সংবিধানে মৌলিক অধিকার

বিগত বিসিএসের প্রশ্নঃ ২০, ২৯ ও ৩০ তম বিসিএস লিখিত।

সমাজে মর্যাদাপূর্ণভাবে বেঁচে থাকতে একজন মানুষের যেসব অধিকার দরকার, সেগুলো মানবাধিকার হিসেবে বিবেচিত হয়। একটি রাষ্ট্রের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে এসবের মধ্য থেকে কিছু অধিকারকে মৌলিক হিসেবে ঘোষণা করে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই মৌলিক অধিকার ভঙ্গ হলে রাষ্ট্র প্রতিকার দিতে বাধ্য থাকে।
অনেক রকম মৌলিক অধিকার হতে পারে যেমন-
– সমতার অধিকার
– স্বাধীনতার অধিকার
– শোষিত না হওয়ার অধিকার
– ধর্মীয় অধিকার
– সাংস্কৃতিক ও শিক্ষার অধিকার
– বাক স্বাধীনতার অধিকার
– জীবন রক্ষার অধিকার
– ও এগুলোর লঙ্ঘনে সাংবিধানিক প্রতিকার ইত্যাতি
সংক্ষেপে বলতে গেলে, মানবাধিকার মানুষের জন্মগত। আর মৌলিক অধিকার হলো আইনিভাবে স্বীকৃত।

মৌলিক অধিকারের বৈশিষ্ট্য
– মৌলিক অধিকার মানবাধিকারের উৎকর্ষক
– মৌলিক অধিকার সংবিধান কর্তৃক বিধৃত, স্বীকৃত ও সংবিধানই তা রক্ষা করে।
– মৌলিক অধিকার অলঙ্ঘনীয় ও সরকার মৌলিক অধিকার পরিপন্থী কোন আইন প্রণয়ন করতে পারে না। কিন্তু জরুরি অবস্থায় মৌলিক অধিকার স্থগিত হতে পারে!! (মানে এগুলো পরম পালনীয় বেদ বাক্য ও নয়। 😀 )
– কোণ ব্যক্তির মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ন হলে তিনি আদালতের শরানাপন্ন হতে পারেন, আদালত তার মৌলিক অধিকার ফিরিয়ে দিতে সরকারকে আদেশ দিতে পারে।
– বৈষম্যহীনভাবে মানুষ মৌলিক অধিকার ভোগ করবে।
– মৌলিক অধিকার মানুষের জীবন ও ব্যক্তিত্ব বিকাশের সহায়ক।

বাংলাদেশের সংবিধানে মৌলিক অধিকার
প্রতিটি দেশের সংবিধানেই মৌলিক অধিকারের বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে। বাংলাদেশ সংবিধানের তৃতীয় ভাগে মৌলিক অধিকার নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। প্রথমে মৌলিক অধিকার সংশ্লিষ্ট বাংলাদেশ সংবিধানের ধারাগুলো দেখুন।

বাংলাদেশ সংবিধানে মৌলিক অধিকার

মৌলিক অধিকারের প্রাধান্য সংবিধানের ২৬ থেকে ৪৭ (ক) অনুচ্ছেদগুলো মৌলিক অধিকার সংশ্লিষ্ট। তৃতীয় ভাগের শুরুতে অর্থাৎ ২৬ নম্বর অনুচ্ছেদেই বলা হয়েছে, মৌলিক অধিকারের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ কোনো আইন করা যাবে না। আর যদি করা হয় তবে তা বাতিল হয়ে যাবে। সরকার বা মন্ত্রিপরিষদ ইচ্ছা করলেই মৌলিক অধিকার পরিপন্থী আইন তৈরি করে এর ব্যত্যয় ঘটাতে পারবে না।

আইনের দৃষ্টিতে সমতা
সংবিধানের ২৭ নম্বর অনুচ্ছেদে বিদ্যমান আইনে নাগরিকদের কীভাবে দেখা হয়, সে বিষয়ে বলা হয়েছে। এই অনুচ্ছেদে বলা আছে, আইনের দৃষ্টিতে প্রতিটি নাগরিক সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।

অবস্থানগত কারণে বৈষম্য
ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, বাসস্থান বা পেশাগত কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি বৈষম্য করা যাবে না। মৌলিক এ অধিকারের বিষয়ে সংবিধানের ২৮ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে। ২৮ নম্বর অনুচ্ছেদের (২) ধারায় বলা হয়েছে- রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারীপুরুষের সমান অধিকার লাভ করিবেন।

সরকারি চাকরিতে অধিকার
২৯ নম্বর অনুচ্ছেদে সরকারি চাকরিতে সবার সমান সুযোগ আছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আবার সমাজের অনগ্রসর অংশকে এগিয়ে নিতে রাষ্ট্রকে বিশেষ বিধান প্রণয়নেরও ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে।

আইনের আশ্রয়লাভের অধিকার
রাষ্ট্রের যেকোনো নাগরিকের আইনের আশ্রয়লাভের অধিকার আছে উল্লেখ করে সংবিধানের ৩১ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, সুস্পষ্ট কারণ ছাড়া কোনো নাগরিকের বিরুদ্ধে এমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না যাতে তাঁর জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পদের ক্ষতি হয়।

জীবন ও ব্যক্তি-স্বাধীনতার অধিকাররক্ষণ
৩২ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা আছে- আইনানুযায়ী ব্যতীত জীবন ও ব্যক্তি-স্বাধীনতা হইতে কোন ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাইবে না।

বিনা বিচারে আটক
কোনো ব্যক্তিকে আটক করা নিয়ে নির্দেশনা আছে ৩৩ নম্বর অনুচ্ছেদে। এতে বলা হয়েছে, বিনা কারণে কাউকে আটক করা যাবে না। কোনো কারণে কাউকে আটক করা হলে, সেটির কারণ জানিয়ে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ দিতে হবে। কোনো অবস্থায় তাকে ২৪ ঘণ্টার বেশি সময় হাজতে রাখা যাবে না। আটকের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পার্শ্ববর্তী ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে আটক ব্যক্তিকে হাজির করে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে।

জোরপূর্বক শ্রম
ফৌজদারি অপরাধের সাজাপ্রাপ্ত আসামি না হলে অথবা জনগণের বৃহৎ স্বার্থে আবশ্যক না হলে কাউকে জোর করে কোনো কাজ করানো যাবে না। এ বিষয়টি বলা হয়েছে ৩৪ নম্বর অনুচ্ছেদে।

বিচার ও দণ্ড সম্পর্কে রক্ষণ
কেউ কোনো অপরাধ করলে তার বিচার অবশ্যই ওই সময়ে প্রচলিত আইনে করতে হবে বলে ৩৫ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে। এক অপরাধের জন্য একাধিকবার শাস্তি দেওয়া যাবে না। বিচার হতে হবে প্রকাশ্য। অপরাধীকে নিজের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দানে বাধ্য করা যাবে না। কোন ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেওয়া যাইবে না কিংবা নিষ্ঠুর, অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর দণ্ড দেওয়া যাইবে না কিংবা কাহারও সহিত অনুরূপ ব্যবহার করা যাইবে না।

সমাবেশ, সংগঠন ও চলাফেরার স্বাধীনতা
জনস্বার্থে আইনের মাধ্যমে আরোপিত যুক্তিসংগত বাধানিষেধ ছাড়া দেশের যেকোনো স্থানে অবাধ চলাফেরার, দেশত্যাগ ও পুনঃপ্রবেশের স্বাধীনতা রয়েছে নাগরিকদের। ৩৬(চলাফেরা), ৩৭(সমাবেশ) ও ৩৮(সংগঠন ) নম্বর অনুচ্ছেদে বিষয়গুলোর উল্লেখ করা হয়েছে। এ অনুচ্ছেদগুলোতে জনস্বাস্থ্য ও জনশৃঙ্খলার প্রতি গুরুত্ব দিয়ে যেকোনো সমাবেশ বা সংগঠনের অধিকার প্রতিটি নাগরিকেরই রয়েছে বলে জানানো হয়েছে।

চিন্তা, বিবেক ও বাকস্বাধীনতা
রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা ও নৈতিকতার স্বার্থে আইনের মাধ্যমে যুক্তিসংগত বাধানিষেধ সাপেক্ষে প্রতিটি নাগরিকের চিন্তা, বিবেক ও বাকস্বাধীনতা রয়েছে। ৩৯ নম্বর অনুচ্ছেদে বিষয়টির উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়, সংবাদক্ষেত্রগুলোতেও এ স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে।

পেশা নির্বাচনের স্বাধীনতা
যেকোনো নাগরিক আইন অনুযায়ী যেকোনো কাজকে নিজের পেশা হিসেবে বাছাই করতে পারবে বলে ৪০ নম্বর অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে।

ধর্মীয় স্বাধীনতা
প্রতিটি নাগরিকের নিজ নিজ ধর্ম পালনের স্বাধীনতা থাকবে বলে ৪১ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে। এতে বলা হয়, কাউকে জবরদস্তি করে কোনো ধর্ম পালনে বা পাঠদানে বাধ্য করা যাবে না।

সম্পত্তির অধিকার
আইনের মাধ্যমে আরোপিত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে প্রতিটি নাগরিক সম্পত্তি অর্জন, ধারণ, হস্তান্তর করতে পারবে বলে ৪২ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে।

গৃহ ও যোগাযোগের অধিকার
রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, জনশৃঙ্খলার স্বার্থে আইনের মাধ্যমে আরোপিত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে প্রতিটি নাগরিকের নিজ গৃহে নিরাপত্তা লাভের অধিকার থাকবে। ৪৩ নম্বর অনুচ্ছেদে বিষয়টির উল্লেখ করে বলা হয়েছে, নাগরিকদের চিঠিপত্র ও যোগাযোগের গোপনীয়তা রক্ষা করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।

মৌলিক অধিকার ভঙ্গ হলে করণীয়
৪৪ নম্বর অনুচ্ছেদে বর্ণিত হয়েছে- যে কোনো কারণে মৌলিক অধিকার ভঙ্গ হতে পারে। এ ক্ষেত্রে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি সংবিধানের ১০২(১) নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে রিট আবেদনের মাধ্যমে অধিকার পুনরুদ্ধার করতে পারবেন।

মৌলিক অধিকার সরকারকে জনকল্যাণমুখী করে। তাকে স্বেচ্ছাচারী হতে বিরত করে ও গণতান্ত্রিক চর্চার বিকাশ ঘটায়।

Add a Comment