মুদ্রানীতি কী?

কাকে বলে মুদ্রানীতি
বাংলা ট্রিবিউন, জানুয়ারি ২৯, ২০১৮
গোলাম মওলা


মুদ্রানীতি কাকে বলে? What is monetary policy?
প্রতি বছর দুইবার মুদ্রানীতি ঘোষণা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। একবার বছরের শুরুতে অর্থাৎ জানুয়ারিতে। আরেকবার মুদ্রানীতি ঘোষণা হয় বছরের মাঝামাঝিতে অর্থাৎ জুলাইতে। মুদ্রানীতি অনেক পুরনো বিষয় হলেও অনেকেরই প্রশ্ন মুদ্রানীতির মাধ্যমে আসলে কী হয়। মুদ্রানীতির কাজটাই বা কী! এর উত্তরে বলা যায়, মুদ্রানীতি দেশের দারিদ্র্য বিমোচন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়াতে বড় ভূমিকা রাখে। তবে, মুদ্রানীতির আরেকটা কাজ হলো দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষা করা। মূলত বাংলাদেশ ব্যাংক পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে খোলাবাজার কার্যক্রম, সংবিধিবদ্ধ জমার অনুপাত পরিবর্তনসহ ব্যাংক হার পরিবর্তনের মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মতে, সাধারণত মুদ্রার গতিবিধি প্রক্ষেপণ করে মুদ্রানীতি। মুদ্রানীতির অন্যতম কাজগুলো হলো মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কাজ করা, ঋণের প্রক্ষেপণের মাধ্যমে সরকারি-বেসরকারি ঋণের যোগান ধার্য করা এবং মুদ্রার প্রচলন নিয়ন্ত্রণ করা। বাংলাদেশ ব্যাংক বৈশ্বিক, অভ্যন্তরীণ এবং সামষ্টিক অর্থনীতিকে বিবেচনায় রেখেই মুদ্রানীতি প্রণয়ন করে, যা মূলত পরবর্তী কয়েকটি মাসের জন্য কার্যকর থাকে।

প্রশ্ন আছে, মুদ্রানীতি সাধারণ মানুষের কী উপকারে আসে। উত্তরে বলা যায়, সাধারণ ভোগ্যপণ্যের দামস্তর বিশেষ করে খাদ্যদ্রব্যের ঊর্ধ্বগতিকে গুরুত্ব দিয়ে মুদ্রানীতি প্রণয়ন করা হয়। আগামী ছয় মাস বা একবছর দেশের জনসাধারণ ভালো থাকবে, নাকি খারাপ থাকবে তার একটা রূপরেখা থাকে মুদ্রানীতিতে। মুদ্রানীতির ‘টুল’ বা যন্ত্র দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুদ্রা সরবরাহ (মানি সাপ্লাই) নিয়ন্ত্রণ করে। এর ফলে আগামী দিনগুলোতে জিনিসপত্রের দাম কম থাকবে, নাকি জিনিসপত্রের দাম বাড়বে অথবা আগামী ছয় মাস বা একবছর সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়বে নাকি ব্যয় কমবে, দেশে বেকারের সংখ্যা বাড়বে, নাকি চাকরির সুযোগ তথা কর্মসংস্থান বাড়বে , দেশে দারিদ্র্য বিমোচনের গতি বাড়বে নাকি কমবে তার একটা রূপরেখা থাকে মুদ্রানীতিতে ।

এ প্রসঙ্গে রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক ড. জায়েদ বখত বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, মুদ্রানীতির মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করার পাশাপাশি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য বেসরকারি খাতে কতটুকু ঋণ বিতরণ করা হবে তা মুদ্রানীতির মাধ্যমে নির্ধারণ করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। আবার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য মুদ্রা সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করা হয়। তিনি বলেন, প্রবৃদ্ধি বাড়লে সাধারণ মানুষের আয় রোজগার বাড়বে। অন্যদিকে মূল্যস্ফীতি যদি বেশি হয়, তাহলে সাধারণ মানুষের প্রকৃত ব্যয় বেড়ে যাবে।

অর্থনীতি ভাষায়, মুদ্রানীতির মূল লক্ষ্য দুটি। তা হলো মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং জিডিপির প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করা বা এগিয়ে নিতে সহায়তা করা। বাজারে অতিরিক্ত মুদ্রার সরবরাহ বেড়ে গেলে মুদ্রাস্ফীতি হয়। এতে মুদ্রার মান কমে যায় এবং মুদ্রা দুর্বল হয়ে পড়ে।

তবে সব সময় মুদ্রানীতি ঠিকমতো কাজ করে এমনটি নয়, অনেক সময় হিতে বিপরীতও হয়। জিডিপির প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করতে বিনিয়োগের উচ্চ প্রবৃদ্ধি প্রয়োজন, যার জন্য ব্যাপক মুদ্রা (এম২) সরবরাহ বাড়াতে হয়। এতে ব্যক্তিখাতের ঋণপ্রবাহ বৃদ্ধি পায়−যা বিনিয়োগকে ত্বরান্বিত করে। অন্যদিকে মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধির ফলে মূল্যস্ফীতি বাড়তে থাকে। অর্থনীতির তত্ত্ব (যেমন কোয়ান্টিটি থিওরি অব মানি) অনুসারে মূল্যস্ফীতির মূল কারণ হচ্ছে মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধি।

সাধারণ মানুষের পকেটে বা মানিব্যাগে বা ঘরে যে টাকা বা আছে তাই (কারেন্সি ইন সার্কুলেশন) ‘মুদ্রা’। এই হাতের টাকা দিয়ে দৈনদিন খরচ ও লেনদেন চলে। এর বাইরে আরও ‘মুদ্রা’ জমা আছে ব্যাংকে। যাকে ব্যাংকাররা বলেন ‘ডিপোজিট’ বা আমানত। এটাও মুদ্রা। আমানত অনেক ধরনের। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এগুলোকে মোটা দাগে দুইভাগে ভাগ করে। একটার নাম ‘ডিমান্ড ডিপোজিট’, যা চাহিবামাত্র গ্রাহকরা পায়। আরেকটা নাম হলো ‘টাইম ডিপোজিট’ যা যখন-তখন তোলা যায় না। ডিমান্ড ও টাইম ডিপোজিটও মুদ্রা বা মানি।

বাংলাদেশ ব্যাংক মুদ্রানীতির বেশ কয়েকটি ‘টুল’ বা যন্ত্র দিয়ে মুদ্রা সরবরাহ (মানি সাপ্লাই) নিয়ন্ত্রণ করে, যার ওপর নির্ভর করে ‘মূল্যস্ফীতি’ (ইনফ্লেশন)। এই ‘ইনফ্লেশন’ই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান লক্ষ্যবস্তু। কারণ, মূল্যস্ফীতি সাধারণ মানুষের শত্রু, জিনিসপত্রের দাম বাড়ায়, মানুষের জীবন যাত্রার ব্যয় বাড়ায়। যা অর্থনীতির শত্রু হিসাবে পরিগণিত।

অবশ্য জিডিপির প্রবৃদ্ধিকে বাড়াতে মূল্যস্ফীতি মেনে নিয়েও অনেক সময় নীতি গ্রহণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির মাত্রা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মূল্যস্ফীতিও বাড়তে থাকে, তবে তা একটা পর্যায়ে গিয়ে কমতে থাকে। কারণ, অর্থনীতি তখন উন্নয়নের এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে যায়, যে পর্যায়ে তা মূল্যস্ফীতিকে ধারণ করতে সক্ষম হয়। মুদ্রা সরবরাহ বাড়ার ফলে তা উৎপাদনশীল খাতে সরাসরি উপকারে লাগে। আবার কর্মসংস্থান বাড়ে। এছাড়া উৎপাদন হওয়া পণ্য বাজারের চাহিদা মেটাতে পারলে জিনিসপত্রের দাম কমতে থাকে। ফলে মূল্যস্ফীতি আর বাড়ে না। তবে, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের অর্থনীতির ক্ষেত্রে এই তত্ত্বটা কাজে লাগে না বললেই চলে।

অনেকে মনে করে থাকেন, বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি বেশি হলেই ‘জিডিপি’ প্রবৃদ্ধি বেশি হবে। এ কথার কোনও সঠিক ভিত্তি নেই। কারণ, গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল ১৪ শতাংশের ঘরে। অথচ এই অর্থবছরে দেশে জিডিপির প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ। আবার ২০১০-১১ অর্থবছরে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের হার ছিল ২৫ দশমিক ৮ শতাংশ, অথচ জিডিপি সে বছর বৃদ্ধি পায় মাত্র সাড়ে ছয় শতাংশ হারে। এ জন্য মুদ্রানীতির পাশাপাশি সরকারের রাজস্বনীতি (ফিসক্যাল পলিসি) ও বাণিজ্যনীতি (ট্রেড-ইমপোর্ট ও এক্সপোর্ট পলিসি) একই উদ্দেশ্যে কাজ না করলে বিশেষ করে ঋণের টাকার সদ্ব্যবহার না হলে ফল লাভ করা যায় না।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক সাধারণত রেপো ও রিভার্স রেপো রেটের মাধ্যমে মার্কেটে সুদের হার কেমন হওয়া উচিত, তার একটি সংকেতও পাঠিয়ে থাকে। অবশ্য বেশ কিছুদিন ধরে রেপো বা রিভার্স রেপোতে কোনও পরিবর্তন করা হচ্ছে না। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকের এ দুটি হাতিয়ার অকার্যকর রয়েছে।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, শুধু মুদ্রানীতি দিয়ে কাজ হবে না। এর সঙ্গে বিদ্যুৎ গ্যাস ও অবকাঠামোগত সুবিধা বাড়তে হবে।

এ প্রসঙ্গে রফতানিকারকদের সংগঠন এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইএবি) সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, মুদ্রানীতির মাধ্যমে ঋণের ব্যবস্থা হলেও বিদ্যুৎ, গ্যাস, অবকাঠামোগত সুবিধা যখন থাকে না তখন মুদ্রানীতির উদ্দেশ্য সফল হয় না। তিনি বলেন, এখনও বিদ্যুৎ, গ্যাস, অবকাঠামোগত সমস্যা রয়েছেই। এসব সমস্যার সমাধান না করে শুধু ঋণের ব্যবস্থা করে বিনিয়োগও বাড়ানো যাবে না।

The End

বর্তমান মুদ্রানীতি
২০১৮-১৯ সালের প্রথমার্ধের(জুন-ডিসেম্বর) মুদ্রানীতে –
মূল্যস্ফিতি ধরা হয় ৬%, আগের মুদ্রানীতিতে ছিল ৫.৫%
জিডিপি ধরা হয় ৭.৮%
বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহের প্রবৃদ্ধি ধরা হয় ১৬.৮%, এর আগের মুদ্রানীতিতে ধরা হয়েছিল ১৬.৫

Add a Comment