বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র

বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার বা মুজিবনগর সরকার কর্তৃক ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল তারিখে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষিত একটি ঘোষণাপত্র। যতদিন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলেছে ততদিন মুজিবনগর সরকার পরিচালনার অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধান হিসেবে এই ঘোষণাপত্র কার্যকর ছিল। এদিনই ২৬ মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণাকে আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমোদন দেয়া হয় ২৬ মার্চ থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা কার্যকর হয়েছে বলে ঘোষণা করা হয়। এর ফলে প্রবাসী মুজিবনগর সরকারও বৈধ বলে স্বীকৃত হয়। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার পরও এই ঘোষণাপত্র সংবিধান হিসেবে কার্যকর ছিল। ১৯৭২ সালের ১৬ ই ডিসেম্বর তারিখে যখন দেশের নতুন সংবিধান প্রণীত হয় তখন সংবিধান হিসেবে এর কার্যকারিতার সমাপ্তি ঘটে।

ইতিহাস
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী ঢাকা এবং তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অন্যান্য অংশে আক্রমণ চালিয়ে ব্যাপক গণহত্যা চালায়। এই গণগত্যার প্রাক্কালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ, গণপরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যগণ নিরাপত্তার জন্য সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নেন। ৩০ মার্চের মধ্যেই তাদের অনেকে কলকাতায় সমবেত হন। প্রাদেশিক পরিষদের যে সকল সদস্য ১০ এপ্রিল এর মধ্যে কলকাতায় পৌছতে সক্ষম হন তাদের নিয়ে তাজউদ্দীন আহমদ মন্ত্রিপরিষদ গঠন করেন। তার নির্দেশেই অধ্যাপক রেহমান সোবহান আরো কয়েকজনের সাহায্য নিয়ে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের একটি খসড়া প্রণয়ন করেন। এরপর ব্যরিস্টার আমীর-উল-ইসলাম এই ঘোষণাপত্রের আইনগত দিকগুলো সংশোধন করে একে পূর্ণতা দান করেন। এই ঘোষণাপত্রটি প্রথমে ১০ এপ্রিল মুজিবনগর থেকে প্রচার করা হয়। এরপর আবার ১৭ এপ্রিল তারিখে মেহেরপুর জেলার সীমান্তবর্তী স্থান বৈদ্যনাথতলায় (পরবর্তী নাম মুজিবনগর) এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানে গণপরিষদের সদস্য এম ইউসুফ আলী আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। এই ঘোষণার মাধ্যমে নবগঠিত প্রবাসী আইন পরিষদ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব ঘোষণা করে সাথে সাথে এ ঘোষণাপত্র প্রবাসী সরকারের অবস্থান ও যৌক্তিকতা দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করে।

সংবিধানে স্বাধীনতার ঘোষণা পত্র
১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল তারিখেই ২৬ মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণাকে আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমোদন দেয়া হয় এবং একই সাথে ২৬ মার্চ থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা কার্যকর হয়েছে বলে ঘোষণা করা হয়। এর ফলে প্রবাসী মুজিবনগর সরকারও বৈধ বলে স্বীকৃত হয়। এ ঘোষণায় মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সকলের মধ্যে চেইন অফ কমান্ড স্থাপনের নির্দেশ দেয়া হয়। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্য রাত শেষে অর্থাৎ ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক প্রদত্ত স্বাধীনতার ঘোষণা সংবিধানের ৬ষ্ঠ তফশিলে ও ১৯৭১ সালের ১৭ই এপ্রিল তারিখে মুজিবনগর সরকারের জারিকৃত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র সংবিধানের ৭ম তফসিলে সংযোজিত হয়েছে।


ঘোষণাপত্রের পূর্ণ বিবরণ

মুজিবনগর, বাংলাদেশ।
তারিখ: ১০ এপ্রিল ১৯৭১

যেহেতু ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর থেকে ১৯৭১ সালের ১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশে অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে শাসনতন্ত্র রচনার উদ্দেশ্যে প্রতিনিধি নির্বাচিত করা হয়েছিল; এবং যেহেতু এই নির্বাচনে বাংলাদেশের জনগণ ১৬৯ টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ দলীয় ১৬৭ জন প্রতিনিধি নির্বাচিত করেছিল; এবং যেহেতু জেনারেল ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সনের ৩রা মার্চ তারিখে শাসনতন্ত্র রচনার উদ্দেশ্যে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অধিবেশন আহ্বান করেন; এবং যেহেতু তিনি আহূত এই অধিবেশন স্বেচ্ছাচার এবং বেআইনীভাবে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেন; এবং যেহেতু পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ তাদের প্রতিশ্রুতি পালন করার পরিবর্তে বাংলাদেশের জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে পারস্পারিক আলোচনাকালে ন্যায়নীতি বহির্ভূত এবং বিশ্বাসঘাতকতামূলক যুদ্ধ ঘোষণা করেন; এবং যেহেতু উল্লিখিত বিশ্বাসঘাতকতামূলক কাজের জন্য উদ্ভূত পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার অর্জনের আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ ঢাকায় যথাযথভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন, এবং বাংলাদেশের অখণ্ডতা ও মর্যাদা রক্ষার জন্য বাংলাদেশের জনগণের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান; এবং যেহেতু পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ বর্বর ও নৃশংস যুদ্ধ পরিচালনা করেছে এবং এখনও বাংলাদেশের বেসামরিক ও নিরস্ত্র জনগণের বিরুদ্ধে নজিরবিহীন গণহত্যা ও নির্যাতন চালাচ্ছে; এবং যেহেতু পাকিস্তান সরকার অন্যায় যুদ্ধ ও গণহত্য এবং নানাবিধ নৃশংস অত্যাচার পরিচালনার দ্বারা বাংলাদেশের গণপ্রতিনিধিদের পক্ষে একত্রিত হয়ে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব কে তুলেছে; এবং যেহেতু বাংলাদেশের জনগণ তাদের বীরত্ব, সাহসিকতা ও বিপ্লবী কার্যক্রমের মাধ্যমে বাংলাদেশের উপর তাদের কার্যকরি কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে; সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী বাংলাদেশের জনগণ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রতি যে ম্যান্ডেট দিয়েছেন সে ম্যান্ডেট মোতাবেক আমরা, নির্বাচিত প্রতিনিধিরা, আমাদের সমবায়ে গণপরিষদ গঠন করে পারষ্পরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশকে একটি সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্র ঘোষণা করছি

এবং এর দ্বারা পূর্বাহ্নে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণা অনুমোদন করছি; এবং এতদ্বারা আমরা আরও সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছি যে শাসনতন্ত্র প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপ্রধান এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপ-রাষ্ট্রপ্রধান পদে অধিষ্ঠিত থাকবেন; এবং রাষ্ট্রপ্রধান প্রজাতন্ত্রের সশস্ত্র বাহিনীসমূহের সর্বাধিনায়ক পদে অধিষ্ঠিত থাকবেন; ক্ষমা প্রদর্শনের ক্ষমতাসহ সর্বপ্রকার প্রশাসনিক ও আইন প্রণয়নের ক্ষমতার অধিকারী থাকবেন; এবং
তাঁর কর ধার্য ও অর্থব্যয়ের ক্ষমতা থাকবে; এবং বাংলাদেশের জনসাধারণের জন্য আইনানুগ ও নিয়মতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য অন্যান্য প্রয়োজনীয় সকল ক্ষমতারও তিনি অধিকারী হবেন।

বাংলাদেশের জনগণ দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসাবে আমরা আরও সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছি যে, কোনো কারণে যদি রাষ্ট্রপ্রধান না থাকেন অথবা যদি রাষ্ট্রপ্রধান কাজে যোগদান করতে না পারেন অথবা তাঁর দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে যদি অক্ষম হন, তবে রাষ্ট্রপ্রধান প্রদত্ত সকল দায়িত্ব উপ-রাষ্ট্রপ্রধান পালন করবেন। আমরা আরও সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছি যে, বিশ্বের একটি জাতি হিসাবে এবং জাতিসংঘের সনদ মোতাবেক আমাদের উপর যে দায়িত্ব ও কর্তব্য বর্তেছে তা যথাযথভাবে আমরা পালন করব। আমরা আরও সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছি যে, আমাদের এই স্বাধীনতার ঘোষণা ১৯৭১ সনের ২৬শে মার্চ থেকে কার্যকর বলে গণ্য হবে। আমরা আরও সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছি যে, আমাদের এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করার জন্য আমরা অধ্যাপক এম. ইউসুফ আলীকে যথাযথভাবে রাষ্ট্রপ্রধান ও উপ-রাষ্ট্রপ্রধানের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনার জন্য দায়িত্ব অর্পণ ও নিযুক্ত করলাম।

স্বাক্ষর: অধ্যাপক এম. ইউসুফ আলী
বাংলাদেশ গণপরিষদের ক্ষমতা দ্বারা এবং ক্ষমতাবলে যথাবিধি সর্বাধিক ক্ষমতাধিকারী।

Add a Comment