গণমাধ্যমের স্বাধীনতা(মতামত)

ভীতির পরিবেশ ও আইনের খড়্গ বন্ধ হোক

গণমাধ্যমের স্বাধীনতা

প্রথম আলো-28 April, 2018

গণমাধ্যমের স্বাধীনতাবিষয়ক আন্তর্জাতিক সূচক ‘ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্স’-এ বাংলাদেশের অবস্থান গতবারের মতো ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৪৬তম।
সূচকের তালিকার শীর্ষে আছে নরওয়ে। প্যারিসভিত্তিক সংস্থা রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস বা রিপোর্টার্স স্যানস ফ্রন্টিয়ার্সের (আরএসএফ) সূচকে দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সবচেয়ে নিচে। ভুটান, নেপাল, আফগানিস্তান, শ্রীলঙ্কা, ভারত, পাকিস্তানের সূচক যথাক্রমে ৯৪, ১০৬, ১১৮, ১৩১, ১৩৮ ও ১৩৯।

আরও উদ্বেগের বিষয়, যেদিন সূচকটি প্রকাশ করে, সেদিনই তথ্যপ্রযুক্তি আইনের বিতর্কিত ৫৭ ধারায় আটক হন অন্যতম তথ্যপ্রযুক্তি উদ্যোক্তা ও বিডি জবসের প্রধান নির্বাহী কে এম ফাহিম মাসরুর। তিন ঘণ্টা পর অবশ্য তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়। গণমাধ্যমের অংশীজনেরা শুরু থেকে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের এই ধারাটি বাতিলের দাবি জানালেও সরকার এখন পর্যন্ত কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। একাধিক মন্ত্রী আশ্বস্ত করেছিলেন, ৫৭ ধারা বাতিল করা হবে এবং যত দিন বাতিল না হচ্ছে, উপযুক্ত তথ্য-প্রমাণ ছাড়া কারও বিরুদ্ধে সেটি প্রয়োগ করা হবে না। কিন্তু সংশ্লিষ্ট ধারায় মামলা-গ্রেপ্তার ও হয়রানি চলছেই। ফাহিমের নামে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর ছবি বিকৃত করার অভিযোগ আনা হয়েছে, সেটিও পুলিশের প্রাথমিক তদন্তে প্রমাণিত হয়নি।

উল্লেখ্য, তথ্যপ্রযুক্তি আইন থেকে ৫৭ ধারা বাতিল করার আগেই জাতীয় সংসদে উত্থাপিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গুপ্তচরবৃত্তির দায়ে সাংবাদিকদের বিচারসহ বেশ কিছু গুরুতর ক্ষতিকর ধারা সংযোজন করা হয়েছে। সম্পাদক পরিষদ, সংবাদপত্র মালিকদের সংগঠন নোয়াব, সাংবাদিক ইউনিয়নসহ বিভিন্ন মহল আইনটির তীব্র বিরোধিতা করেছে। তা সত্ত্বেও এটি মন্ত্রিসভার অনুমোদন পেয়ে এখন জাতীয় সংসদে পাসের অপেক্ষায় আছে। সংশোধনী ছাড়া আইনটি পাস হলে সাংবাদিকতা করাই অসম্ভব হয়ে পড়বে।

আরএসএফের পর্যবেক্ষণে বিশ্বব্যাপী গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সংকুচিত হওয়ার কথা বলা হয়েছে। যে দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট জেফারসন গর্ব করে বলেছিলেন, ‘সংবাদপত্রহীন সরকারের চেয়ে তিনি সরকারহীন সংবাদপত্রই’ বেছে নেবেন, সেই যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও নানাভাবে গণমাধ্যমের ওপর কাঁচি চালানোর চেষ্টা করছেন। চীন, রাশিয়াসহ আরও অনেক ক্ষমতাধর দেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খুবই ভঙ্গুর।

তবে আমরা মনে করি, এসব উদাহরণ গণতন্ত্রের প্রত্যয় নিয়ে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব হওয়ার অজুহাত হতে পারে না। গণমাধ্যমের উন্নয়নের বিষয়টি গণতন্ত্র, রাজনীতি, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান ইত্যাদির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। জনগণের কাছে দায় আছে এমন কোনো সরকারই গণমাধ্যমের ওপর খড়্গহস্ত হতে পারে না, যদিও আমাদের পূর্বাপর সরকারগুলো সেই কাজটিই আইনি-বেআইনি উপায়ে করে যাচ্ছে।

আরএসএফের রিপোর্টে বাংলাদেশে গণমাধ্যমের ওপর আইনি বাধা ছাড়াও যাঁরা গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান ও কর্মীদের ওপর সহিংস আক্রমণ করেছেন, রাজনৈতিক প্রভাবে তাঁদের দায়মুক্তির বিষয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। এর ফলে গণমাধ্যমগুলোর মধ্যে ‘সেলফ-সেন্সরশিপ’ বেড়েছে। ২০১৭ সালে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের আওতায় কমপক্ষে ২৫ জন সাংবাদিক এবং কয়েক শ ব্লগার ও ফেসবুক ব্যবহারকারী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।

এ অবস্থায় আমরা তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারাসহ গণমাধ্যমের স্বাধীনতার পরিপন্থী সব আইন ও ধারা বাতিলের দাবি জানাচ্ছি। সরকারকে মনে রাখতে হবে, কেবল গণমাধ্যমের সংখ্যা বাড়াই স্বাধীনতা নয়, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হলে গণমাধ্যমের ওপর যে আইনি খড়্গ ও ভীতির পরিবেশ আছে, সেটি দূর করতেই হবে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করে কোনো দেশ উন্নয়নের রোল মডেল হতে পারে না।


👉 Read More...👇

Add a Comment