আশা ও হতাশার ‘পেংলং সম্মেলন’****

প্রথম আলো, ১৪ জুলাই ২০১৮
আলতাফ পারভেজ: দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ের গবেষক


অশান্ত মিয়ানমারে আবার জাতিগত শান্তি সম্মেলন শুরু হলো। অং সান সু চির এনএলডির শাসনামলে দ্বিতীয় জাতীয় শান্তি সম্মেলন এটি। আরও সঠিকভাবে বললে এটি হলো ‘একুশ শতকের তৃতীয় পেংলং সম্মেলন।

যুদ্ধবিধ্বস্ত মিয়ানমারের ইতিহাস, রাজনীতি ও সমর-সংঘাতে পেংলং সম্মেলনের ঐতিহাসিক গুরুত্ব এত বেশি যে দেশটির সব আশা-প্রত্যাশা-হতাশার কেন্দ্রবিন্দু এটি। যথারীতি এবারও মানুষ এই সম্মেলন থেকে এমন কোনো ঐকমত্য আশা করছে, যা পাঁচ দশকের পুরোনো গেরিলাজীবন থেকে ওয়া, কাচিন, শ্যান, কারেন, আরাকানিদের ঘর-সংসারে ফিরতে সাহায্য করবে। কিন্তু আদৌ বামার সেনানায়কেরা শান্তির জন্য নিয়ন্ত্রণ শিথিল করতে প্রস্তুত কি না, সে প্রশ্নে রয়েছে গভীর সন্দেহ। রোহিঙ্গা সংকটের কারণে মিয়ানমারের এ সপ্তাহের সম্মেলনের দিকে তাকিয়ে আছে বহির্বিশ্বও।

রাজধানী নেপিডোতে ১০ জুলাই এই সম্মেলন শুরু হয়েছে, চলবে ১৬ জুলাই পর্যন্ত। জাতিগত সংগ্রামী সশস্ত্র ও নিরস্ত্র প্রায় সব প্রধান দলের প্রতিনিধিরাই সম্মেলনে এসেছেন। বিশেষভাবে রয়েছে সরকারের সঙ্গে যুদ্ধবিরতিতে থাকা ১০টি গ্রুপ এবং যুদ্ধরত ৭টি গ্রুপ।

যেসব দল এখনো মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধরত, তাদের জোটকে স্থানীয়ভাবে ‘নর্দার্ন অ্যালায়েন্স’ বলা হয়। এতে আছে কেআইও (কাচিন ইনডিপেনডেন্ট আর্মি), এএ (আরাকান আর্মি), ওয়া আর্মি ইত্যাদি গেরিলাদল। ওয়া আর্মি হলো এ মুহূর্তে বিশ্বের সবচেয়ে বড় গেরিলাদল। প্রায় ২০ হাজার সুশৃঙ্খল যোদ্ধা রয়েছে তাদের। বিভিন্ন জাতিসত্তার এসব দল কমবেশি গত ৫০ বছর যাবৎ শান্তি, মর্যাদা ও আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের দাবিতে সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। এই যুদ্ধ থেকে ‘ইউনিয়ন’বাসীকে মুক্তি দেওয়ার লক্ষ্যে পেংলং সম্মেলন হচ্ছে। কিন্তু তাতে কাঠামোগত প্রতিবন্ধকতা বিপুল।

পেংলং সম্মেলন: মিয়ানমার প্রতিষ্ঠার গোড়ার কথা

পেংলং মিয়ানমারের শ্যান স্টেটের একটি শহর। এই শহরেই ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলের শেষ লগ্নে ১৯৪৭ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি প্রথম ‘পেংলং সম্মেলন’ হয়, যেখানে বার্মার জনগোষ্ঠীর পক্ষে জেনারেল অং সানের সঙ্গে চিন, কাচিন ও শ্যান প্রতিনিধিরা ইউনিয়ন গঠনের চুক্তি করেছিলেন। শেষোক্ত এলাকাগুলোকে ব্রিটিশরা ‘ফ্রন্টিয়ার এরিয়া’ বলত এবং এগুলো পৃথক রাজনৈতিক সত্তা আকারেই ছিল। ফ্রন্টিয়ার এলাকার মানুষেরা বামারদের এলাকাকে বলত ‘মিনিস্ট্রিয়াল বার্মা’ বা ‘বার্মা প্রপার’। চিন, কাচিন ও শ্যানদের পক্ষে মিনিস্ট্রিয়াল বার্মার সঙ্গে চুক্তির উদ্যোক্তারা মনে করছিলেন, বড় জনজাতি বামারদের সঙ্গে এই চুক্তি ব্রিটেনের কাছ থেকে সম্পূর্ণ অঞ্চলের স্বাধীনতাকে ত্বরান্বিত করবে।

নয়টি ধারাসংবলিত ঐতিহাসিক প্রথম পেংলং চুক্তির মাধ্যমে শ্যান, কাচিন ও চিনরা নিজ নিজ প্রদেশে (‘স্টেট’ বলা হতো) পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনসহ বামারদের নিয়ে ইউনিয়নরূপী ‘বার্মা রাষ্ট্র’ গঠনে সম্মত হয়। এই চুক্তিতে কারেন ও শ্যানদের পৃথক হওয়ার অধিকার দেওয়া হয়। আসলে চুক্তির মধ্য দিয়ে তখনকার অপ্রধান জাতিসত্তাগুলো বড় জাতি বামারদের প্রতিনিধি জেনারেল অং সাংয়ের ওপর তাদের ভবিষ্যৎ স্বাধিকারের প্রশ্নটি মীমাংসার ভার অর্পণ করেছিল একধরনের বিশ্বাস থেকে। প্রথম পেংলংয়ের সফলতা মিয়ানমারের সব জাতির মধ্যেই ফেডারেলধর্মী একটি রাষ্ট্রের স্বপ্ন সৃষ্টি করেছিল। এই চুক্তির স্মরণেই ১২ ফেব্রুয়ারি দেশটিতে ‘ইউনিয়ন ডে’ হিসেবে পালিত হয় এখনো। ওই চুক্তি স্টেটগুলোর আর্থিক স্বায়ত্তশাসনেরও নিশ্চয়তা দিয়েছিল। তখন এ-ও বলা হয়, কোনো স্টেট চাইলে ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে যেতে পারবে।

অং সানের মৃত্যু: যুদ্ধের শুরু
১৯৪৭-এ পেংলং সম্মেলন ইউনিয়নরূপী একটি দেশ গঠনের আশা জাগালেও স্বাধীনতার উষালগ্নে, রাজনৈতিক ক্ষমতালাভের ঠিক পূর্বক্ষণে, সংবিধান সভার নির্বাচনের মাত্র ৩ মাসের মধ্যে, ১৯৪৭-এর ১৯ জুলাই ইয়াঙ্গুনে একদল সশস্ত্র ব্যক্তির হাতে অং সান সাতজন গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সহযোগীসহ নিহত হন। এ সময় ব্রিটিশদের হাত থেকে ক্ষমতা হস্তান্তরের লক্ষ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের বৈঠক চলছিল।

অং সানের মৃত্যু ধীরে ধীরে জাতিগত আত্মবিশ্বাসের পুরোনো ছকটি পাল্টে দেয়। অং সানের বামার সহযোগীরা ক্রমে ‘পেংলং ঐকমত্য’ থেকে দূরে সরে যেতে থাকে। ১৯৬২ সালে জেনারেল নে উইনের সামরিক অভ্যুত্থান জাতিগত সম্মিলনের পুরো প্রক্রিয়া চূড়ান্তভাবে ধ্বংস করে দেয়। গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। সেই ধারাবাহিকতায় ২০০৮ সালে এসে সেনাবাহিনী নতুন যে সংবিধান রচনা করে, তাতে সংখ্যালঘু জাতিসত্তা-অধ্যুষিত স্টেটগুলোর (প্রদেশ) স্বায়ত্তশাসন অনেকখানি খর্ব করে ফেলা হয়। এভাবে সর্বগ্রাসী সংঘাতই দেশটির নিয়তি হয়ে ওঠে।

এ রকম পটভূমিতেই ক্ষমতায় এসে বেসামরিক সরকারের প্রধান হিসেবে অং সান সু চি পিতার অসমাপ্ত কাজ জাতিগত মৈত্রী ও ইউনিয়ন বার্মার পুনরুজ্জীবনের উদ্যোগ নেন। সেই উদ্যোগেরই ফল হিসেবে ২০১৬ সালের ৩১ আগস্ট থেকে পরবর্তী ৫ দিন মিয়ানমারে দ্বিতীয় পেংলং সম্মেলন হয়। সু চির সরকার একে অভিহিত করে ‘একবিংশ শতাব্দীর পেংলং’ তথা ‘দ্বিতীয় পেংলং শান্তি সম্মেলন’ বলে। সে ধারাবাহিকতাতেই এ সপ্তাহে হচ্ছে তৃতীয় পেংলং শান্তি সম্মেলন। যদিও এবার সম্মেলনটি হচ্ছে শ্যান স্টেটের পেংলংয়ে নয়, রাজধানী নেপিডোতে।

আশা-প্রত্যাশা-হতাশা
এবারের মতোই ২০১৬ সালের দ্বিতীয় পেংলং সম্মেলনেও মিয়ানমারজুড়ে তীব্র আশাবাদ তৈরি হয়েছিল। কিন্তু সম্মেলন শেষে কোনো সিদ্ধান্তই গৃহীত হয়নি। ২০টির মতো সংগঠন ওই সম্মেলনে উপস্থিত হয়ে বিভিন্ন জাতিসত্তার ক্ষোভ-বিক্ষোভের কারণগুলো তুলে ধরে। ওই পেংলং সম্মেলনে মুখ্য বিবাদিত বিষয় ছিল দুটি: সংবিধানে ‘ইউনিয়ন থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার অধিকার’ থাকা এবং সেনাবাহিনীকে ‘ফেডারেল’ চরিত্র দেওয়া। এ ছাড়া জাতীয় সম্পদের আন্তজাতিভিত্তিক বণ্টনও মিয়ানমারজুড়ে বড় বিবাদিত বিষয়।

স্বাধীনতার পরপর ১৯৪৮ সালের সংবিধানে (১০ম অধ্যায়) সংখ্যালঘু জাতিসত্তাগুলোর প্রাধান্যপূর্ণ প্রদেশগুলোকে ইউনিয়ন থেকে পৃথক হওয়ার অধিকারের যে স্বীকৃতি দেওয়া হয়, ২০০৮-এর সংবিধানে তা বাদ পড়েছে এবং সেখানে উল্লেখিত হয়েছে, ‘রাষ্ট্রের কোনো অংশ কখনোই আলাদা হতে পারবে না।’ সর্বশেষ সংবিধানের দুটি বড় বৈশিষ্ট্য হলো তাতে ইউনিয়নের একত্বের ওপর বেশি জোর দেওয়া হয় এবং মিয়ানমারকে একটা জাতি হিসেবে অভিহিত করা হয়। কাচিন, শ্যান, কারেন জাতিগোষ্ঠীগুলো চাইছে, সংবিধানের পুরোনো চরিত্রটি আবার বহাল হোক।

মিয়ানমারের নিরপেক্ষ রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকমাত্রই মনে করেন, বর্তমান সংবিধান বামার প্রাধান্যপূর্ণ সেনাবাহিনীকে যেরূপ বাস্তব ক্ষমতা দিয়ে রেখেছে, তার ফলে অ-বামার জাতিগুলোকে অধিকতর স্বায়ত্তশাসন দিয়ে ফেডারেল রাষ্ট্রের পুনর্গঠন খুবই দুরূহ। অথচ ‘নতুন শতাব্দীর পেংলং’-এর চলতি তৃতীয় দফা আলোচনা এবং তার সফলতা নির্ভর করছে সংবিধানের সম্ভাব্য সফল সংশোধনীর ওপর।

সু চির দল ‘ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি’ সংবিধান সংশোধনের পক্ষে প্রকাশ্যে বলে থাকে। কিন্তু সর্বশেষ সংবিধানে পার্লামেন্টের উভয় কক্ষে সশস্ত্র বাহিনীর জন্য ২৫ শতাংশ আসন সংরক্ষণের বিধান করা হয়েছে। ফলে সংবিধানের যেকোনো সংশোধনী ইচ্ছা করলেই সশস্ত্র বাহিনী আটকে দিতে পারে।

পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষকে ‘আমোথা হুলুথ’-এর সদস্যসংখ্যা ২২৪-এর মধ্যে বিভিন্ন রিজন ও স্টেট থেকে মোট ১৬৮ জন নির্বাচিত হয়ে আসেন; বাকি ৫৬ জনই থাকেন সেনাসদস্য। যেহেতু দেশটির ‘রিজন’গুলো মূলত বামার আধিপত্যপূর্ণ এবং সেনাবাহিনীও তা-ই, ফলে দেখা যায়, উচ্চকক্ষে সদস্যদের মধ্যে বামারদের তুমুল আধিপত্য। নিম্নকক্ষের পরিস্থিতিও অনুরূপ। সেখানে (‘প্লিথু হুলুথ’ নামে পরিচিত) সদস্যসংখ্যা ৪৪০। এর মধ্যে সেনাসদস্য ১১০ জন।

সর্বশেষ (এবং আগেও) এই পার্লামেন্টেও বামার প্রাধান্যপূর্ণ দলগুলোরই আধিপত্য রয়েছে। দেশটিতে জাতিগত সংখ্যালঘুদের সম্মিলিত কোনো দল নেই। মিয়ানমারে জাতীয়ভাবে যে গুটিকয়েক দল সক্রিয়, সেগুলোর গুরুত্বপূর্ণ নেতারাও সবাই বামার। এভাবে মিয়ানমারের পুরো রাজনৈতিক উপরিকাঠামো এবং সেনা আমলাতন্ত্র বামার প্রাধান্যতায় পূর্ণ। এরূপ কাঠামোর ব্যাপকভিত্তিক সংস্কার ও পরিবর্তন ছাড়া চলতি পেংলং সম্মেলন কোনোরূপ বাস্তব শান্তি আনতে পারবে কি না, সেটা গভীরভাবে প্রশ্নবিদ্ধ।

তারপরও বিশ্ববাসীর চোখ এ মুহূর্তে নেপিডোর দিকে। সবাই দেখতে চাইছে, জাতিগত সহাবস্থানের যে বহুত্ববাদের কথা বলেছিলেন জেনারেল অং সাং প্রায় সাত দশক আগে, তাঁর কন্যা আবার সেটার অর্থবহ পুনরুজ্জীবন ঘটাতে পারেন কি না!

Add a Comment