কমনওয়েলথ

আমরা জানি, একসময় প্রায় সারা বিশ্বে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বিস্তৃত ছিল। আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশও সে সময় ব্রিটিশ শাসনের অধীন ছিল। ব্রিটিশরা সে সময় দোর্দণ্ড প্রতাপে প্রায় সমগ্র পৃথিবীতে রাজত্ব করেছে। কিন্তু পরবর্তীতে শাসিত অঞ্চলগুলোতে জাতীয়তাবাদী চেতনার সৃষ্টি হয় এবং সেসব অঞ্চল বা দেশ একের পর এক স্বাধীন হতে থাকে।

তখন ব্রিটেন ও এর শাসন থেকে মুক্ত রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সম্পর্কের বন্ধন ধরে রাখার উদ্দেশ্যে গড়ে উঠে কমনওয়েলথ। ব্রিটেন এটি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়। ব্রিটেন ও এর পূর্বতন অধীনস্ত দেশসমূহ এর সদস্য। তবে কোনো রাষ্ট্র ইচ্ছে করলে কমনওয়েলথের সদস্য নাও হতে পারে। এর বর্তমান সদস্য সংখ্যা ৫৩

কমনওয়েলথ একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা। ১৯৪৯ সালে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। পূর্বে এর নাম ছিল ‘ব্রিটিশ কমনওয়েলথ অব নেশনস’। পরবর্তীতে ‘ব্রিটিশ’ কথাটি বাদ দেওয়া হয়। ব্রিটেনের রাজা বা রানি কমনওয়েলথের প্রধান। এর কার্যক্রম পরিচালনার জন্য নিজস্ব সচিবালয় আছে। সচিবালয়ের প্রধানকে বলা হয় ‘মহাসচিব’। এর সদর দপ্তর লন্ডনে অবস্থিত, Marlborough House। প্রতি দুই বছর পর পর সদস্যভুক্ত দেশগুলোর সরকারপ্রধানদের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।

লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য
কমনওয়েলথের প্রধান লক্ষ্য হলো ব্রিটেন ও এর স্বাধীন উপনিবেশগুলোর মধ্যে ন্যূনতম সম্পর্ক রক্ষা। এই সম্পর্ক ধরে রাখার মাধ্যমে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক উন্নয়ন এবং দেশগুলোর পরস্পরের মধ্যে শিক্ষা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির আদান-প্রদানে সহায়তা করার মাধ্যমে দেশগুলোর অগ্রগতি সাধন করাই হচ্ছে এর উদ্দেশ্য।

বাংলাদেশ ও কমনওয়েলথ

স্বাধীনতা লাভের পরপরই ১৯৭২ সালের ২৮ এপ্রিল বাংলাদেশ কমনওয়েলথের সদস্যপদ লাভ করে। বাংলাদেশ সৃষ্টির শুরু থেকেই কমনওেয়লথের সাথে বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয়। বিশেষ করে, কমনওয়েলথের মূল উদ্যোক্তা যুক্তরাজ্যের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক খুবই ঘনিষ্ঠ। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় ব্রিটেনের প্রচারমাধ্যমগুলো বিভিন্নভাবে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত সৃষ্টি করেছিল। বৃটেন ছিল বহির্বিশ্বে মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে প্রচারকার্য পরিচালনা করার প্রধান কেন্দ্র। সেখানে গঠন করা হয়েছিল বাংলাদেশের জন্য সাহায্য তহবিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় কমনওয়েলথভুক্ত অন্যান্য দেশও বিভিন্নভাবে বাংলাদেশকে সাহায্য-সহযোগিতা করেছিল।
কমনওয়েলথভুক্ত আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত বাংলাদেশের প্রায় এক কোটি লোককে আশ্রয় ও খাদ্য দিয়েছে। অন্যান্য সদস্য রাষ্ট্র ঔষধ, খাদ্য, বস্ত্র ইত্যাদি দিয়ে বাংলাদেশকে সাহায্য করেছে। বাংলাদেশের প্রতি উদার মনোভাব ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের কারণে স্বাধীনতার পর পর বাংলাদেশ কমনওয়েলথের সদস্যপদ পায়। এর প্রতিবাদে পাকিস্তান কমনওয়েলথ থেকে সদস্যপদ প্রত্যাহার করে নেয়। কমনওয়েলথ ও এর সদস্য দেশগুলোর সহায়তায় বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি দ্রুত কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়। বাংলাদেশ কমনওয়েলথের একনিষ্ঠ সদস্য হিসেবে এর প্রতিটি সম্মেলনে অংশগ্রহণ করে। কমনওয়েলথের নীতি ও কার্যক্রম বাস্তবায়নে আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করে। কমনওয়েলথের সদস্য হিসেবে বাংলাদেশ কলম্বো পরিকল্পনার সদস্য। এর ফলে বাংলাদেশের অনেক শিক্ষার্থী কমনওয়েলথ বৃত্তি নিয়ে কমনওয়েলথভুক্ত বিভিন্ন দেশে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পায়।

কমনওয়েলথ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম আন্তর্জাতিক সংগঠন। একটি অরাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে এটি বিশ্বে শান্তি ও সমৃদ্ধি রক্ষায় প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোর কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও প্রযুক্তির উন্নয়ন এবং বিশ্ব থেকে বর্ণবৈষম্য ও ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য দূরীকরণে কাজ করছে।

সম্মেলন-২০১৮ঃ ২০১৮ সালে লন্ডনে অনুষ্ঠিত হয় কমনওয়েলথ শীর্ষ সম্মেলন। ২০২০ সালে রুয়ান্ডায় পরবর্তী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। লন্ডনে সদ্য শেষ হওয়া ৫৩ জাতি জোটের শীর্ষ সম্মেলনে এসব দেশের রাষ্ট্রনেতারা আমাদের অভিন্ন সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ গড়ার লক্ষ্যে কমনওয়েলথে নতুন প্রাণসঞ্চারের ঘোষণা দিয়েছেন। তাঁদের ঘোষিত ৫৪ দফার ইশতেহারে গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও মানবাধিকারের সুরক্ষা, অবাধ বাণিজ্যের প্রসার, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা, সাগর দূষণমুক্ত করা, সবার জন্য অন্তত বারো বছরের মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করা, ম্যালেরিয়া এবং অসংক্রামক রোগের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মতো অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বেশ উচ্চাকাঙ্ক্ষী অঙ্গীকার রয়েছে।

Add a Comment