ইস্যু হিসেবেও তিস্তা কি শুকিয়ে গেল!

সমকাল, ০৭ মে ২০১৮
শেখ রোকন, লেখক ও নদী গবেষক


শিরোনামের প্রশ্ন বা বিস্ময়- যাই বলি না কেন, মনে এসেছিল এপ্রিলের গোড়ার দিকে। ওই সময় ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিজয় কেশব গোখলে ঢাকা সফরে এসেছিলেন। সকালে দ্বিপক্ষীয় রাষ্ট্রীয় বৈঠক শেষে দুপুরের পর রাজধানীর একটি অভিজাত হোটেলে ঢাকাই থিঙ্কট্যাঙ্ক আয়োজিত এক সেমিনারে অতিথি হিসেবে বক্তৃতাও দিয়েছিলেন। আমার সুযোগ হয়েছিল সেখানে শ্রোতা হিসেবে উপস্থিত থাকার। স্বভাবতই কৌতূহল ছিল তিনি তিস্তা ইস্যুতে কী বলেন। দুই দেশের সম্পর্ক ও সম্ভাবনা নিয়ে অনেক কথাই বললেন। কেবল পররাষ্ট্র সচিব হিসেবে নয়, তার গোটা জীবনে যে এটাই ঢাকায় প্রথম সফর, সে কথাও বিনয় ও বন্ধুত্বের স্বর মিশিয়ে বললেন। কিন্তু নিরবচ্ছিন্ন মনোযোগে শোনার পরও তলিয়ে দেখলাম, তার ১২-১৩ মিনিটের কোথাও ‘তিস্তা’ শব্দটি পর্যন্ত উল্লেখ করলেন না।

আরও বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা তার পরের বক্তা। আগের বক্তার মতো তিনিও ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ঐতিহাসিকতা ও ঘনিষ্ঠতা নিয়ে কথা বললেন। দক্ষিণ এশিয়ায় উন্নয়ন, শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য দুই দেশের যৌথভাবে কাজ করার কথা বললেন। কিন্তু ঠিক তিস্তা ইস্যুতে কিছু বললেন না। পুনরায় বলছি, কিছুই বললেন না। আমার পাশে বসে আরেকজন শ্রোতা তার মোবাইল ফোনে নানাভাবে ছবি তুলছিলেন, নোট নিচ্ছিলেন, রেকর্ড করছিলেন। বিস্ময়ের ঘোর কাটাতে তারও কাছে জানতে চাইলাম। মঞ্চের সঙ্গে ‘সেলফি’ নিতে নিতে বললেন, তিনিও শোনেননি।

এটা ঠিক, সকালের আনুষ্ঠানিক বৈঠকে তিস্তা ইস্যু ‘আলোচিত’ হয়েছিল। দুই সচিবের মধ্যে ছয়টি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হওয়ার সংবাদের সঙ্গে বাংলাদেশি সংবাদমাধ্যমগুলো এই খবরও পরিবেশন করেছে। অবশ্য সবই বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিবের বরাতে। ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো দেখলাম বরং আসামের নুমালিগড় থেকে বাংলাদেশের পার্বতীপুর পর্যন্ত ১৩০ কিলোমিটার তেল পাইপলাইনেই বেশি জোর দিয়েছে। রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে নয়াদিল্লি যে ঢাকার পাশে থাকবে, আলোকপাত করেছে সেখানেও। কিন্তু তিস্তা ইস্যুতে ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব কোথাও উদ্দৃতত হননি। অন্তত আমি যেসব সংবাদমাধ্যমের অনলাইন সংস্করণে ঢুঁ মেরেছি, সেগুলোতে। টাইমস অব ইন্ডিয়া চীনা সংবাদ সংস্থা সিনহুয়া থেকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিবকে উদ্দৃতত করে জানিয়েছে, ঝুলে থাকা তিস্তা পানি বণ্টন ইস্যুতে ভারতের দিক থেকে ‘অগ্রগতি’ নিয়ে বাংলাদেশ পক্ষ ‘হ্যাপি’। আনুষ্ঠানিক বৈঠকে দুই পররাষ্ট্র সচিব ‘দুই দেশের সম্পর্কের সব প্রেক্ষিত’ নিয়েই আলোচনা করেছেন। আলোচনার ফল নিয়ে তারা ‘আনন্দিত’।

ভারত ও বাংলাদেশি সংবাদমাধ্যম ঘেঁটে বের করতে পেরেছিলাম যে, ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব ঠিক কী বলেছিলেন। বৈঠক শেষে সংবাদমাধ্যমের কাছে যৌথ ব্রিফিংকালে তিনি বলেছিলেন, ‘ওই হ্যাভ অলরেডি টকড অ্যাবাউট দ্য ওয়াটার শেয়ারিং ম্যাটার অব আইডেন্টিকেল রিভারস’। সোজা বাংলায়- আমরা ইতিমধ্যে নির্দিষ্ট নদীগুলোর পানি বণ্টন বিষয়ে কথা বলেছি। তিনি আরও বলেন, ২০১১ সালে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুসারে তার দেশ এই সমস্যা দ্রুত সমাধানের ‘প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত’ করেছে। লক্ষণীয়, ব্রিফিংকালে ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিবের ঢাকা সফরের পুরো কর্মসূচি মনোযোগের সঙ্গে নিরীক্ষা করলে দুটি বিষয় দেখা যাবে। প্রথমত, তিনি তিস্তার পানি বণ্টন ইস্যুতে সুনির্দিষ্ট কিছু বলেননি। ভারতীয় পক্ষ থেকে গত কয়েক বছর ধরে বলে আসা কথাই আবার বলেছেন; দ্বিতীয়ত, এ ক্ষেত্রে তিনি ‘তিস্তা’ শব্দটিও উচ্চারণ করতে যেন কুণ্ঠিত ছিলেন।

প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশের দিক থেকেও কি তিস্তা ইস্যু সাম্প্রতিককালে জোরেশোরে উচ্চারিত হচ্ছে? আমরা জানি, তিস্তা নিয়ে দুই দেশের আলোচনা শুরু হয়েছিল পঞ্চাশের দশকে। তারপর পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন বাংলাদেশ হিসেবে বিশ্বের মানচিত্রে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। তারপর তিস্তা দিয়ে অনেক পানি গড়িয়ে গেছে তো বটেই; আশির দশকে সীমান্তের দুই পাশেই দুটি ব্যারাজ নির্মিত হয়ে সেই পানিও গড়ানো বন্ধ হয়ে গেছে। সেই পুরনো আলোচনা এখন তোলা অবান্তরই হতে পারে। ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময় ‘স্বাক্ষরের জন্য প্রস্তুত’ চুক্তি কীভাবে ভেস্তে গিয়েছিল। তার উত্তরসূরি নরেন্দ্র মোদি ২০১৫ সালের জুনে ঢাকায় এসে ‘খুব শিগগিরই’ চুক্তিটি স্বাক্ষরের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে বলেছিলেন, তার প্রধানমন্ত্রিত্বের মেয়াদকালেই চুক্তি স্বাক্ষর সম্ভব হবে। এসবই সবার জানা। এই স্বল্পদৈর্ঘ্য নিবন্ধের সীমিত পরিসরে এগুলো আলোচনার অবকাশ নেই। আমি শুধু ২০১৮ সালের গত চার মাসে তিস্তা ইস্যুতে বাংলাদেশ পক্ষের কয়েকটি ‘তাগিদ’ আলোচনা করতে চাই।

অনেকের মনে আছে, বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ মার্চের গোড়ায় নয়াদিল্লি গিয়েছিলেন আন্তর্জাতিক সৌর সংস্থার সম্মেলনে বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করতে। সম্মেলনের সাইড লাইনে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বৈঠক হয় তার। সেখানে তিনি তিস্তার পানি বণ্টন ইস্যু নিয়ে তাগিদ দিলে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী বলেন, তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরের ব্যাপারে যেসব প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, তারা সেগুলো সমাধানের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। বাংলাদেশি সংবাদমাধ্যমের কাছে রাষ্ট্রপতির প্রেস সচিবের বক্তব্য অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম উল্লেখ না করেই ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ‘সংশ্নিষ্ট সবাইকে নিয়েই’ ইস্যুটি সমাধানের আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

এপ্রিলের চতুর্থ সপ্তাহের শুরুতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের নেতৃত্বে শীর্ষ পর্যায়ের একটি প্রতিনিধি দল ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপির আমন্ত্রণে দিল্লি সফর করে। এ সময় ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তার বাসভবনে এক বৈঠকে মিলিত হন তারা। আধঘণ্টার ওই বৈঠকে তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলকে আশ্বাস দিয়ে নরেন্দ্র মোদি বলেন, ‘আমরা দ্রুত এর সমাধান করতে আগ্রহী।’ আশ্বাসের এই খবর সাংবাদিকদের দেন নয়াদিল্লির বাংলাদেশি দূতাবাসের প্রেস মিনিস্টার।

অবশ্য চ্যানেল আই অনলাইনে প্রকাশিত এক খবরে দেখেছিলাম, প্রতিনিধি দলের পাঁচ সদস্যের সঙ্গে প্রায় ৪০ মিনিটের ওই বৈঠকে কী কথা হয়েছে, কোনো পক্ষই আনুষ্ঠানিকভাবে স্পষ্ট করেনি। এক প্রশ্নের জবাবে বৈঠকে অংশ নেওয়া আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ বলেন, তিস্তার পানি বণ্টনের বিষয়ে আশাবাদ জানিয়ে নরেন্দ্র মোদি বলেছেন :বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার অমীমাংসিত প্রায় সব ইস্যুর যেহেতু সমাধান হতে শুরু করেছে, তাই তিস্তার পানি বণ্টন সমস্যারও সমাধান হয়ে যাবে।

তার দু’দিন আগে অবশ্য লন্ডনে সাক্ষাৎ হয়েছিল বাংলাদেশ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রীর। দু’জনই কমনওয়েলথ শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে গিয়েছিলেন। সম্মেলনের সাইড লাইনে দুই নেতার মধ্যে বৈঠকে দ্বিপক্ষীয় অন্যান্য ইস্যুর মধ্যে তিস্তা ইস্যুও উঠে এসেছিল বলে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব সাংবাদিকদের বলেন। যদিও কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকা এপ্রিলের শুরুতেই ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ‘অভ্যন্তরীণ উৎস’ উদ্দৃতত করে বলেছিল, লন্ডনে দুই নেতার বৈঠকে ‘তিস্তা নিয়ে কোনো চূড়ান্ত কথা দেওয়া সম্ভব হবে না মোদির পক্ষে’। পত্রিকাটির প্রতিবেদন অনুযায়ী ‘সম্প্রতি ভারতের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, তিস্তা ছাড়াও আরও অনেক দিক রয়েছে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে।’

গত চার মাসে দুই দেশের মধ্যে এসব আলোচনার গতি ও প্রকৃতি বিশ্নেষণ করে বোঝার জন্য বিশেষজ্ঞ হতে হয় না যে, তিস্তা এখন নিছক ‘বাত কা বাত’। অনেক দিন ধরে আলোচনা চলছে, অনেক দফা প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে; সাক্ষাৎ হলে ইস্যুটি না তুললে কেমন হয়! অনেকটা ‘লোকে কী বলবে’ ধরনের তাগিদ থেকে। এক পক্ষ থেকে ইস্যুটি তোলা, আরেক পক্ষ থেকে ঠারে ঠারে পুরনো প্রতিশ্রুতি মনে করিয়ে দেওয়া। তারপর দু’পক্ষই যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে!

আগে তাও আলোচনা বা সাক্ষাতের পর ভারতীয় পক্ষে তিস্তা ইস্যুতে ‘প্রতিশ্রুতি’ সংবাদমাধ্যমের কাছেও পুনর্ব্যক্ত করা হতো। গত কয়েক মাসে তাও মিলিয়ে গেছে। লক্ষণীয়, এ বছরের সবক’টি বৈঠকে ‘তিস্তা ইস্যু আলোচনা’ হওয়ার খবর আমরা পেয়েছি বাংলাদেশি পক্ষ থেকে। মনে হতে পারে, তিস্তা যেমন পানিশূন্য, ইস্যু হিসেবে খোদ তিস্তাও যেন তেমনই শুকিয়ে গেছে।

এ ক্ষেত্রে একটি অজুহাত দু’পক্ষই দেখায়- ‘নির্বাচনের বছর’। এ বছর ও আগামী বছরের সন্ধিক্ষণে দুই দেশেই সাধারণ নির্বাচন হবে। জটিল ও প্রাচীন তিস্তা ইস্যু যে তার আগের কয়েক মাসে সমাধান সম্ভব নয়, কে না জানে! কিন্তু তাই বলে আলোচনা চালাতে দোষ কী! বিষয়টি সত্যিই বিস্ময়কর।

Add a Comment