পাকিস্তানকে শায়েস্তা করতে হবে****

প্রথম আলো, ৩১ জানুয়ারি ২০১৮
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন।
ব্রহ্ম চেলানি: নয়াদিল্লিভিত্তিক সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের অধ্যাপক।


সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যে পাকিস্তানকে ২০০ কোটি ডলার নিরাপত্তা সহযোগিতা দেওয়ার সিদ্ধান্ত স্থগিত করলেন, তা ঠিকই আছে। কারণ, দেশটি আন্তদেশীয় সন্ত্রাসীদের নির্মূল করতে চায়নি। কিন্তু এটাই যথেষ্ট নয়, ট্রাম্পকে আরও পদক্ষেপ নিতে হবে।
পাকিস্তানকে চাপে রাখার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের নানাবিধ কারণ আছে। এই দেশ এত দিন ভান করেছে যে তারা যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র, অথচ তারা প্রতিবেশী আফগানিস্তানে সন্ত্রাসীদের সহযোগিতা দিয়েছে, যারা মার্কিন সেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ও তাদের কতল করেছে। বস্তুত, আফগানিস্তান যে আজ ব্যর্থ রাষ্ট্র হতে যাচ্ছে, তার আংশিক কারণ হচ্ছে পাকিস্তানের এই সহায়তা; যার কারণে যুক্তরাষ্ট্র ইতিহাসের দীর্ঘতম যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের আফগানিস্তানে আক্রমণের ১৬ বছর পেরিয়ে গেছে। অথচ দেশটির রাজধানী কাবুল এখন ঘেরাও হয়ে আছে, কাবুলের ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে সন্ত্রাসীদের হামলার মধ্য দিয়ে এটি বোঝা যায়। শহরের কেন্দ্রে অবস্থিত এই হোটেলে বিস্ফোরকে ভর্তি এক অ্যাম্বুলেন্স ঢুকে গেলে এমনটি হয়। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র আফগান তালেবানদের অগ্রযাত্রা ঠেকাতে বড় ধরনের বিমান আক্রমণ চালিয়েছে। গত আগস্ট মাস থেকে যুক্তরাষ্ট্র সেখানে যত বিমান হামলা চালিয়েছ, ২০১৫ ও ২০১৬ সাল-এ দুই বছরেও তারা এত হামলা চালায়নি।

এই বিমান হামলা ও ট্রাম্প প্রশাসনের অতিরিক্ত তিন হাজার সেনা মোতায়েন সত্ত্বেও আফগানিস্তানের ক্রমাবনতিশীল পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটানো যায়নি। সেটা অর্জন করতে গেলে পাকিস্তানকে তাদের সীমান্তের উভয় পারে অভয়ারণ্য ভেঙে দিতে হবে, তালেবান ও তার সহযোগী হাক্কানি নেটওয়ার্ক যা ব্যবহার করে থাকে। আফগানিস্তানে মার্কিন সামরিক কমান্ডার জেনারেল জন নিকোলসন স্বীকার করেছেন, ‘যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রু বিদেশি সহায়তা ও নিরাপদ আশ্রয় পেলে সফল হওয়া খুব কঠিন।’

এখন সমস্যাটা হলো, পাকিস্তানের শক্তিশালী সামরিক বাহিনীর জেনারেলরা পাকিস্তানের মাটিতে সন্ত্রাসীদের রক্ষা ও প্রশ্রয় দিতে অঙ্গীকারবদ্ধ। শুধু যেসব সন্ত্রাসী পাকিস্তানের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়, তারাই আইএসআইয়ের লক্ষ্যবস্তু হয়। কিন্তু পাকিস্তানি জেনারেলদের নিজ সেনাদের হত্যার জন্য কাঠগড়ায় দাঁড় না করিয়ে যুক্তরাষ্ট্র তাদের এত বিপুল অঙ্কের সহায়তা দিয়েছে যে দেশটি যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম বড় দানগ্রহীতায় পরিণত হয়েছে। এমনকি ওসামা বিন লাদেনকে ১০ বছর ধরে খোঁজার পর যখন তাঁকে পাকিস্তানের মূল সামরিক অ্যাকাডেমির পাশে পাওয়া গেল, তখনো তারা মুলা ঝোলানোর নীতিতে সে রকম বড় পরিবর্তন আনেনি। এতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পক্ষে আরও জেঁকে বসা সম্ভব হয়। দেশটির ভেতরে যে গণতান্ত্রিক উত্তরণের চেষ্টা চলছিল, তা দুর্বল হয়ে পড়ে।

অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে পাকিস্তানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ থেকে বিরত করায় পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে, অথচ পাকিস্তান-সমর্থিত সন্ত্রাসীদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে ভারত। বরং দেখা গেছে, বেশ কটি মার্কিন প্রশাসন ভারতকে পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিকভাবে ঝামেলা মেটাতে চাপ দিয়েছে। এমনকি ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও পাকিস্তানের উপদেষ্টাকে ব্যাংককসহ বিভিন্ন জায়গায় গোপন বৈঠকে মিলিত হতে তারা পরামর্শ দিয়েছে।

এই মনোভঙ্গির কারণে পাকিস্তানভিত্তিক সন্ত্রাসীদের পক্ষে মুম্বাই থেকে কাশ্মীর পর্যন্ত হামলা চালানো সম্ভব হয়েছে। অন্যদিকে হোয়াইট হাউসের নতুন জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলের কারণে এটা নিশ্চিত হয়েছে যে ‘পাকিস্তানের ভেতরে ক্রিয়াশীল আন্তদেশীয় সন্ত্রাসীরা যুক্তরাষ্ট্রের হুমকির কারণ হয়ে উঠেছে’। আমার এই উপসংহারে কিন্তু সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের কথার প্রতিধ্বনি রয়েছে। তিনি ২০০৯ সালে সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে পাকিস্তান ‘আমাদের দেশ ও পৃথিবীর নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক হুমকি’।

এরই পরিপ্রেক্ষিতে ট্রাম্প প্রশাসন যে স্বীকার করেছে পাকিস্তানে তাদের নীতি ব্যর্থ হয়েছে, তা ভালো খবর। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, শুধু নিরাপত্তা সহযোগিতা বন্ধ করে পাকিস্তানের অর্থপূর্ণ পরিবর্তন আনা যাবে না, যেখানে তারা দেশটিকে অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে যাচ্ছে।

এর বাইরে আরেকটি অতিরিক্ত পদক্ষেপ হিসেবে তারা যেটা করতে পারে, তা হলো পাকিস্তানকে সন্ত্রাসবাদের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া। যুক্তরাষ্ট্র যদি তা না-ও করে, তাহলে অন্তত ২০০৪ সালে দেশটিকে গুরুত্বপূর্ণ অ-ন্যাটো মিত্র হিসেবে যে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল, সেটা কেড়ে নেওয়া উচিত। এর মধ্য দিয়ে দেশটির অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মার্কিন অস্ত্র ও প্রযুক্তি পাওয়া বন্ধ হবে।

এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের সুনির্দিষ্ট নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা উচিত। এমনকি যেসব জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তা সন্ত্রাসীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখেন, তাঁদের সম্পদ ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে হবে। অনেক পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তার সন্তানেরা যেহেতু যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন, তাই তাঁদের পরিবারবর্গকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে বাধা দেওয়াও কাজের কিছু হয়।

শেষমেশ, যুক্তরাষ্ট্র যেহেতু পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় রপ্তানি বাজার, সেহেতু যুক্তরাষ্ট্রের এই সুযোগ নেওয়া উচিত, তাতে এই তারল্য ঘাটতির দেশকে অর্থনৈতিকভাবে টাইট দেওয়া যাবে। ২০১৩ সাল থেকে পাকিস্তান রিজার্ভ সংকট মেটাতে ১০ বছরের ডলার বন্ড ছেড়ে আসছে। এই ঘাটতি মেটাতে পাকিস্তান যা করছে, তাতে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে সুযোগ এসেছে, যা তার ব্যবহার করা উচিত।

একইভাবে পাকিস্তান আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের কাছ থেকে ৬৭০ কোটি ডলার নেওয়ার বিনিময়ে ৬৮টি রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত কোম্পানি বেসরকারি করতে রাজি হয়েছে। এখন যুক্তরাষ্ট্র যদি আর্থিক ও বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা বহুপক্ষীয় ঋণগ্রহণ প্রক্রিয়া পর্যন্ত টেনে নিয়ে যেতে পারে এবং সামরিক সরঞ্জামের সরবরাহ বন্ধ করতে পারে, তাহলে সেটা হবে পাকিস্তানকে দৌড়ের ওপর রাখার আরেকটি কার্যকর পন্থা।

এসব ঘটলে পাকিস্তান নিশ্চিতভাবে তার ভূমি ব্যবহার করে আফগানিস্তানে মার্কিন রসদ সরবরাহ বন্ধ করে দেবে। এতে মার্কিনদের রসদ সরবরাহের খরচ ৫০ শতাংশ বেড়ে যাবে। কিন্তু পাকিস্তান ২০১১ ও ২০১২ সালে শিখেছে, এমন কিছু করলে তার অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে, বিশেষ করে তার সেনাশাসিত ট্রাকশিল্প ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

এখন পাকিস্তানকে যদি দ্বৈত খেলা পরিহার করতে হয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রকে পাকিস্তানের ‘মিথ্যা ও প্রতারণার’ বিনিময়ে সুবিধা দেওয়া বন্ধ করতে হবে। তার চেয়ে বড় কথা হলো, পাকিস্তানের এই দ্বৈত নীতির জন্য যুক্তরাষ্ট্রের উচিত তাকে শাস্তি দেওয়া। যুক্তরাষ্ট্রের নীতিপ্রণেতাদের দ্রুত কাজ করতে হবে, তা না হলে পাকিস্তান সন্ত্রাসবাদের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষক থেকে সন্ত্রাসীদের পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত রাষ্ট্রে পরিণত হবে।

Add a Comment