আইন

আইন বলতে সমাজ স্বীকৃত এবং রাষ্ট্র কর্তৃক অনুমোদিত নিয়ম-কানুনকে বোঝায়, যা মানুষের বাহ্যিক আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে। আইন মানুষের মঙ্গলের জন্য প্রণয়ন করা হয়। আইনের দ্বারা ব্যক্তির সাথে ব্যক্তির, ব্যক্তির সাথে রাষ্ট্রের এবং রাষ্ট্রের সাথে রাষ্ট্রের সম্পর্ক নির্ধারণ করা হয়। রাষ্ট্র বা সার্বভৌম কোনো কর্তৃপক্ষ কর্তৃক আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ করা হয়। আইন ভঙ্গ করলে শাস্তির বিধান আছে।

আইনের ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘Law’ ,যা টিউটনিক মূল শব্দ ‘Lag’ থেকে আবির্ভূত হয়েছে। আইন হল এমন কতগুলো নিয়ম-কানুন,যা সমাজ কর্তৃক স্বীকৃত ও রাষ্ট্র কর্তৃক অনুমোদিত।

অধ্যাপক হল্যান্ডের মতে,আইন হল মানুষের বাহ্যিক আচরণ নিয়ন্ত্রণের এমন কতগুলো সাধারণ নিয়ম যা সার্বভৌম শক্তি কর্তৃক প্রযুক্ত।”

বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫২ নং অনুচ্ছেদে আইনের ব্যাখ্যা দিয়ে বলা হয়েছে,”’আইন’ অর্থ কোন আইন, আদেশ, বিধি, প্রবিধান, উপ-আইন, বিজ্ঞপ্তি ও অন্যান্য আইনগত দলিল এবং বাংলাদেশের আইনের ক্ষমতাসম্পন্ন যে কোন রীতি বা প্রথা।”

আইনের মৌলিক বৈশিষ্ট্য

আইনের কতগুলো মৌলিক বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়। নিচে তা আলোচনা করা হলো।
১. বিধিবদ্ধ নিয়মাবলি: আইন কতগুলো প্রথা, রীতি-নীতি এবং নিয়মকানুনের সমষ্টি।

২. বাহ্যিক আচরণের সাথে যুক্ত: আইন মানুষের বাহ্যিক আচরণ ও কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করে। যেমন- আইনবিরোধী কোনো কাজের জন্য শাস্তি পেতে হয়। শাস্তির ভয়ে মানুষ অপরাধ থেকে বিরত থাকে।


৩. রাষ্ট্রীয় অনুমোদন ও স্বীকৃতি: সমাজের যেসব নিয়ম রাষ্ট্র অনুমোদন করে, সেগুলো আইনে পরিণত হয়। অন্য কথায়, আইনের পেছনে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব থাকে। রাষ্ট্রীয় অনুমোদন ও স্বীকৃতি ব্যতিরেকে কোনো বিধিবিধান আইনে পরিণত হয় না।

৪. ব্যক্তিস্বাধীনতার রক্ষক: আইন ব্যক্তিস্বাধীনতার রক্ষক হিসেবে কাজ করে। এজন্য আইনকে ব্যক্তিস্বাধীনতার ভিত্তি বলা হয়।

৫. সর্বজনীন: আইন সর্বজনীন। সমাজের সকল ব্যক্তি আইনের দৃষ্টিতে সমান। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, নারী-পুরুষ, ধনী, দরিদ্র সবার জন্য আইন সমানভাবে প্রযোজ্য।

আইনের প্রকারভেদ

সাধারণত আইনকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন-
১। সরকারি আইন,
২। বেসরকারি আইন ও
৩। আন্তর্জাতিক আইন।

১. সরকারি আইন: ব্যক্তির সাথে রাষ্ট্রের সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য যেসব আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ করা হয়, তাকে সরকারি আইন বলে। সরকারি আইনকে আবার কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন

ক. ফৌজদারি আইন ও দণ্ডবিধি: রাষ্ট্রের বিচার বিভাগের কাজ পরিচালনার জন্য এ ধরনের আইন প্রণয়ন করা হয়। কোনো কারণে ব্যক্তির অধিকার ভঙ্গ হলে এ আইনের সাহায্যে তার অধিকার রক্ষার ব্যবস্থা নেওয়া হয়।

খ. প্রশাসনিক আইন: রাষ্ট্রের শাসন বিভাগ এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণের জন্য এ ধরনের আইন প্রণয়ন করা হয়। এ আইনের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রশাসনিক কাজ পরিচালিত হয়।

গ. সাংবিধানিক আইন: এ ধরনের আইন রাষ্ট্রের সংবিধানে উল্লেখ থাকে। সাংবিধানিক আইনের মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালিত হয়।

২. বেসরকারি আইন: ব্যক্তির সাথে ব্যক্তির সম্পর্ক রক্ষার জন্য যে আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ করা হয়, তাকে বেসরকারি আইন বলে। যেমন- চুক্তি ও দলিল-সংক্রান্ত আইন। এ ধরনের আইন সামাজিক শৃঙ্খলা বজায় রাখতে সহায়ক
ভূমিকা পালন।
৩. আন্তর্জাতিক আইন: এক রাষ্ট্রের সাথে অন্য রাষ্ট্রের সম্পর্ক রক্ষার জন্য যে আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ করা হয়, তাকে আন্তর্জাতিক আইন বলে।

উপর্যুক্ত তিন প্রকার আইন এছাড়াও আছে প্রাকৃতিক আইন। যা মানুষের নীতিবোধ থেকে, প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্টি হয়েছে।

বিভিন্ন রাষ্ট্র পরস্পরের সাথে কেমন আচরণ করবে, এক রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রের নাগরিকদের সাথে কেমন ব্যবহার করবে, কীভাবে আন্তর্জাতিক সমস্যা সমাধান করা হবে তা আন্তর্জাতিক আইনের মাধ্যমে নির্ধারণ করা হয়।

আইনের উৎস

আইনের উৎপত্তি বিভিন্ন উৎস থেকে হতে পারে। আইনের উৎসগুলো নিম্নে বর্ণিত হলো।
১. প্রথা: দীর্ঘকাল যাবৎ কোনো নিয়ম সমাজে চলতে থাকলে তাকে প্রথা বলে। রাষ্ট্র সৃষ্টির পূর্বে প্রথার মাধ্যমে মানুষের আচরণ নিয়ন্ত্রণ হতো। রাষ্ট্র সৃষ্টির পর যেসব প্রথা রাষ্ট্র কর্তৃক অনুমোদন লাভ করে, সেগুলো আইনে
পরিণত হয়। যুক্তরাজ্যের অনেক আইন প্রথার উপর ভিত্তি করে সৃষ্টি হয়েছে।

২. ধর্ম: ধর্মীয় অনুশাসন ও ধর্মগ্রন্থ আইনের অন্যতম উৎস। সকল ধর্মের কিছু অনুশাসন রয়েছে, যা ঐ ধর্মের অনুসারীরা মেনে চলে। এসব অনুশাসন সমাজজীবনকে সুন্দর ও সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালিত করতে সহায়তা করে।
ফলে এসব ধর্মীয় অনুশাসনের অনেক কিছুই পরবর্তীতে রাষ্ট্রের স্বীকৃতি লাভের মাধ্যমে আইনে পরিণত হয়। যেমন- মুসলিম আইন, হিন্দু আইন প্রভৃতি। আমাদের দেশে পারিবারিক ও সম্পত্তি আইনের অনেকগুলো উপরিউল্লিখিত দুটি ধর্ম থেকে এসেছে।

৩. আইনবিদদের গ্রন্থ: আমরা যখন ইংরেজি গল্প, উপন্যাস কিংবা খবরের কাগজ পড়ি, অনেক শব্দার্থ বুঝতে সমস্যা হলে ইংরেজি অভিধান ও বিশ্বকোষের সাহায্য নিই। ঠিক তেমনি, বিচারকগণ কোনো মামলার বিচারকার্য সম্পাদন করতে গিয়ে আইনসংক্রান্ত কোনো সমস্যায় পড়লে তা সমাধানের জন্য আইনবিশারদদের বিজ্ঞানসম্মত গ্রন্থের সাহায্য নিয়ে এসব আইন ব্যাখ্যা করেন, যা পরবর্তীতে আইনে পরিণত হয়। যেমন- অধ্যাপক ডাইসির ‘ল অব দ্যা
কনস্টিটিউশন’ এবং বাকস্টোনের ‘কমেনটরিজ অন দ্যা লজ অব ইংল্যান্ড’।

৪. বিচারকের রায়: আদালতে উত্থাপিত মামলার বিচার করার জন্য প্রচলিত আইন অস্পষ্ট হলে বিচারকগণ তাদের প্রজ্ঞা ও বিচারবুদ্ধির উপর ভিত্তি করে ঐ আইনের ব্যখ্যা দেন এবং উক্ত মামলার রায় দেন। পরবর্তীকালে
বিচারকগণ সেসব রায় অনুসরণ করে বিচার করেন। এভাবে বিচারকের রায় পরবর্তীতে আইনে পরিণত হয়। সুতরাং বলা যায়, বিচারকের রায় আইনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস।

৫. ন্যায়বোধ: আদালতে এমন অনেক মামলা উত্থাপিত হয়, যা সমাধানের জন্য অনেক সময় কোনো আইন বিদ্যমান থাকে না। সে অব¯থায় বিচারকগণ তাদের ন্যায়বোধ বা বিবেক দ্বারা উক্ত মামলার বিচারকাজ সম্পাদন করেন এবং তা পরবর্তী সময়ে আইনে পরিণত হয়।

৬. আইনসভা: আধুনিককালে আইনের প্রধান উৎস আইনসভা। জনমতের সাথে সঙ্গতি রেখে বিভিন্ন দেশের আইনসভা নতুন আইন প্রণয়ন করে এবং পুরাতন আইন সংশোধন করে যুগোপযোগী করে তোলে।

আইন ও সুশাসন

সুশাসন মানেই আইনের শাসন। তাই দেশে সুশাসন বাস্তবায়নে আইনের শাসনের কোন বিকল্প নেই। এ.ভি.ডাইসি আইনের শাসন বলতে নিচের তিনটি বিষয়কে বুঝিয়েছেন-

১। Supremacy of law
২। Equality before law and
৩। predominance of legal spirit

সুতরাং, আইনের শাসন বলতে আইনের প্রাধান্য,আইনের দৃষ্টিতে সমতাকে বুঝিয়ে থাকে।এর ফলে ধনী-দরিদ্র,সবল-দুর্বল,পেশা-ধর্ম নির্বিশেষে সকলেই আইনের আশ্রয় লাভ করবে এবং ফলশ্রুতিতে দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে।

Add a Comment