এসডিজি অর্জনে লাগবে ১৮০০ পদ্মা সেতুর টাকা**

প্রথম আলো, ২১ জুলাই ২০১৭
জাহাঙ্গীর শাহ


টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) অর্জনে বাংলাদেশের জন্য অর্থায়নই বড় সমস্যা। এ নিয়ে বিভিন্ন মহলে ব্যাপক আলোচনাও হচ্ছে। গত দুই বছরেও কী পরিমাণ অর্থ প্রয়োজন হবে, তা হিসাব করা হয়নি। সম্প্রতি পরিকল্পনা কমিশন অর্থায়নের হিসাবটি করেছে। সেখানে দেখা গেছে, এসডিজি বাস্তবায়নে যে টাকা খরচ হবে, তা দিয়ে চলতি অর্থবছরের বাজেটের মতো ১২৫টি বাজেট দেওয়া যাবে। চলতি অর্থবছরে বাজেটের আকার ৪ লাখ কোটি টাকা।

পরিকল্পনা কমিশনের হিসাবে, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) অর্জনে বাংলাদেশকে আগামী ১৩ বছরে ৫ লাখ কোটি ডলার খরচ করতে হবে। টাকার অঙ্কে এর পরিমাণ প্রায় ৪ কোটি ৯৮ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি অর্জনের সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে।

এবার দেখা যাক, এসডিজি বাস্তবায়নের জন্য যে অর্থ লাগবে, তা দিয়ে কী করা যাবে। হিসাব করে দেখা গেছে, এই অর্থ দিয়ে প্রায় ১ হাজার ৮০০টি পদ্মা সেতু তৈরি করা যাবে। পদ্মা সেতু নির্মাণে ২৮ হাজার কোটি টাকার বেশি খরচ হচ্ছে।

সম্প্রতি পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ (জিইডি) ‘এসডিজির অর্থায়ন কৌশল: বাংলাদেশ প্রেক্ষিত’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) সহায়তায় জিইডির পক্ষে এই প্রতিবেদন তৈরি করেছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং বা সানেম।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে জিইডির সদস্য শামসুল আলম সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি বেসরকারি খাতনির্ভর। তাই এসডিজির অর্থায়নের জন্য বেসরকারি খাতকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। সরকার বেসরকারি বিনিয়োগের সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করবে।

এসডিজির অর্থায়নে দুই পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছে। উভয় পদ্ধতিতে এসডিজি অর্জনে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি বিবেচনায় আনা হয়েছে। প্রথমটিতে ২০১৬-১৭ অর্থবছর থেকে ২০২৯-৩০ অর্থবছরে গড়ে ৭ শতাংশ মোট জিডিপি প্রবৃদ্ধি ধরে অর্থায়নের হিসাব করা হয়েছে। অপরটিতে সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতায় ২০৩০ সাল নাগাদ ৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে—এমন প্রাক্কলন করে এসডিজির অর্থায়নের কৌশল নির্ধারণ করা হয়েছে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৭ শতাংশ গড় প্রবৃদ্ধি ধরে আগামী ১৩ বছর প্রতিবছর গড়ে ৩৫ লাখ ৬৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা খরচ করতে হবে। অন্যদিকে সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০৩০ পর্যন্ত মোট ৪ কোটি ৬০ লাখ ৮১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা প্রয়োজন হবে। প্রতিবছর গড়ে ৩৩ লাখ কোটি টাকার বেশি খরচ করতে হবে।

অর্থায়নের কৌশল
এসডিজি অর্থায়নে বেসরকারি খাতের ওপরেই ভরসা রাখতে চায় সরকার। পরিকল্পনা কমিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এসডিজির প্রায় ৪২ শতাংশই আসবে বেসরকারি খাত থেকে। সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ থেকে আসবে আরও প্রায় ১০ শতাংশ। এই দুটি উপখাতই বেসরকারি বিনিয়োগ।

এসডিজি অর্জনের জন্য মোট খরচের সাড়ে ৩৩ শতাংশের জোগান দেবে সরকার নিজের উৎস থেকে। আর বিদেশি সহায়তা ও অনুদান বাবদ আসবে আরও প্রায় ৫ শতাংশের মতো। সরকারের নিজের অংশ এবং বিদেশি সহায়তার টাকা প্রতিবছর বাজেটের মাধ্যমে খরচ করা হবে। এ ছাড়া সরকারি–বেসরকারি অংশীদারত্বে (পিপিপি) যেসব প্রকল্প হবে, সেখানে থাকবে সাড়ে ৫ শতাংশ অর্থায়ন।

সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান মনে করেন, বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এসডিজির সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব জ্বালানি, শোভন কাজ ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, শিল্পায়ন, সৃজনশীলতা ও অবকাঠামো—এই তিনটি লক্ষ্য অর্জনে বেশি জোর দিতে হবে। এসব খাতে বেশি বিনিয়োগ করতে হবে। তাঁর মতে, সরকারি বিনিয়োগ দিয়ে সাময়িকভাবে ভালো প্রবৃদ্ধি অর্জন হবে। কিন্তু উচ্চ প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে বেসরকারি বিনিয়োগ লাগবেই। এসডিজি বাস্তবায়নের জন্য যেসব সংস্কার করতে হবে, তাতে রাজনৈতিক সদিচ্ছা দরকার।

বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে বেসরকারি সংস্থা বা এনজিওগুলোর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। সরকার এসডিজি বাস্তবায়নে এনজিওকে সম্পৃক্ত করতে চায়। এনজিওর মাধ্যমে মোট খরচের প্রায় ৪ শতাংশের মতো ধরা হয়েছে।

এসডিজির জন্য ৮৫ শতাংশ অর্থের জোগান দেওয়া হবে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে। পরিকল্পনা কমিশন বলছে, অর্থায়নের ক্ষেত্রে এটা অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ। আগামী ১৩ বছরে ৯ শতাংশীয় পয়েন্ট হারে কর আদায় করা সহজ নয়। এ জন্য এনবিআরকে অটোমেশনসহ বিভিন্ন সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে হবে। বর্তমানে প্রতিবছর যে ধারাবাহিকতায় সংশ্লিষ্ট খাতগুলোয় বিনিয়োগ হচ্ছে, আগামী ১৩ বছর এই ধারাবাহিকতা বজায় থাকলেও এসডিজির জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের জোগান দেওয়া সম্ভব হবে না। অতিরিক্ত অর্থের প্রয়োজন হবে। পরিকল্পনা কমিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এর পরিমাণ ৯২ হাজার ৮০০ কোটি ডলার। প্রতিবছর গড়ে ৬ হাজার ৬০০ কোটি ডলার অতিরিক্ত জোগান দিতে হবে।

Add a Comment