চায়না-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডর

২০১১ সালে চীন তার প্রতিবেশী দেশ তাজিকিস্তানের মোট জমির এক শতাংশ ভূমি নিজেদের অধিকারে নিয়ে নেয় তবে এটি চীন বলপূর্বক বা সামরিক শক্তি ব্যবহার করে করেনি। তাজিকিস্তান চীন থেকে বহু বছর ধরে আর্থিক লোন নেয় কিন্তু শেষ পর্যন্ত লোনের টাকা পরিশোধ করতে না পেরে নিজেদের ভূমি চীনকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। শুধু তাজিকিস্তান ই নয়, ভারতের প্রতিবেশী শ্রীলঙ্কা চীন থেকে নেওয়া মাত্র ১.১বিলিয়ন মার্কিন ডলার লোন শোধ করতে না পেরে হামবারটোটা সমুদ্র বন্দরের ৮০% শেয়ার ৯৯ বছরের জন্য চীন কে লিজে দিতে বাধ্য হয়। ভারতের অপর প্রতিবেশী পাকিস্তান শুধুমাত্র চীনের থেকে স্বল্প সুদে লোন নেওয়ার জন্য তাদের করাচি বিমান বন্দর চীনের কাছে বন্ধক রেখেছে এবং জাতীয় সড়ক, দূরদর্শন ও জাতীয় বেতার কেন্দ্র চালানোর জন্য চীন থেকে গ্রহন করেছে মোটা লোন আবার শুধুমাত্র বিশ্বব্যাংকের পূর্ববতী লোন পরিশোধ করার জন্য চীন থেকে নিয়েছে প্রায় ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার লোন। এছাড়াও চায়না-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডরের জন্য চীন এখনো পর্যন্ত পাকিস্তানে বিনিয়োগ করেছে প্রায় ৫২বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
.
এখন প্রশ্ন হলো, পাকিস্তান কি চীনের এই বিপুল পরিমানের লোন চীন কে ভবিষ্যতে পরিশোধ করতে পারবে নাকি তার অবস্থাও শ্রীলংকা বা তাজিকিস্তানের মত হবে..?
.
এই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে, পাকিস্তানের অর্থনীতির দিকে একবার দৃষ্টি দেওয়া দরকার। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় ভারত ও পাকিস্তান দুই দেশ ই ছিল অত্যন্ত দারিদ্র দেশ। শুরু থেকেই দুইদেশ সোভিয়েত ইউনিয়নের অর্থব্যবস্থা কে রোল মডেল হিসাবে ব্যবহার করে। ভারতের আগেই পাকিস্তান তাদের পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রনয়ন করে কিন্তু পর্যাপ্ত বাজেটের অভাবে তা ব্যার্থ হয়। পাকিস্তানের তুলনায় ভারত বড় ও জনবহুল দেশ হওয়ায় উদ্বাস্তু সমস্যা ও দরিদ্রমুক্তি আরো বড় চ্যালেঞ্জ হিসাবে দেখা দেয়। দ্বিতীয় পঞ্চ বার্ষিকি পরিকল্পনায় পাকিস্তান অভাবনীয় সাফল্য পায় এমনকি দক্ষিন কোরিয়া পাকিস্তানের পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা নকল করে। ১৯৬০ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত পাকিস্তানের জিডিপি গড়ে ৬.৮০% করে অভাবনীয় সাফল্য দেখাতে থাকে এবং সাথে পশ্চিমা মিত্রদের সাহায্য দান তার অর্থনীতি কে আরো প্রসারিত করে। ভারতের অর্থনীতি বিপুল জনসংখ্যা ও দারিদ্রতা নিয়ে তখনো ধুঁকছে।
.
বর্তমানে পাকিস্তানের নমিন্যাল জিডিপি ২৮০বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং প্রায় এক দশক ধরে গ্রোথ ৫% এর নিচে। অপরদিকে ভারত বর্তমানে বিশ্বের সবথেকে দ্রুত উন্নয়নশীল রাস্ট্র। ২০১৪ থেকে ২০১৫ সালে ভারতের জিডিপি তে যুক্ত হয়েছে ২৮০বিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থাৎ প্রতি বছর ভারতের নমিন্যাল জিডিপি তে যুক্ত হচ্ছে একটি করে নতুন পাকিস্তান। ভারতের থেকে সব বিষয়ে পিছিয়ে থাকলেও দেশ টি শিক্ষা ও মানবিক উন্নয়নের থেকে প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে ব্যয় করছে সব থেকে বেশী। জিডিপির প্রায় ২.৩% ব্যয় করছে প্রতিরক্ষা খাতে যেখানে ভারত ব্যয় করে মাত্র ১.৬২% অর্থ।
.
জঙ্গিবাদের ধ্বংসপ্রাপ্ত পাকিস্তান নামক দেশ টির অর্থব্যবস্থা ঘুরে দাড়ানোর এখন একটাই আশা তা হলো চায়না-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডর। পাকিস্তানের রাজনৈতিক দের আশা এই করিডর চালু হলে পাকিস্তানের অর্থনীতির হাল ফিরবে তবে পরমবন্ধু চীনের সাথে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে পাকিস্তান ১৩.৭৭বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সর্বোচ্চ বানিজ্য করলেও এতে মাত্র ১.৬৯ বিলিয়ন ডলারের পন্য চীনে রপ্তানি করার সৌভাগ্য হয়েছে পাকিস্তানের, বাকী যা হয়েছে সব চীন থেকে হয়েছে আমদানি। চীন-পাকিস্তান ইকোনকিম করিডরে পাকিস্তানের পরিকাঠামো উন্নয়ন হলেও বানিজ্য বৃদ্ধি হওয়ার আশা সামান্যই, কারণ এর ফলে চীনা পন্যের পাকিস্তানের বাজার দখল হবে আরো সুবিধাজনক। ধীরে ধীরে পাকিস্তানের দেশীয় শিল্প গুলির অপমৃত্যু হবে তা বলাই বাহুল্য।
.
চীন বিশ্ব রাজনীতিতে সামাজ্যবাদের পুরনো ফরমুলা “নতুন মোড়কে” প্রযোগ করেছে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মত প্রথমে বন্ধুত্ব পূর্ণ আচরন এবং বাণিজ্যের নামে প্রবেশ এবং শেষে “বনিকের দণ্ড রাজদণ্ডে” পরিনত করার এক গোপন নীতি চীন ধীরে ধীরে প্রয়োগ করে চলেছে। বিপুল পরিমানে আর্থিক বোঝা মাথায় নিয়ে বসে থাকা পাকিস্তানের মাথায় আরো ওজন চাপানোর নীতি নিয়েছে চীন যাতে ভবিষ্যতে পাকিস্তান কে নিজেদের উপনিবেশে পরিনত করার পথ সোজা হয়।
.
ভারতের ভয়ে দক্ষিন এশিয়ায় পাকিস্তান চীন কে আহ্বান করে ডেকে এনেছে যেমন করে বাংলার নবার সিরাজদৌল্লার ভয়ে মিরজাফররা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে ভারতের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করার জন্য আহ্বান করেছিল। এর ফল কি হয়েছিল তা আমরা সকলেই জানি। তেমন ভাবেই ভারতীয় উপমহাদেশে চীনের প্রবেশ এই উপমহাদেশের জন্য ভবিষ্যতে গভীর সংকট বহন করে আনতে পারে। তাই নিজেদের সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তি দ্রুত বৃদ্ধি করা এখন নয়া দিল্লীর জন্য আরো জরুরী হয়ে পড়েছে কারণ ভারত যতদিন শক্তিশালী ও আন্তর্জাতিক মঞ্চে মাথা উচু করে থাকবে ততদিন ভারত সহ ভারতীয় উপমহাদেশের বাকী দেশ গুলিও সুরক্ষিত থাকবে। যেদিন বৈদেশিক শক্তির হাতে দিল্লীর পতন হবে সেদিন উপমহাদেশের বাকী দেশগুলির পূনরায় পরাধীনতা বরন করা হবে কেবলমাত্র সময়ের অপেক্ষা।
.
____________________­______________
লেখক: Newaz Sharif Rofi, MSE,রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। Collected From Zakir’s BCS Specials

Add a Comment