নীতিনির্ধারকদের মধ্যে পর্যটনবিষয়ক জ্ঞানের অভাব রয়েছে

প্রথম আলো, ২০ জানুয়ারি ২০১৮


নানা প্রতিকূলতা সামনে ঠেলে এগোচ্ছে দেশের পর্যটন খাত। মানুষের আর্থিক সামর্থ্য বাড়ায় গত কয়েক বছরে দেশের অভ্যন্তরীণ পর্যটন খাত অনেকটাই সম্প্রসারিত হয়েছে। তবে একই সময়ে বিদেশ থেকে দেশে আসা পর্যটকের সংখ্যা কমে গেছে। আবার বাংলাদেশ থেকে বিদেশে ঘুরতে যাওয়ার প্রবণতাও বেড়েছে। পর্যটন খাতের বিভিন্ন সমস্যা–সম্ভাবনা নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ রাশিদুল হাসান ও বেঙ্গল ট্যুরস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসুদ হোসেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আশরাফুল ইসলাম

প্রথম আলো: আপনাদের ব্যবসা কেমন চলছে?
মাসুদ হোসেন: আমরা মূলত বিদেশ থেকে পর্যটক এনে (ইনবাউন্ড ট্যুরিজম) তাঁদের এ দেশ দেখানোর ব্যবস্থা করি। এ ব্যবসার অবস্থা খুবই খারাপ। চার বছর আগে আমাদের বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা ছিল ৫ হাজার, এই সংখ্যা এখন ১ হাজারে নেমে এসেছে। এ দেশে বিদেশি পর্যটকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আসে জাপান থেকে। জাপানি পর্যটকেরা এখন বলতে গেলে আসে না। আগে আমাদের গাইডসংখ্যা ছিল ২২, এখন তা আটজনে নেমে এসেছে।

প্রথম আলো: অভ্যন্তরীণ পর্যটন ব্যবসার অবস্থা তো ভালো, আপনারা সেদিকে যাচ্ছেন না কেন?
মাসুদ হোসেন: অভ্যন্তরীণ পর্যটনে অনেকেই কাজ করে, সেখানে বাড়তি যোগ করার মতো আসলে কিছু নেই। বিদেশি পর্যটক আনার একটা সুবিধা হচ্ছে সরাসরি বৈদেশিক মুদ্রা আয় করার একটা সুযোগ তৈরি হয়। এ ক্ষেত্রে দেশের অর্থনীতিতে আমাদের যথেষ্ট অবদান আছে। তবে অনেক আগে থেকেই সুন্দরবনে বিদেশি পর্যটকদের সঙ্গে আমরা দেশি পর্যটকদের নিয়ে যাই। এটা করার কারণ হলো বাংলাদেশে পর্যটকের সংখ্যা বাড়ছে, কিন্তু পর্যটকদের মধ্যে সচেতনতার ঘাটতি রয়েছে। পর্যটক হিসেবে একজন ব্যক্তির যে দায়িত্ববোধ ও সচেতনতা থাকা দরকার, সেটার উন্নয়নে আমরা কাজ করি। এখন পর্যন্ত ৩৫ হাজার দেশীয় পর্যটককে আমরা সুন্দরবন দেখিয়েছি, যাঁরা এখন সুন্দরবনকে ভালোবাসেন।

প্রথম আলো: বাংলাদেশে আসতে বিদেশি পর্যটকেরা কেন আগ্রহী হচ্ছেন না?
মাসুদ হোসেন: প্রথম সমস্যা হলো বাংলাদেশের নেতিবাচক ভাবমূর্তি, এটা দূর করা খুব জরুরি। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সবচেয়ে নিরাপদ ও শান্তিপ্রিয় জনগোষ্ঠী হচ্ছে বাঙালি। এ দেশের মানুষের অতিথিপ্রিয়তা নিয়ে নতুন করে বলার নেই। কিন্তু ভাবমূর্তি উন্নয়নে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে যে কাজগুলো করা দরকার, সেটা হচ্ছে না। ভাবমূর্তি উন্নয়নে যে ধরনের প্রচারণা, পরিকল্পনা ও অর্থ দরকার, সেটা সরকারই করতে পারে, বেসরকারি খাতের একার পক্ষে তা করা সম্ভব না।

প্রথম আলো: সরকার এ কাজটি কেন করতে পারছে না?
মাসুদ হোসেন: এ ধরনের কাজ করার জন্য যে ধরনের মেধা, দক্ষতা ও অর্থ দরকার—এটার সমন্বয় করার সক্ষমতা সরকারের নেই। নীতিনির্ধারকদের মধ্যে পর্যটনবিষয়ক জ্ঞানের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে গরিব হলেও এ দেশের মানুষ যে কতটা উন্নত মননের, এ কথাটা বাইরে বলতে হবে। আরেকটি সমস্যা হচ্ছে বাংলাদেশে পর্যটনের কী কী পণ্য আছে, এগুলোর উন্নয়নে কী করা যায় এবং এগুলো কাদের জন্য উপযোগী—সেটা নিয়ে বিস্তারিত কাজ হয় না। এই খাতে যেসব ট্যুর অপারেটর কাজ করে তাদের পরিচালনার জন্য কোনো নীতিমালা বা আইন নেই। সরকারি অনুমোদন বলতে আমার কাছে একটা লাইসেন্স আছে, সেটা নিয়ে কাজ চলছে। কিন্তু এ ধরনের একটি স্পর্শকাতর ব্যবসার জন্য জবাবদিহি থাকা উচিত। সেটা না থাকায় আমরা কাউকে জবাবদিহি করছি না, আমাদের কাছেও কেউ তা চাইছে না। দেশের জন্য বৈদেশিক মুদ্রা রপ্তানি করেও কোনো বিশেষ প্রণোদনা আমরা পাই না।

প্রথম আলো: পর্যটন খাতে পর্যাপ্ত লোকবল কি আছে?
মাসুদ হোসেন: যাতায়াত, রেস্তোরাঁ, গাইডসহ এ খাতের কোনো জায়গাতেই পরিপূর্ণ লোকবল নেই। এদের জন্য প্রশিক্ষণের কোনো ব্যবস্থা নেই। পর্যটন করপোরেশনের যে ইনস্টিটিউট আছে সেখান থেকে বছরে মাত্র ৩০০ লোক বের হয়, কিন্তু এ খাতে দরকার ৩০ হাজার লোকের। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ট্যুরিজমে যাঁরা পড়াশোনা করেন তাঁরা কাজ পাচ্ছেন না। এর চেয়ে নিচের স্তরে যাঁরা কাজ করে তাঁদের এ মুহূর্তে বেশি দরকার। পলিটিক্যাল ইনস্টিটিউটে পর্যটনবিষয়ক পড়ালেখা চালু হলেও পর্যাপ্ত শিক্ষক নেই।

প্রথম আলো: অনেক দর্শনীয় স্থান পর্যটকদের চাপে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এ বিষয়ে কী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে?
মাসুদ হোসেন: একটা স্থানে কতজন লোক যেতে পারে, এ বিষয়ে কোনো নীতিমালা বাংলাদেশে নেই। কক্সবাজার, সেন্ট মার্টিন দ্বীপসহ অনেক জায়গায় এসব সমস্যা দেখা যাচ্ছে। একটি জায়গার সৌন্দর্য রক্ষায় পর্যটকদের মধ্যে সচেতনতা তৈরির কাজগুলো সবাইকে উদ্যোগী হয়ে করতে হবে।

প্রথম আলো: এসব সমস্যা সমাধানে কী পদক্ষেপ নেওয়া উচিত?
মাসুদ হোসেন: এই খাতের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের সবাইকে নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা তৈরির মাধ্যমে সমস্যা সমাধান করতে হবে। জাতীয় বাজেটে পর্যটন খাতের জন্য খাতভিত্তিক বরাদ্দ দিতে হবে। পর্যটন নিয়ে প্রচার-প্রচারণা বাড়ানোর বিষয়েও গুরুত্ব দিতে হবে।

Add a Comment