আওয়ামী লীগের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ

প্রথম আলো, ২৩ জুন ২০১৮
মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক


১৯৪৭ সালের ৩ জুন আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হয় ‘মাউন্টব্যাটেন প্ল্যান’, সেখানে বাংলা ভাগের প্রস্তাব ছিল। ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চের ‘লাহোর প্রস্তাবে’ ভারতের মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলগুলো নিয়ে ‘রাষ্ট্রসমূহ’ গঠন করার ঘোষণা ছিল। ১৯৪৬ সালের ৯ এপ্রিল প্রস্তাব সংশোধন করে একটি একক রাষ্ট্র তৈরির প্রস্তাব নেওয়া হয়। ওই সময় মুসলিম লীগ থেকে নির্বাচিত একমাত্র প্রাদেশিক প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী ‘এক পাকিস্তানের’ প্রস্তাবটি উত্থাপন করেছিলেন। তখন তিনি মুসলিম লীগের নেতা মুহম্মদ আলী জিন্নাহর খুবই অনুগত। তিনি ভেবেছিলেন, নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানে জিন্নাহ রাষ্ট্রপ্রধান হলে বাংলামুলুক থেকে তিনি হবেন প্রধানমন্ত্রী। তাঁর আশা পূরণ হয়নি; উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের নেতারা পাকিস্তান রাষ্ট্রের মালিকানা বগলদাবা করলেন। বাংলাকে তাঁরা পেয়েছিলেন মুফতে(ফার্সি শব্দ, যার অর্থ বিনামূল্যে বা মাগনায়)

সোহরাওয়ার্দীকে এক বছর ঢাকায় আসতে দেওয়া হলো না। তাঁর অনুগত তরুণেরা মুসলিম লীগের ভেতরে কলকে পেলেন না। ঢাকার ১৫০ নম্বর মোগলটুলীতে তাঁরা গড়ে তুললেন মুসলিম লীগ কর্মিশিবির। লক্ষ্য হলো মুসলিম লীগের গণতন্ত্রায়ণ। তরুণ তুর্কিদের সামনের কাতারে ছিলেন শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান, ইয়ার মোহাম্মদ খান, আলী আমজাদ খান, আজিজ আহমদ, শওকত আলী, খন্দকার মোশতাক আহমদ প্রমুখ। ওই সময় আসাম মুসলিম লীগের নেতা মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী হাজির হলেন দৃশ্যপটে। তাঁকে সামনে রেখে মুসলিম লীগের বিদ্রোহী তরুণেরা এককাট্টা হলেন। মাওলানা ভাসানী ঢাকায় মুসলিম লীগের একটি কর্মী সম্মেলন ডাকলেন। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন বিকেল তিনটায় ঢাকার কে এম দাস লেনের ‘রোজ গার্ডেনে’ সম্মেলন শুরু হলো। উপস্থিত ২৫০ থেকে ৩০০ জন। আতাউর রহমান খানের সভাপতিত্বে শুরু হলো সম্মেলন। তাঁরা আলাপ-আলোচনা করে তৈরি করলেন পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম বিরোধী দল ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’। নামকরণ করলেন ভাসানী স্বয়ং। তাঁদের যুক্তি ছিল, তাঁরা সবাই মুসলিম লীগার। তবে আকরাম খাঁ-নুরুল আমীনদের মুসলিম লীগ হলো সরকারি মুসলিম লীগ, তাঁদেরটা হবে আওয়ামের অর্থাৎ জনগণের মুসলিম লীগ। তাঁদের লক্ষ্য হলো, ‘স্বার্থান্বেষী মুষ্টিমেয় লোকদের পকেট হইতে বাহির করিয়া সত্যিকার জনগণের মুসলিম লীগ গড়ে তোলা।’

মাওলানা ভাসানীকে সভাপতি, শামসুল হককে সাধারণ সম্পাদক এবং ইয়ার মোহাম্মদ খানকে কোষাধ্যক্ষ করে নতুন দলের ৪০ সদস্যের কার্যনির্বাহী কমিটি তৈরি করা হয়। তরুণ সংগঠকদের অন্যতম শেখ মুজিবুর রহমান তখন কারাগারে। ভাসানীর আগ্রহ ও ইচ্ছায় তাঁকে দলের যুগ্ম সম্পাদক বানানো হয়। এই গুরুত্বপূর্ণ পদ তৈরি হয়েছিল শেখ মুজিবের কথা মনে রেখেই। ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারির শেষে জেল থেকে বেরিয়ে শেখ মুজিব ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হন এবং ১৯৫৩ সালে অনুষ্ঠিত দলের কাউন্সিল অধিবেশনে পুরোদস্তুর সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। যুগ্ম সম্পাদক পদটি বিলুপ্ত হয়। শেখ মুজিব মাঠে-ঘাটে-হাটে ঘুরে ঘুরে সংগঠনটির বিস্তৃতি ঘটান। একটানা ১৩ বছর দলের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে থেকে তিনি দলটিকে দেশের সবচেয়ে বড় ও জনসম্পৃক্ত রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে পরিচিত করাতে পেরেছিলেন। আজ এই দলের ৭০তম জন্মদিবস।

এ অঞ্চলে অনেক রাজনৈতিক দল তৈরি হয়েছে। পুরোনো দলগুলোর মধ্যে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস এখনো টিকে আছে। তবে তার ক্ষয়িষ্ণু অবস্থা। মুসলিম লীগ এ দেশে একটি সাইনবোর্ড মাত্র। কমিউনিস্ট পার্টি তো ভেঙেচুরে ছত্রখান। আওয়ামী লীগ এখনো প্রবল প্রতাপে টিকে আছে। দলের গা থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি ফেলে দিয়ে তাকে সর্বজনীন প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল ১৯৫৫ সালের ২৩ অক্টোবর। দলটি এখনো ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জন্য ভরসার জায়গা।

৭০ বছরে দেশ অনেক বদলেছে। আওয়ামী লীগের মধ্যেও পরিবর্তন এসেছে। মাওলানা ভাসানী প্রথমদিকে দলের সভাপতি থাকলেও দল চলেছিল সোহরাওয়ার্দীর ভাবাদর্শে। তিনিই ছিলেন রাজনৈতিক গুরু। ১৯৬৩ সালের ডিসেম্বরে তাঁর মৃত্যুর পর দলটির নিয়ন্ত্রণ চলে যায় তাঁর ভাবশিষ্য শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে। সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই শেখ মুজিবের মনোজগৎ থেকে পাকিস্তান উবে যায়। ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের ফর্মুলা হিসেবে ছয় দফা ঘোষণার পর থেকে আওয়ামী লীগের মনস্তত্ত্বে এসেছিল বিরাট পরিবর্তন। পাঁচ বছরের মাথায় এ দেশে পাকিস্তানের মৃত্যু ঘটে।

আওয়ামী লীগ বড় ধাক্কা খেল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট, যখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সপরিবার নিহত হলেন। ৩ নভেম্বর নিহত হলেন আরও কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতা। দলের অবস্থা হালবিহীন নৌকার মতো। ১৯৮১ সালের ১৭ মে দিল্লির নির্বাসিত জীবন থেকে ফিরে এলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। দলের সভাপতির দায়িত্ব নিলেন। দলটি টিকে গেল। ১৯৯৬ সালে তিনি দলকে রাষ্ট্রক্ষমতায় নিয়ে গেলেন। ১৯৮১ থেকে ১৯৯৬—এই ১৫ বছর লেগেছে তাঁর দলের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে।

আওয়ামী লীগ তিনটি যুগের মধ্য দিয়ে গেছে বা যাচ্ছে। ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত ছিল সোহরাওয়ার্দীর আওয়ামী লীগ। ১৯৬৪ সাল থেকে শুরু হয়েছিল শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগ। দলের খোলনলচে পাল্টে গিয়েছিল। সোহরাওয়ার্দীর আমলের যৌথ নেতৃত্বের অবসান ঘটিয়ে শুরু হয়েছিল এককেন্দ্রিক নেতৃত্ব। শেখ মুজিব যত দিন দলের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন, দল চালিয়েছেন তিনিই। ১৯৬৬ সালে তিনি দলের সভাপতি হলে দল পরিণত হয় সভাপতিকেন্দ্রিক সংগঠনে। সেই ধারা অব্যাহত আছে আজও। সাধারণ সম্পাদক এখন শুধুই একজন ‘হেড ক্লার্ক’।

৬৯ বছরের জীবনে আওয়ামী লীগ ১৯৫৬-৫৮ সালে প্রথমবারের মতো কিছুদিন সরকার চালিয়েছিল। স্বাধীন বাংলাদেশে দলটি ক্ষমতায় থেকেছে সাকল্যে সাড়ে ১৮ বছর, বিরোধী শিবিরেই গেছে সাড়ে ২৮ বছর। আওয়ামী লীগ সরকারি দল হিসেবে বেশি সফল, না বিরোধী দল হিসেবে বেশি কার্যকর, এ নিয়ে তাত্ত্বিক আলোচনা হতে পারে।

১৯৫০ ও ৬০-এর দশকে যাঁরা আওয়ামী লীগকে তৈরি ও বিস্তৃত করেছিলেন, তাঁরা রাষ্ট্রের আনুকূল্য পাননি। পেয়েছিলেন বৈরী পরিবেশ। এখন অবস্থা পাল্টেছে। দল চলছে এখন রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়। যাঁরা দল চালাচ্ছেন, তাঁরা দলটি তৈরি করেননি। এটি তাঁরা পেয়েছেন উত্তরাধিকার সূত্রে। সোহরাওয়ার্দী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের মধ্যে পার্থক্য তো আছেই। সোহরাওয়ার্দীর ‘ভুলগুলো’ বঙ্গবন্ধু করেননি। বঙ্গবন্ধুর ‘ভুল’ থেকে শিখেছেন শেখ হাসিনা। রাষ্ট্র ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ ক্রমাগত ঋদ্ধ হয়েছে, টেকসই হয়েছে।

বিশ্ব পরিমণ্ডলে আমরা এখনো অনেক পেছনের কাতারে। অভাব আছে, আছে দারিদ্র্য। প্রযুক্তির কল্যাণে আমরা পশ্চিমের সব খবর চটজলদি পেয়ে যাই। কিন্তু পশ্চিমের ‘নাগরিক মন’ এ দেশে এখনো তৈরি হয়নি। ‘গণতন্ত্র’ শব্দটি এখনো বেশ মুখরোচক। সবাই গণতন্ত্র চাই, কিন্তু গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি তো স্লোগান দিয়ে কিংবা মেনিফেস্টোতে লিখে অর্জন করার বিষয় নয়। এটি সংস্কৃতির বিষয়, চর্চার বিষয়। নিছক বিশ্বাসের মন্ত্র তো নয়।

এই প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিক যুগেও আমাদের মন সামন্ততান্ত্রিক আবহ থেকে অবমুক্ত হয়নি। ফলে খুব সহজেই কর্তৃত্ববাদী রাজনীতি জেঁকে বসে। এ ধরনের রাজনীতির মূল বৈশিষ্ট্য হলো ব্যক্তি, পরিবার বা গোষ্ঠীর আধিপত্য, প্রতিপক্ষের ওপর চড়াও হওয়া এবং বাগাড়ম্বর। ১৯৪৭ সালে মুসলিম লীগ ঘোষণা দিয়েছিল, তারা পাকিস্তান হাসিল করেছে, সুতরাং তারাই দেশের মালিক। আওয়ামী লীগ জন্ম নেওয়ার পরদিন অর্থাৎ ২৪ জুন ১৯৪৯ ঢাকার আরমানিটোলা ময়দানে জনসভার ঘোষণা দিয়েছিল। মুসলিম লীগের ভাড়াটে গুন্ডারা হামলা চালিয়ে সভা পণ্ড করে দিতে চেয়েছিল। আমরা এখনো ওই ধরনের অপরাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারিনি। পাকিস্তানের জিন্নাহ-লিয়াকত আলী চক্র থেকে শুরু করে তাবৎ নেতা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের চরিত্র হনন করেছে, বিদেশের দালাল বলেছে, দেশপ্রেম নিয়ে কটাক্ষ করেছে। এখনো বজায় আছে এই চালচিত্র। এই মধ্যযুগীয় পাকিস্তানপন্থী প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসাটাই এ দেশের রাজনীতির জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। চ্যালেঞ্জ আওয়ামী লীগের জন্যও। চ্যালেঞ্জ হলো, একটি আধুনিক রাষ্ট্রের উপযোগী আধুনিক দল হয়ে ওঠা।

Add a Comment