয়ার সময় কম। পরিবারের মধ্যে মা-বাবার স্বাভাবিক স্নেহবঞ্চিত এই তরুণেরাই শেষ পর্যন্ত হয়তো কারও পাল্লায় পড়ে বিভ্রান্তির পথে চলে যায়।

ফারাজ জীবন দিয়ে আমাদের বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন, শান্তি ও সৌভ্রাতৃত্ব আমাদের আদর্শ। ফারাজের আত্মদান বৃথা যায়নি। ফারাজ সারা বিশ্বকে জানিয়ে দিয়ে গেলেন, বাংলাদেশের মানুষ শান্তি ও সহনশীলতার প্রয়োজনে জীবনও দিতে পারে।

Add a Comment