চীন-ভারত কেন মিয়ানমারের পক্ষে?

প্রথম আলো, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭
এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।


রাজনীতি আর কূটনীতির গতি–প্রকৃতি যে কত দ্রুত দিকে বাঁক খায়! এর আসলেই কোনো সরল হিসাব-নিকাশ নেই। মূল হিসাবটি স্বার্থ। ভুটান ও চীন দুই তরফেই নিজেদের বলে দাবি করা ভূখণ্ড দোকলাম নিয়ে ভারত-চীনের মধ্যে দুদিন আগেই রীতিমতো যুদ্ধ বাধার অবস্থা তৈরি হয়েছিল। তা তো এখন কেটেছেই, কিন্তু সেই সঙ্গে আমরা দেখছি, মিয়ানমারের রোহিঙ্গা ইস্যু এই দুই দেশকে কৌশলগতভাবে এক জায়গায় নিয়ে এসেছে। রাখাইন রাজ্য ও রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমার যে অবস্থান নিয়েছে, মানে একে ‘ইসলামি সন্ত্রাসবাদের’ বিপদ তুলে ধরার যে কৌশল নিয়েছে, চীন ও ভারত বিষয়টিকে সেভাবেই দেখছে।

এটা সবারই জানা যে রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর নতুন করে অত্যাচার, নির্যাতন ও গণহত্যার সূচনা ঘটে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি বা আরসার হামলার পর। মিয়ানমার-বিষয়ক পর্যবেক্ষক ও সাংবাদিক ল্যারি জ্যাগান লিখেছেন, (মিয়ানমার হিউম্যানিটারিয়ান ক্রাইসিস) আরসাকে কোনোভাবেই একটি চরমপন্থী বা সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে বিবেচনা করতে চায় না মিয়ানমার। দেশটি আরসাকে ‘ইসলামপন্থী সন্ত্রাসী’ হিসেবেই পরিচিত ও চিহ্নিত করতে চাইছে। আরসার যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পর তাই মিয়ানমার সরকারের তরফে তা প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে।

‘ইসলামি সন্ত্রাসবাদ’ ছড়িয়ে পড়তে পারে এমন যেকোনো পরিস্থিতি এতটাই ভয়ের যে চীন ও ভারতের মতো দেশকে তা এক ঘাটে নিয়ে এসেছে। এ নিয়ে বাংলাদেশেরও কম ভয় নেই। তা না হলে আরসার হামলার পর বাংলাদেশের তরফে মিয়ানমারের সঙ্গে যৌথ অভিযানের কথা বলা হতো বলে মনে হয় না। বাংলাদেশ সরকারের এই বক্তব্য নিয়ে অনেক সমালোচনা হচ্ছে, কিন্তু ‘ইসলামি জঙ্গিবাদের’ নাম-নিশানা যেখানে আছে, সেখানে অবস্থান না নিয়ে চুপ থাকা কঠিন। আরসাকে একটি জাতীয়তাবাদী সংগঠন হিসেবে বিবেচনা করার অনেক কারণ রয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ইসলামি সন্ত্রাসবাদের ‘গন্ধ’ থেকে একে মুক্ত রাখা কঠিন। মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নীতির কারণে সত্তরের দশকের শেষের দিকে ‘ইসলামিক রিপাবলিক অব নর্থ আরাকান’ নামে স্বাধীন একটি দেশ গঠনে সশস্ত্র আন্দোলনের বিষয়টি তো আর ইতিহাস থেকে মুছে যায়নি! সব মিলিয়ে বাংলাদেশের জন্য পরিস্থিতি শুধু মহাসংকটের নয়, উভয় সংকটেরও।

আগের লাখ চারেক রোহিঙ্গা শরণার্থীর সঙ্গে এবার যুক্ত হয়েছে আরও তিন লাখ শরণার্থী। চরম অত্যাচার, নির্যাতন ও গণহত্যার শিকার হয়ে তারা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। এই জনগোষ্ঠীকে গ্রহণ না করে বাংলাদেশের কোনো পথ ছিল না। কিন্তু রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে মিয়ানমারের যে নীতি ও পরিকল্পনা দিনে দিনে ফরসা হয়ে উঠছে, তাতে এদের ফেরত পাঠানো যে সহজ হবে না, সেটাও টের পাওয়া যাচ্ছে। আর এত বড় একটি মুসলিম জনগোষ্ঠী যেখানে ধারাবাহিকভাবে অত্যাচার ও নির্যাতনের শিকার হয়ে বাস্তুচ্যুত হয়েছে, তখন সেখানে সন্ত্রাসবাদ, বিশেষ করে ইসলামি জঙ্গিবাদ ঢুকে পড়বে না, তা কি আমরা নিশ্চিত করে বলতে পারি? বিশেষ করে বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে। দেশের ভেতরের ইসলামি জঙ্গিবাদ নিয়ে আমরা এমনিতেই চরম বিপদে আছি।

এই অঞ্চলের অন্য দেশগুলোর ওপর প্রভাব বিস্তারের চেষ্টায় ভারত ও চীন এখন এক চরম প্রতিযোগিতার মধ্যে রয়েছে। আমাদের দুর্ভাগ্য হচ্ছে, রোহিঙ্গা ইস্যুতে এই দুটি দেশকে পাশে পাচ্ছে না বাংলাদেশ। মিয়ানমার ও তাদের রোহিঙ্গা নীতিই এই দুটি দেশের স্বার্থের সঙ্গে বেশি যায় বলে অন্তত এখন পর্যন্ত চীন ও ভারত মনে করছে। তবে ‘ইসলামি সন্ত্রাসবাদের’ বিপদকে এখানে বড় করে দেখা হলেও অর্থনৈতিক স্বার্থ, বিনিয়োগ ও ভূরাজনীতির হিসাব-নিকাশটিকেই আসল বলে মনে করেন অনেক পর্যবেক্ষক।

মিয়ানমারে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ যে দেশটির, তা হচ্ছে চীন। পরিসংখ্যান বলছে, গত ৩০ বছরে মিয়ানমারে চীনের বিনিয়োগের পরিমাণ ১৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। পশ্চিমা দেশগুলোর বিনিয়োগ মিলিয়ে এর ধারেকাছেও নেই। ভারতের বিনিয়োগ অবশ্য এখন পর্যন্ত খুব বেশি নয়, কিন্তু তা বাড়ানোর সব উদ্যোগ ও জোর চেষ্টা আছে। রাখাইন রাজ্যে গভীর সমুদ্রবন্দর তৈরি করছে ভারত। মিজোরাম থেকে মিয়ানমার হয়ে থাইল্যান্ড পর্যন্ত সড়ক বানানোর একটি পরিকল্পনাও নাকি ভারতের আছে। চীনের প্রভাববলয়ের মধ্যে থাকা জ্বালানি, খনিজ ও বনজ সম্পদে ভরা মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন অর্থনৈতিক ও কৌশলগত কারণে যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা ভারত ভালোই জানে।

অত্যাচার, নির্যাতন ও গণহত্যার শিকার হয়ে লাখ লাখ রোহিঙ্গা যখন দেশ ছাড়ছে, তখনই গত সপ্তাহে মিয়ানমার সফর করে এলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। সফর শেষে যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারত ও মিয়ানমার যে একই অবস্থানে রয়েছে, তা নিয়ে বিভ্রান্তির সুযোগ নেই। রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচার, নির্যাতন বা বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের মানবিক দুর্দশা নিয়ে মোদির মুখে তখন কিছুই শোনা যায়নি।

আন্তর্জাতিকভাবে চীনের সরকারি অবস্থান তুলে ধরে যে গণমাধ্যম, সেই গ্লোবাল টাইমস-এ আমরা শেষ পর্যন্ত এক সম্পাদকীয় পেলাম ১০ সেপ্টেম্বর। এর শিরোনাম ‘রাখাইন সহিংসতার জন্য কি সু চি দায়ী?’ শিরোনাম থেকেই বোঝা যায়, তারা এ জন্য সু চিকে দায়ী করতে চায় না; বরং মিয়ানমারের পরিস্থিতি ও বাস্তবতা না বুঝে সু চির সমালোচনা করার জন্য পশ্চিমা দেশগুলোর কঠিন সমালোচনা করা হয়েছে। লিখেছে, এটা একটা মানবিক বিপর্যয় যে রাখাইনের হাজার হাজার মুসলমান বাংলাদেশে পালিয়ে গেছে। কিন্তু মিয়ানমারের বাস্তবতা বিবেচনায় নিলে, পশ্চিমা সমালোচকেরা যেভাবে দেখছেন, তার চেয়ে এ ধরনের বিপর্যয় ঠেকানোর কাজটি কঠিন।

উইঘুর মুসলিমদের নিয়ে চীন বেশ সমস্যার মধ্যে আছে। ‘মুসলিম’ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী নিয়ে সম্ভবত সে কারণে তাদের ভয়টা একটু বেশি। রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচার, নির্যাতন শুরু হওয়ার পর শান্তিতে নোবেলজয়ী মালালা ইউসুফজাই যখন সু চির সমালোচনা করেছেন, তখন গ্লোবাল টাইমস-এ লেখা এক নিবন্ধে তার জবাব দিয়েছেন এক বিশ্লেষক। নিউ লুলু তাঁর নিবন্ধে (মালালা হ্যাজ আ লট টু লার্ন বিফোর হিটিং আউট অ্যাট সু চি) লিখেছেন, মালালা আসলে না বুঝেই সু চির সমালোচনা করেছেন। কারণ, তিনি জানেন না যে মিয়ানমারসহ এই পুরো অঞ্চল ইসলামি জঙ্গিবাদের বিপদের মধ্যে রয়েছে। তিনি মালালাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে তালেবানদের বিরুদ্ধে তাঁর জোর অবস্থানই কিন্তু তাঁকে নোবেল এনে দিয়েছে।

রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারত ও চীনের অবস্থান বিবেচনায় নিয়ে বলা যায়, মিয়ানমার অনেক সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। চীন ও ভারতের মতো দুটি বন্ধুদেশকে বাংলাদেশ রোহিঙ্গা ইস্যুতে কাছে পায়নি, এটা অনেকের কাছেই সরকারের কূটনৈতিক ব্যর্থতা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। কিন্তু সব দেশের কূটনীতির মূলই হচ্ছে নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করা। ভারত ও চীনের স্বার্থ যদি মিয়ানমারের পক্ষে যায়, তবে তারা সেদিকেই যাবে। কোনো কূটনীতি বা এর কোনো ‘সাফল্যই’ তাদের বাংলাদেশের পক্ষে আনতে পারবে না।

কিন্তু এরপরও কূটনৈতিক সাফল্য বলে কিছু আছে। এটা একটা অব্যাহত প্রক্রিয়া। কোনো পরিস্থিতি বা বাস্তবতা কখনো এক জায়গায় আটকে থাকে না। চীন বা ভারত তাদের স্বার্থে মিয়ানমারকে হয়তো এখনই কোনো চাপ দিতে রাজি হবে না। কিন্তু এই দেশ দুটি এটাও জানে যে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিয়ে বাংলাদেশ যে বিপদের মধ্যে পড়েছে, তার কোনো দায় দেশটির নেই। ইসলামি জঙ্গিবাদের বিপদ মাথায় রেখে ভারত ও চীন যদি মিয়ানমারের পক্ষ নিয়ে থাকে, তবে বাংলাদেশের কূটনীতির মূল এখন হওয়া উচিত দেশ দুটোকে এটা বোঝানো যে মিয়ানমারের আরাকান বা রোহিঙ্গা নীতি বরং এই অঞ্চলে এই বিপদকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে। এই বিপদ থেকে তখন কেউই গা বাঁচাতে পারবে না। অর্থনৈতিক লাভের হিসাব-নিকাশ তখন না-ও মিলতে পারে।

Add a Comment