জাল স্বপ্ন, স্বপ্নের জাল

‘জাল স্বপ্ন স্বপ্নের জাল’ গল্পের মূল বক্তব্য উপস্থাপন করুন । (৩৭তম বিসিএস লিখিত)

মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক ছোট গল্প :- ‘জাল স্বপ্ন, স্বপ্নের জাল’
রচনা :- আখতারুজ্জামান ইলিয়াস।
সংক্ষিপ্ত কাহিনী :-
ইলিয়াসের অন্য এক গল্প, ‘জাল স্বপ্ন, স্বপ্নের জাল’ মুক্তিযুদ্ধের গল্প। ইলিয়াস ঢাকা শহরেরএকেবারে হত দরিদ্র মানুষকে চিনতেন। তাদের কথা নিয়েই ‘চিলে কোঠার সেপাই’ লিখেছিলেন। সেই রিকশাওয়ালা খিজির, বাংলা সাহিত্য কি তাকে ভুলবে? তেমনি এক চরিত্র ‘জাল স্বপ্ন, স্বপ্নের জাল’ গল্পের লালমিয়া। সে যে খোয়াব দ্যাখে ঘুমের ভিতর তা সাত কাহন করে শোনায়। আসলে খোয়াব দ্যাখে না খোয়াব বানায় তার ঠিক নেই। তার স্বপ্নগুলি জাল ( মিথ্যা), না সে স্বপ্নের জালে ক্রমাগত জড়িয়ে যায়, এই নিয়ে গল্প। লালমিয়ার যে খোয়াবে আরম্ভ হয় গল্প, সেই খোয়াবের বুড়ো মুসল্লির পায়ের পাতাটি পিছনে। তা নিয়ে শ্রোতারা সন্দেহ প্রকাশ করলেও লালমিয়া তার বয়ান থেকে পিছু হটে না। স্বপ্নের ভিতরে নামাজ পড়তে পড়তে তার পাশে বসা বুড়োর পায়ের পাতাটি সে অমনি দেখেছিল। এই কাহিনী, পায়ের পাতা উলটো করে বসান বিদেহী, লোকসমাজে প্রচলিত। আমি তো ছেলেবেলায় তা শুনেছি।
লালমিয়া নাজির আলির মোরগা-পোলাওয়ের দোকান দ্যাখে। সেই দোকানেই কাজ করে যে কিশোর বুলেট, সে লালমিয়ার স্যাঙাৎ ইমামুদ্দিনের ছেলে। ইমামুদিন মুক্তিতে নাম লিখিয়েছিল, তাই মরেছে। তার বউকে মিলিটারি তুলে নিয়ে গিয়েছিল, আর ফেরত দেয়নি। বুলেট তার দাদির কাছে মানুষ। তার স্বভাবটি হয়েছে তার বাবা ইমামুদ্দিনের মতো। লালমিয়ার কথায় শুধু সন্দেহ প্রকাশ করে। এই গল্প সেই ইমামুদ্দিনেরও যে কিনা মুক্তিযুদ্ধে নিজেকে আহুতি দিয়েছিল। এই কাহিনী নাজির আলির যে কিনা পাকিস্তানি মিলিটারির খিদমৎ খাটত। মিলিটারিকে জানান দিত মুক্তির পক্ষের লোকজনের সুলুক।
লালমিয়া ছিল নাজির আলির লন্ড্রির ইস্ত্রি করা মজুর। লন্ড্রিটা নাজির আলি দখল করেছিল ঢাকায় মিলিটারি নামলে হিন্দু এক পরিবার প্রাণের ভয়ে ইন্ডিয়া চলে গেলে। খোয়াব দেখা বা খোয়াব তৈরি করা লালমিয়ার স্বভাব। সেই কৈশোর থেকে ইমামুদ্দিনের সঙ্গে তার স্যাঙাতির সময় থেকেই সে বানায়। সিনেমা দেখে এসে সাতকাহন। ইমামুদ্দিন সন্দেহ প্রকাশ করত। লালমিয়া সেই স্বপ্ন কিংবা তার অলীক গল্প-কাহিনী নিয়েই সমস্তজীবন কাটিয়ে দিল। আর কাটাল ইমামুদ্দিনের মা, বুলেটের দাদি, আর কাটায় বুলেট। সকলেই নিজের মতো করে স্বপ্ন তৈরি করে নেয়। বুলেটের দাদি তার স্বপ্নের ভিতর দিয়েই ইমামুদ্দিনকে বীর মুক্তিযোদ্ধা করে তোলে। সে হানাদার পাকিস্তানি মিলিটারিকে মেরেছে দেশের মুক্তির জন্য। নাজির আলিকেও। সমস্তটাই তার ইচ্ছে পূরণের স্বপ্ন। রাজাকার নাজির আলি বাংলাদেশের জন্মের পর ঢাকা থেকে পালিয়েছিল। তারপর সব ম্যানেজ করে আবার ফিরে এসে দখল নিয়েছে নিজের ক্ষমতার। ছেলেবেলা থেকে দাদির মুখে বাবার কাহিনী, বীরত্বের কথা শুনে শুনে বুলেটের ভিতরেও স্বপ্ন তৈরি হয়। সেও তার বাবাকে নিয়ে গল্প বানায়। কী অসামান্য ইলিয়াসের এই কথন। বিভ্রম ও বাস্তবতা দুই কী ভাবে মিলিয়ে পৌঁছেছেন এমন এক বৃত্তান্তে, যা কিনা বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ এবং পরবর্তী সমাজকে চিনিয়ে দেয় বিন্দুতে বিন্দুতে। মুক্তিযুদ্ধে নিম্নবর্গের মানুষের অংশগ্রহণে সমগ্র এই গল্পই হয়ে ওঠে যেন এক স্বপ্ন বৃত্তান্ত।
ইলিয়াস নগরবাসী নিম্নবর্গের মানুষকে চিনতেন যেভাবে, সেই চেনা আমাদের সাহিত্যে, দুই বাংলাতেই বিরল। লালমিয়া ছিল নাজির আলির কর্মচারি। লালমিয়া মুক্তিযুদ্ধে যায়নি। কিন্তু লালমিয়া ইমামুদ্দিনের এতিম বাচ্চা আর তার মায়ের জন্য আহার জোগাড় করেছিল। তার জীবনের অন্তর্গত হয়েই আসে এই সব। সে নাজির আলি নয়, সে লালমিয়া। সে যাদের দ্যাখে খোয়াবে, তাদের পায়ের পাতা পিছনে। তারা সমুখে এগোতে গেলে পিছনে চলে যায়। পিছনে হাঁটা ব্যতীত তাদের কোনো উপায় থাকে না, তাই খোয়াব তাকে ভয়ার্ত করেনি। এই গল্প এক আশ্চর্য কথন। ইলিয়াস নিজেই নিজের সঙ্গে তুলনীয়।
সংগ্রহঃ আপন পোস্ট- পবন চৌধুরী

Add a Comment